আশিক বিন রহিম ॥
চাঁদপুর হাইমচর উপজেলার আলোচিত শিশু শিক্ষার্থী মারজানা আক্তার (৯) হত্যার দুই বছর আজ। ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর স্থানীয় ৩ বখাটে কতৃক ধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে খুন করা হয় শিশু মারজানাকে। আলোচিত এই ঘটনাটি দীর্ঘ দুই বছর পেড়িয়ে গেলেও অভিযুক্ত পালাতক আসামীদের কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার ১০ মাসে আসামী আটক কিংবা হত্যার রহস্য উদ্ধারে ব্যর্থ হাইমচর থানা পুলিশের কাছ থেকে মামলার তদন্তভার দেয়া হয় জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে। কিন্তু জেলার বহু খুনের রহস্য উদঘাটন ও আসামী আটকে সফল চাঁদপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ এখানে যেনো ব্যর্থতার পরিচয় রাখছে। ১৪ মাসেও তারা কোনো আসামী আটক করতে পারেনি। মাঝে ঘটনার এক বছর পর সন্দেহভাজন এক আসমী আওলাদ (২১) আটক করলেও আইনের ফাঁক গলে জামিনে ছাড়া পেয়ে এলাকায় বুক ফুলিয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে সে। এ অবস্থায় প্রিয় শিশু সন্তানের শোকে পাগলপ্রায় তাঁর মা সেলিনা বেগম অসুস্থতায় মৃত্যুর পহর গুনছে। আর প্রাণ বাহারো হুমকি পেয়েও মেয়ে হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসহায় পিতা মো. মোকশেদ হাওলাদার। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামীম হোসেন এই প্রতিবেদককে জানান, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এবং অভিযুক্ত আসামীদের আটক করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে মারজানার পিতা মোকশেদ হাওলাদার এবং মা সেলিনা বেগম এখন অনেকটাই পাগল প্রায়।
মামলার ও ঘটনার বিবরণে জানা যায়, হাইমচর উপজেলার ৪নং নীল কমল ইউনিয়েনর প্রত্যন্ত ও দূর্গম চর এলাকা ইশানবালা বাজার। মেঘনার পশ্চিম পারের নদী বেষ্টিত এই গ্রামের খলিল মাতাব্বর কান্দির এক হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে মারজানা আক্তার (৯)। স্থানীয় ৩২নং চর কোড়ালিয়া সপ্রাবি’র তৃতীয় শ্রেনীর ছাত্রী ছিলো সে। মাত্র ৯ বছরে পা রাখা শিশুটির উপর কুদৃষ্টি পরে স্থানীয় কিছু বখাটে যুবকের। বিষয়টি অসহায় বাবা মা জানলেও সাহস করে প্রতিবাদ করেনি। ফলশ্রুতিতে ২০১৭ সনের ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পিতার দোকান থেকে ফেরার সময় ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয় মারজানাকে। এই ঘটনায় ১৯ জানুয়ারী মোকশেদ হাওলাদার বাদী হয়ে স্থানীয় বখাটে তিন যুবককে আসামী করে হাইমচর জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং জিআর ০৪/১৮। ধারা ৩০২/৩৭৬/২০১/৩৪ ও ১০৯। আসামীরা হলো, ওই গ্রামের সুরুজ কান্দী এলাকার দ্বীন ইসলামের ছেলে জালাল মিয়া (২০), কাদির বেপারীর ছেলে সিদ্দিক (২১) এবং মো. সফি উল্যাহর ছেলে সেলিম (২১)। এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলে, ওই মামলার সূত্র ধরেই হত্যার রহস্য উৎঘাটনে ২৫ জানুয়ারী, আদালত কতৃক লাশ উত্তলন করে ময়না তদন্তের নির্দেশ দেয়। পৌনে দুই মাস পর ১২ ফেব্রুয়ারী নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটে উম্মে হাবিবা মীরা হাইমচর থানা পুলিশের উপস্থিতে কবর থেকে মারজানার লাল উত্তোলন তদন্ত করে। এরপর চাঁদপুরে মর্গে এনে ৩ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল টিম গঠনের মাধ্যমে ময়নাতদন্ত শেষে ওই রাতে পূনরায় লাস দাফন করা হয়।
