আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
বিয়ের সময় নির্ধারণের বছরখানেক পর আরশি নিসারের বিবাহ পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গেল। অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতের চাপিয়ে দেয়া যোগাযোগ অচলাবস্থা ও ধরপাকড়ে অতিথিদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় এই বাগদত্তাকে তার বিয়ের অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয়েছে।
হিমালয় উপত্যকাটির বাসিন্দারা এখন ব্যাপক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছেন। বিশেষ মেকআপ অনুষ্ঠান ও কনসার্টসহ ৭০০ অতিথি ধরতে পারে এমন শামিয়ানায় ১০ থেকে ১৫ পদের ভোজের আয়োজন করার কথা ছিল তার। কাশ্মীরিদের ঐতিহ্যানুসারে যেটি ওয়াজওয়ান নামে পরিচিত।-খবর এএফপির
হাজার হাজার পরিবারের মতো আরশিও তার বিয়ের অনুষ্ঠান কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছেন। কাজেই ৭০০ থেকে অতিথিদের সংখ্যা নামিয়ে আনা হয়েছে মাত্র ৪০ জনে। যদিও ভয় হয়, এই কয়েকজন অতিথিও ঠিকমতো বিয়েতে হাজির হতে পারবেন কিনা।
২৯ বছর বয়সী এই তরুণী বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, একটি বিশাল বিয়ের অনুষ্ঠানের স্বপ্ন নিয়েই আমি বড় হয়েছিলাম। যেখানে অনেক উৎসব ও আয়োজন থাকবে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তা আর করা হলো না।
তিনি বলেন, এখন আমরা একটা সাধারণ অনুষ্ঠানের আয়োজনের কথা ভাবছি। কিন্তু এই উত্তেজনাময় পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আত্মীয়স্বজনরা চলাচল করতে পারব কিনা, তা নিয়েও আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
আগস্টের শুরুতে কাশ্মীরের সাংবিধানিক বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা কেড়ে নেয় ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার। এর আগে রাজ্যটির ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং স্থানীয় অধিবাসীদের বাইরের বিশ্বের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়।
এর পর সরকারি বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয়দের শত শত সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে শতাধিক লোক আহত হয়েছেন। কাঁটাতারের কুণ্ডলী ও স্টিলের ব্যারিকেড দিয়ে সড়ক অবরুদ্ধ করে রেখেছে সরকারি বাহিনী। একই সময়ে রাস্তায় গাড়ি চলাচলে বাধা দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। এতে অনেকেই ঘর থেকে বের হতে পারেননি।
ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে সশস্ত্র বিদ্রোহ চলছে কাশ্মীরে। আগে থেকেই পাঁচ লাখের অধিক সেনা মোতায়েন করা রয়েছে রাজ্যটিতে। এবার নতুন করে কয়েক হাজার অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
কিন্তু এই সময়ে কাশ্মীরের বিবাহ অনুষ্ঠান কেন্দ্রীক গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক প্রবাহও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার লোক তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান বাতিল করে কৃচ্ছ্রতার পথ অবলম্বন করেছেন।
কাশ্মীরিরা পারিবারিক মর্যাদার ব্যাপারে খুবই সচেতন। আতিথেয়তার জন্যও তাদের খ্যাতি রয়েছে। কাজেই তাদের সম্পদ ও উদারতার পরিচয়ও বহন করে এই বিয়ের অনুষ্ঠানে।
কাশ্মীরের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের অতিথি দেড় হাজারের বেশি থাকে। যাতে খরচ পড়ে ৩০ হাজার ডলারে বেশি।
নামের আদ্যাক্ষরে পরিচিতি পেতে চাওয়া বিলাল নামের এক যুবক বলেন, বিয়েতে নিজেদের মর্যাদাকে জাহির করতে পরিবারগুলো বছরের পর বছর কিংবা দশক ধরেও অর্থ জমাতে থাকে। জন্মের পরেই সন্তানদের বিয়ের প্রস্তুতি নেন বাবা-মা।
চলতি মাসে তার ভাইয়ের বিয়েতে মাত্র ১৫ শতাংশ অতিথি অংশ নিতে পেরেছিলেন, যা তার পরিবারের জন্য খুবই হতাশার ঘটনা।
অন্যান্য যারা বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, অচলাবস্থার দরুন সরবরাহকারী ও অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করতে পারেননি।
বোন তাহমিনার বিয়ের কয়েক দিন আগে বিয়ের খাটসহ সোনা-গহনা ও পোশাক সংগ্রহে খাবি খেতে হয়েছে মোন্তাজিরকে।
৪১ বছর বয়সী এই কাশ্মীরি বলেন, আমি একটি খাট ও বিয়ের পোশাকের ফরমাশ করেছি। কিন্তু দুটি দোকানই এখন বন্ধ। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো সুযোগ নেই।
এমনকি পাচক ও কসাইকেও পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, বিয়ের অনুষ্ঠান জীবনভর স্মরণ করে রাখতে চায় সবাই। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী আয়োজনগুলো বাদ দিয়ে বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান করতে বাধ্য হওয়ায় খুব অসহায় বোধ করছি।
আরশি নিসারও দুঃখভরা কণ্ঠে সেই কথাই বলছিলেন, কাশ্মীরে কোনো স্বপ্ন থাকতে নেই। (বিবিসি)