সীমান্ত দিয়ে এখনো দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা, এগিয়ে বিত্তশালীরা

ছবি-নতুনেরকথা।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক মাস পরও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য অবৈধভাবে দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। পালাতে গিয়ে সীমান্তে ধরাও পড়েছেন কেউ কেউ। সীমান্ত পার হতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এ নিয়ে প্রথম আলো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

ইতিমধ্যে দেশ ত্যাগ করেছেন এমন বেশ কয়েকজনের পরিবার, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট, আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ (হালুয়াঘাট), যশোর অঞ্চল, লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকাগুলো দিয়ে দেশ ছাড়ার প্রবণতা বেশি। এ জন্য জনপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ২৫-৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় সীমান্তের দুই পাশের দালালদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিপুল অর্থের মালিক আওয়ামী লীগের এমন নেতাদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা বা চেষ্টা বেশি।

প্রতিবেদনে জানা গেছে, গত সপ্তাহে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন। এদের আগে (৫ আগস্টের পর) দেশ ত্যাগ করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল), সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ (নাসিম) ও আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ অনেকে।

যারা পালিয়ে গেছেন বা পালানোর চেষ্টায় আছেন, তাদের প্রায় সবাই হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, সরকার পতনের এত দিন পরও কীভাবে এসব ব্যক্তি দেশ ছেড়ে পালাতে পারছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আরও বেশ কয়েকজন নেতার দেশ ছাড়ার গুঞ্জন রয়েছে। তবে তাদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

শেখ হাসিনার আরেক আত্মীয় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের কিছুদিন আগেই ভারতে চলে যান। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ৩ আগস্ট রাতে পরিবারসহ দেশ ছাড়েন। তিনি ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর যান। তার পরিবার পৃথক ফ্লাইটে যায় লন্ডনে। তাপসের ভাই যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস (পরশ) সরকার পতনের কয়েক দিন আগে, ৩১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরেছিলেন। তিনিও দেশে আছেন বলে জানা গেছে।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও আন্দোলনের সময় সপরিবার সিঙ্গাপুরে চলে যান। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের (বিপু) অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান অবশ্য সরকার পতনের পর শুরুতেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিদেশ যাওয়ার চেষ্টাকালে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদও। মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত মোট ৩০ জন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন।

এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আরও যেসব নেতার দেশত্যাগের খবর পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন (রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র), সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ (জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ) ও শফিউল আলম চৌধুরী (নাদেল), দলের দপ্তর সম্পাদক ও শেখ হাসিনার সাবেক বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ও কার্যনির্বাহী সদস্য নির্মল কুমার চ্যাটার্জি। এ ছাড়া সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও তাঁর মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসিন বাহার এবং ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীও দেশ ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।

এই তালিকায় আরও রয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারোয়ার কবির (ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক), যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন (নিখিল), ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির (শয়ন), ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ, যুবলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জয়দেব নন্দী প্রমুখ।

অবৈধ পথে এভাবে দেশ ছাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী তার মুখপাত্রের মাধ্যমে বলেন, সীমান্তে নজরদারি রয়েছে। সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেই সাবেক সংসদ সদস্য ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিসহ অনেকেই বিভিন্ন সীমান্তে ধরা পড়ছেন। এই তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়েছেন আওয়ামী লীগের এমন অন্তত ১৫ কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের নাম বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। অবৈধ পথে দেশ ছাড়ায় ইমিগ্রেশন বিভাগের নথিতে তাদের দেশত্যাগের তথ্য নেই। এর বাইরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং অন্যান্য সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের মধ্যে অন্তত ২৭ জনের দেশ ছাড়ার খবর জানা গেছে। তবে দেশ ছেড়ে পালানো ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা কয়েক’শ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ ছাড়া বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বিপ্লব কুমার সরকারও ১০ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন বলে খবর বের হয়েছে। এমন আরও অনেকে এভাবে দেশ ছাড়ার চেষ্টায় আছেন বলে জানা গেছে।

