ছেলে বেলার শীতকাল

  • আপডেট: ০২:৫০:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯
  • ৩৫

মোঃ জাহাঙ্গীর আলম হৃদয়

ছোটবেলায় বইতে পড়েছি বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। এখন আমার মনে হয়, ঋতু মূলত তিনটি আছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। বাকি ঋতুগুলি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে। শীতকাল আমার পছন্দের ঋতু। ছোটবেলায় শীত আসার অপেক্ষা করতাম। কারণ হল শীত এলে মোয়া, খেজুর রস, পায়েস খাওয়া যাবে। মিঠাই মোয়া দুটি তিনটি করে কত কিনে খেয়েছি। শীত পড়লে দোকানদাররা কাঁধে করে মোয়া নিয়ে আসত। পুরানো জিনিসপত্র নিয়ে মোয়া বিক্রি করত। আমরা বইখাতা বিক্রি করে মোয়া,৷ , কিনতাম। সেই মোয়া মুড়ির স্বাদ আমি এখন আর পাই না।

শীতের দিন গোছল করতে চাইতাম না। দুই-একদিন পর গোছল করতাম। অনেকসময় মা-বাবা জোর করে গোছল করাতেন। পুকুর পানি থাকত বরফের মত। কোনভাবে দু-তিনটা ডুব দিয়ে উঠতাম। ততক্ষণে শীতে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যেত। জামা-কাপড় পরে রোদ পোহাতে দাঁড়াতাম। গোছল নিয়ে কত ঘটনা আছে তার শেষ নেই। খেজুরের পায়েসের কথা ভুলবার নয়। শীতের সকালে গরম গরম খেজুরের পায়েস খাওয়া কত সুস্বাদু তা বলে বুঝানো যাবে না। খেজুর রসের জন্য গাছ কাটা হলে আমরা নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। গাছিরা লম্বা চেনি নিয়ে গাছের ডগায় দাঁড়িয়ে গাছ কাটতেন। তারপর মুখে চোঙ্গা বসিয়ে দিতেন। চোঙ্গার দুই পাশে দুটি হুঁকের মত থাকত। এতে হাঁড়ি ঝোলানো হত। বিকেলে খেজুর গাছে হাঁড়ি ঝোলানো হত। টুপটুপ করে হাঁড়িতে রস পড়ত। সকাল হলে দেখা যেত রসে হাঁড়ি ভর্তি হয়ে আছে। সৌদিতে থেকে যদি শুনি দেশে শীত পড়ছে, আমার পায়েসের কথা মনে পড়ে যায়। অবশ্য আগের মত খেজুর গাছ এখন নাই। নেই রসও। মোয়া নিয়ে দোকানিরা আর আসে না।

শীতের সন্ধ্যায় খড়, লাঠিসোটা জোগাড় করে আগুন জ্বালাতাম। লাঠি না পেলে পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল পোড়াতাম। আগুন জ্বালানো হলে সবাই আগুন পোহাতাম। অনেক সময় বড় ভাই, চাচারা আগুন পোহাতে আসতেন। কেউ কেউ আগুন জ্বালানোর জন্য বকতেন। তাদের আশঙ্কা, আমরা আগুন না নিভালে ঘরবাড়িতে আগুন লাগতে পারে। অবশ্য এমন কখনোই হয়নি।

শীতকালে সবচেয়ে নিরাপদ স্থানের নাম বিছানা। লেপ মুড়ি দিয়ে একটু রাত হলেই শুয়ে পড়া। এরপরে যতকিছুই হোক শীতের ভয়ে উঠতে চাইতাম না। এমনকি মাঝে মাঝে লেপ থেকে উঠার ভয়ে রাতে খেতাম না। ঘুমানোর সময় তাড়াতাড়ি হলেও উঠতাম দেরিতে। কারণ সকালে শীত বেশি থাকে। অনেক বকা খেয়েছি এ নিয়ে। ঘুম থেকে উঠে সোজা আগুন পোহাতাম, না হয় রোদে বসতাম। শীতের রোদ অনেক মজার। গ্রামের ক্ষেতে সরষা ফুল ফুটে থাকত। বন্ধুরা মিলে চুরি করে সরষা ফুল ছিঁড়তাম।