মারজানার মা সেলিনা বেগম জানায়, ঘটনার দিন সন্ধ্যার আগে সদাইয়ের জন্যে ব্যাগ হাতে মেয়েকে বাবার দোকানে পাঠায়। এরপর রাত ৮টায় মারজানার পিতার মোকশেদ বাসায় ফিরলে মেয়ের না ফেরার কথা জানতে পারেন। পরে দুজনে মিলে মেয়েকে খুঁজতে গেলে বাদীর বাড়ি রাস্তার মাঝখানে একটি বাঁশঝাড়ে বিলের পাড়ে মেয়ের লাশ দেখতে পান।
মারজানার পিতা মো. মোকশেদ হাওলাদার জানান, খবর পেয় হাইমচর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে আসে এবং একটি টর্চ লাইট উদ্ধার করে। কিন্তু স্থানীয় কিছু মানুষের পরামর্শে মেয়েকে ভূতে মেরেছে বলে ময়না তদন্ত ছাড়াই আমরা পুলিশের অনুমতি নিয়ে লাস দফন করেছি। কিন্তু একদিন পরে যে মহিলা লাস গোসল দিয়েছিলো তিনি জানান, লাসের গোপনাঙ্গসহ বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখেছন তিনি। স্ত্রী সেলিনা বেগমও জানায়, মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে প্রতিবেশী এক যুবককে দৌড়ে পালাতে দেখেছেন তিনি। এভাবেই বেরিয়ে আসে একের পর এক তথ্য। এরপর আমরা পূনরায় সেই বিল ও বাঁশ ঝাড়ের কাছে ছুটে যাই। সেখানে পাশেই স্থানীয় সেলিম সর্দারের পরিত্যাক্ত একটি ঘরের মাটিতে রক্ত এবং বাঁশঝাড়ে মারজানার হাতের বাজারের ব্যাগটি দেখতে পাই। যখন মারজানার লাশ পাওয়া যায় তখন তার গায়ের কামিজটি উল্টানো ছিলো, এবং নাকে-মুখে এবং চোখে জখমের চিহ্ন ছিলো। তারপরে আমরা নিশ্চিত হলাম আমার মেয়েকে খারাপ কাজ করে হত্যা করা হয়েছে।
মো. মোকশেদ আরো জানায়, যাদের আসামী করা হয়েছে তারা প্রায় স্কুলে যাওয়ার সময় মারজানাসহ অন্যান্য স্কুল ছাত্রীদের প্রায় উক্তত্ত করতো। আদালতে মামলা করার পর থেকে আসামীদের পরিবারের পক্ষ থেকে নানানভাবে আমাকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে এবং আপোশ করারও প্রস্তাব দিচ্ছে। এই ঘটনার কয়েক মাস পরে গত মে মাসে হাইমচর থানা পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহভাজন হিসেবে আওলাদ (২১) নামে একজনকে আটক করে। পরবর্তিতে আদালত তাকে তিন দিনের রিমান্ড দেয়। কিন্তু টাকার জোড়ে আওলাদ জামিনে বেরিয়ে যায়। এ বিষয়ে আমি সাবেক পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার এবং বর্তমান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান স্যারের সাথেও দেখা করেছি। আমাদের দেশ এতো উন্নত হয়েছে অথচ পুলিশ তিনজন আসামীর একজনকে অটক করতে পারেনি। আর কতদিন অপেক্ষা করলে আমি আমার মেয়ের হত্যার বিচার পাবো।
উল্লেখ: গত বছরের ১৮ জুলাই চাঁদপুরের সাবেক পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার পিপিএম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং মারজানার পরিবার ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলেন। পুলিশ সুপার জানিয়েছিলেন অপরাধি যে হোক না কেনো দোষী প্রমানিত হলে তাদের শাস্তি পেতে হবেই।