ভারতে পালানোর সময় গত ২৩ আগস্ট সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে স্থানীয় লোকজনের হাতে ধরা পড়েন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক)।

২৪ আগস্ট রাতে সিলেটের কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় মারা যান ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান (পান্না)। লাশ উদ্ধারের পর মেঘালয় পুলিশ সূত্র গণমাধ্যমকে বলেছে, গলা টিপে শ্বাসরোধের কারণে ইসহাকের মৃত্যু হয়েছে।

১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তে আটক হন চট্টগ্রামের রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী।

এদিকে পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়া কিংবা ইমিগ্রেশন সম্পন্ন না করে পলাতক ব্যক্তিদের বিষয়ে ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহনশীল আচরণ করছে বলে জানা গেছে। তাদের কারও কারও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসের অনুমতি (পিআর) বা গ্রিন কার্ড রয়েছে। তাদের কেউ কেউ ভারতের ইমিগ্রেশন বিভাগকে ‘ম্যানেজ’ করে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের সদ্য সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এই প্রক্রিয়ায় ভারত থেকে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কেউ কেউ অবৈধ পথে ভারতে গিয়ে দালালের মাধ্যমে পাসপোর্টে বাংলাদেশ থেকে বহির্গমন ও ভারতের প্রবেশের সিল লাগানোর ব্যবস্থা করছেন।

হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামিদেরও সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক নাইম আহমেদ বলেন, যারা ভারতে যাচ্ছেন, তারা তো আগে দেশের ভেতর দিয়েই সীমান্তে যান। তারা কীভাবে সীমান্তে যাচ্ছেন, সেটা জানা জরুরি। পাশাপাশি তল্লাশিচৌকি বসিয়ে নজরদারি জোরদার করতে হবে। এ ছাড়া সীমান্তে মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

সর্বাধিক পঠিত

চাঁদপুর সদরে আওয়ামীপন্থি ৪ ইউপি সদস্য গ্রেফতার

সীমান্ত দিয়ে এখনো দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা, এগিয়ে বিত্তশালীরা

আপডেট: ০২:১৫:১২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক মাস পরও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য অবৈধভাবে দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। পালাতে গিয়ে সীমান্তে ধরাও পড়েছেন কেউ কেউ। সীমান্ত পার হতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এ নিয়ে প্রথম আলো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

ইতিমধ্যে দেশ ত্যাগ করেছেন এমন বেশ কয়েকজনের পরিবার, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট, আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ (হালুয়াঘাট), যশোর অঞ্চল, লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকাগুলো দিয়ে দেশ ছাড়ার প্রবণতা বেশি। এ জন্য জনপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ২৫-৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় সীমান্তের দুই পাশের দালালদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিপুল অর্থের মালিক আওয়ামী লীগের এমন নেতাদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা বা চেষ্টা বেশি।

প্রতিবেদনে জানা গেছে, গত সপ্তাহে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন। এদের আগে (৫ আগস্টের পর) দেশ ত্যাগ করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল), সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ (নাসিম) ও আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ অনেকে।

যারা পালিয়ে গেছেন বা পালানোর চেষ্টায় আছেন, তাদের প্রায় সবাই হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, সরকার পতনের এত দিন পরও কীভাবে এসব ব্যক্তি দেশ ছেড়ে পালাতে পারছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আরও বেশ কয়েকজন নেতার দেশ ছাড়ার গুঞ্জন রয়েছে। তবে তাদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