শীতের কুয়াশা আর শিশির এখনো চোখে ভাসে। প্রবাসে এই দৃশ্য নেই। কুয়াশায় পথঘাট সব ঢাকা। ঘাসের উপর শিশির বিন্দু টলমল করে। এমন দিনে সবাই চাদর মুড়ি দিয়ে চলাচল করত। দোকানে বয়স্করা আড্ডা দিত। বুট-মুড়ি-চা-মোয়া খেতে খেতে তারা গল্প করত। আমরা ছোট বলে সবসময় দোকানে যেতে পারতাম না। দূর থেকে দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনতাম। বাবা-চাচারা থাকলে আমাদের ডেকে চকলেট বা বিস্কুট কিনে দিত।

আরেকটা স্মৃতি না বললে হবে না। শীতের প্রধান আকর্ষণ ভাঁপা পিঠা। চাল গুড়ি করে তাতে মিঠাই নারকেল মিলিয়ে বানানো হত ভাঁপা পিঠা। পিঠা বানালে ওইসময় পাড়াপ্রতিবেশিদের দিতে হত। আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠানো হত। গরম গরম ভাঁপা পিঠা কত খেয়েছি। অনেক সময় বন্ধুদের জন্য পিঠা নিয়ে যেতাম। বন্ধুরাও নিয়ে আসত আমার জন্য। খেলার মাঠে বা পুকুরের পড়ে গল্প করতে করতে আমরা ভাঁপা পিঠা খেতাম। এই সব স্মৃতি ভোলা যায় না। শীত এলে প্রতিবার স্মৃতিপটে ছেলেবেলার দিনগুলি ভেসে উঠে। ছোটবেলার শীতকালকে খুব মিস করি।

লেখক পরিচিতি – সৌদি  প্রবাসী সাংবাদিক ও নাট্যকার, কবি, লেখক।
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি -রিয়াদ বাংলাদেশ থিয়েটার।

নামঃ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম হৃদয়
মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ অফিসার, পাবলিক রিলেশন অফিসার, ঢাকা মেডিকেল সেন্টার, বাথা, রিয়াদ, সৌদি আরব।
মোবাইল নাম্বার -০০৯৬৬৫৩৩৯৪৫৮৯৮
E-mail-jahangirridoy2@gmail.com

দেশের বাড়ি- গ্রাম কৃষ্ণপুর পাটওয়ারী বাড়ি, পৌর ১১ নং ওয়ার্ড, শাহরাস্তি, চাঁদপুর।

Tag :
সর্বাধিক পঠিত

ভারতে মসজিদের স্থানে মন্দির দাবি করে জরিপের চেস্টায় উত্তেজনা, পুলিশের গুলিতে ৩ মুসল্লি নিহত (ভিডিওসহ)

ছেলে বেলার শীতকাল

আপডেট: ০২:৫০:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

মোঃ জাহাঙ্গীর আলম হৃদয়

ছোটবেলায় বইতে পড়েছি বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। এখন আমার মনে হয়, ঋতু মূলত তিনটি আছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। বাকি ঋতুগুলি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে। শীতকাল আমার পছন্দের ঋতু। ছোটবেলায় শীত আসার অপেক্ষা করতাম। কারণ হল শীত এলে মোয়া, খেজুর রস, পায়েস খাওয়া যাবে। মিঠাই মোয়া দুটি তিনটি করে কত কিনে খেয়েছি। শীত পড়লে দোকানদাররা কাঁধে করে মোয়া নিয়ে আসত। পুরানো জিনিসপত্র নিয়ে মোয়া বিক্রি করত। আমরা বইখাতা বিক্রি করে মোয়া,৷ , কিনতাম। সেই মোয়া মুড়ির স্বাদ আমি এখন আর পাই না।

শীতের দিন গোছল করতে চাইতাম না। দুই-একদিন পর গোছল করতাম। অনেকসময় মা-বাবা জোর করে গোছল করাতেন। পুকুর পানি থাকত বরফের মত। কোনভাবে দু-তিনটা ডুব দিয়ে উঠতাম। ততক্ষণে শীতে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যেত। জামা-কাপড় পরে রোদ পোহাতে দাঁড়াতাম। গোছল নিয়ে কত ঘটনা আছে তার শেষ নেই। খেজুরের পায়েসের কথা ভুলবার নয়। শীতের সকালে গরম গরম খেজুরের পায়েস খাওয়া কত সুস্বাদু তা বলে বুঝানো যাবে না। খেজুর রসের জন্য গাছ কাটা হলে আমরা নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। গাছিরা লম্বা চেনি নিয়ে গাছের ডগায় দাঁড়িয়ে গাছ কাটতেন। তারপর মুখে চোঙ্গা বসিয়ে দিতেন। চোঙ্গার দুই পাশে দুটি হুঁকের মত থাকত। এতে হাঁড়ি ঝোলানো হত। বিকেলে খেজুর গাছে হাঁড়ি ঝোলানো হত। টুপটুপ করে হাঁড়িতে রস পড়ত। সকাল হলে দেখা যেত রসে হাঁড়ি ভর্তি হয়ে আছে। সৌদিতে থেকে যদি শুনি দেশে শীত পড়ছে, আমার পায়েসের কথা মনে পড়ে যায়। অবশ্য আগের মত খেজুর গাছ এখন নাই। নেই রসও। মোয়া নিয়ে দোকানিরা আর আসে না।

শীতের সন্ধ্যায় খড়, লাঠিসোটা জোগাড় করে আগুন জ্বালাতাম। লাঠি না পেলে পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল পোড়াতাম। আগুন জ্বালানো হলে সবাই আগুন পোহাতাম। অনেক সময় বড় ভাই, চাচারা আগুন পোহাতে আসতেন। কেউ কেউ আগুন জ্বালানোর জন্য বকতেন। তাদের আশঙ্কা, আমরা আগুন না নিভালে ঘরবাড়িতে আগুন লাগতে পারে। অবশ্য এমন কখনোই হয়নি।

শীতকালে সবচেয়ে নিরাপদ স্থানের নাম বিছানা। লেপ মুড়ি দিয়ে একটু রাত হলেই শুয়ে পড়া। এরপরে যতকিছুই হোক শীতের ভয়ে উঠতে চাইতাম না। এমনকি মাঝে মাঝে লেপ থেকে উঠার ভয়ে রাতে খেতাম না। ঘুমানোর সময় তাড়াতাড়ি হলেও উঠতাম দেরিতে। কারণ সকালে শীত বেশি থাকে। অনেক বকা খেয়েছি এ নিয়ে। ঘুম থেকে উঠে সোজা আগুন পোহাতাম, না হয় রোদে বসতাম। শীতের রোদ অনেক মজার। গ্রামের ক্ষেতে সরষা ফুল ফুটে থাকত। বন্ধুরা মিলে চুরি করে সরষা ফুল ছিঁড়তাম।

শীতের কুয়াশা আর শিশির এখনো চোখে ভাসে। প্রবাসে এই দৃশ্য নেই। কুয়াশায় পথঘাট সব ঢাকা। ঘাসের উপর শিশির বিন্দু টলমল করে। এমন দিনে সবাই চাদর মুড়ি দিয়ে চলাচল করত। দোকানে বয়স্করা আড্ডা দিত। বুট-মুড়ি-চা-মোয়া খেতে খেতে তারা গল্প করত। আমরা ছোট বলে সবসময় দোকানে যেতে পারতাম না। দূর থেকে দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনতাম। বাবা-চাচারা থাকলে আমাদের ডেকে চকলেট বা বিস্কুট কিনে দিত।

আরেকটা স্মৃতি না বললে হবে না। শীতের প্রধান আকর্ষণ ভাঁপা পিঠা। চাল গুড়ি করে তাতে মিঠাই নারকেল মিলিয়ে বানানো হত ভাঁপা পিঠা। পিঠা বানালে ওইসময় পাড়াপ্রতিবেশিদের দিতে হত। আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠানো হত। গরম গরম ভাঁপা পিঠা কত খেয়েছি। অনেক সময় বন্ধুদের জন্য পিঠা নিয়ে যেতাম। বন্ধুরাও নিয়ে আসত আমার জন্য। খেলার মাঠে বা পুকুরের পড়ে গল্প করতে করতে আমরা ভাঁপা পিঠা খেতাম। এই সব স্মৃতি ভোলা যায় না। শীত এলে প্রতিবার স্মৃতিপটে ছেলেবেলার দিনগুলি ভেসে উঠে। ছোটবেলার শীতকালকে খুব মিস করি।

লেখক পরিচিতি – সৌদি  প্রবাসী সাংবাদিক ও নাট্যকার, কবি, লেখক।
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি -রিয়াদ বাংলাদেশ থিয়েটার।

নামঃ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম হৃদয়
মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ অফিসার, পাবলিক রিলেশন অফিসার, ঢাকা মেডিকেল সেন্টার, বাথা, রিয়াদ, সৌদি আরব।
মোবাইল নাম্বার -০০৯৬৬৫৩৩৯৪৫৮৯৮
E-mail-jahangirridoy2@gmail.com

দেশের বাড়ি- গ্রাম কৃষ্ণপুর পাটওয়ারী বাড়ি, পৌর ১১ নং ওয়ার্ড, শাহরাস্তি, চাঁদপুর।