শেখ হাসিনার আরেক আত্মীয় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের কিছুদিন আগেই ভারতে চলে যান। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ৩ আগস্ট রাতে পরিবারসহ দেশ ছাড়েন। তিনি ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর যান। তার পরিবার পৃথক ফ্লাইটে যায় লন্ডনে। তাপসের ভাই যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস (পরশ) সরকার পতনের কয়েক দিন আগে, ৩১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরেছিলেন। তিনিও দেশে আছেন বলে জানা গেছে।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও আন্দোলনের সময় সপরিবার সিঙ্গাপুরে চলে যান। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের (বিপু) অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান অবশ্য সরকার পতনের পর শুরুতেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিদেশ যাওয়ার চেষ্টাকালে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদও। মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত মোট ৩০ জন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন।

এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আরও যেসব নেতার দেশত্যাগের খবর পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন (রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র), সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ (জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ) ও শফিউল আলম চৌধুরী (নাদেল), দলের দপ্তর সম্পাদক ও শেখ হাসিনার সাবেক বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ও কার্যনির্বাহী সদস্য নির্মল কুমার চ্যাটার্জি। এ ছাড়া সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও তাঁর মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসিন বাহার এবং ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীও দেশ ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।

এই তালিকায় আরও রয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারোয়ার কবির (ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক), যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন (নিখিল), ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির (শয়ন), ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ, যুবলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জয়দেব নন্দী প্রমুখ।

অবৈধ পথে এভাবে দেশ ছাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী তার মুখপাত্রের মাধ্যমে বলেন, সীমান্তে নজরদারি রয়েছে। সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেই সাবেক সংসদ সদস্য ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিসহ অনেকেই বিভিন্ন সীমান্তে ধরা পড়ছেন। এই তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়েছেন আওয়ামী লীগের এমন অন্তত ১৫ কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের নাম বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। অবৈধ পথে দেশ ছাড়ায় ইমিগ্রেশন বিভাগের নথিতে তাদের দেশত্যাগের তথ্য নেই। এর বাইরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং অন্যান্য সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের মধ্যে অন্তত ২৭ জনের দেশ ছাড়ার খবর জানা গেছে। তবে দেশ ছেড়ে পালানো ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা কয়েক’শ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ ছাড়া বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বিপ্লব কুমার সরকারও ১০ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন বলে খবর বের হয়েছে। এমন আরও অনেকে এভাবে দেশ ছাড়ার চেষ্টায় আছেন বলে জানা গেছে।

ভারতে পালানোর সময় গত ২৩ আগস্ট সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে স্থানীয় লোকজনের হাতে ধরা পড়েন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক)।

২৪ আগস্ট রাতে সিলেটের কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় মারা যান ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান (পান্না)। লাশ উদ্ধারের পর মেঘালয় পুলিশ সূত্র গণমাধ্যমকে বলেছে, গলা টিপে শ্বাসরোধের কারণে ইসহাকের মৃত্যু হয়েছে।

১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তে আটক হন চট্টগ্রামের রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী।

এদিকে পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়া কিংবা ইমিগ্রেশন সম্পন্ন না করে পলাতক ব্যক্তিদের বিষয়ে ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সহনশীল আচরণ করছে বলে জানা গেছে। তাদের কারও কারও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসের অনুমতি (পিআর) বা গ্রিন কার্ড রয়েছে। তাদের কেউ কেউ ভারতের ইমিগ্রেশন বিভাগকে ‘ম্যানেজ’ করে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের সদ্য সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এই প্রক্রিয়ায় ভারত থেকে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কেউ কেউ অবৈধ পথে ভারতে গিয়ে দালালের মাধ্যমে পাসপোর্টে বাংলাদেশ থেকে বহির্গমন ও ভারতের প্রবেশের সিল লাগানোর ব্যবস্থা করছেন।

হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামিদেরও সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক নাইম আহমেদ বলেন, যারা ভারতে যাচ্ছেন, তারা তো আগে দেশের ভেতর দিয়েই সীমান্তে যান। তারা কীভাবে সীমান্তে যাচ্ছেন, সেটা জানা জরুরি। পাশাপাশি তল্লাশিচৌকি বসিয়ে নজরদারি জোরদার করতে হবে। এ ছাড়া সীমান্তে মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।