ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির আদর্শ সঙ্গী। ব্যবস্থাপক হিসেবে সাদামাটা, কথাবার্তায় দ্যুতিহীন ও নিষ্ঠুর চরিত্রের ইব্রাহিম রাইসি খুব দ্রুতই খামেনির অনুগত হয়ে উঠেছিলেন। খামেনির বয়স এখন ৮৫ বছর, উত্তরাধিকার মনোনীত করে যাওয়া এখন তাঁর পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রোববার হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে রাইসির মৃত্যু সেই পরিকল্পনায় বড় একটা ধাক্কা লাগল। ইরানের রাজনীতির অন্দরমহলেও বড় একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল। এতে তরুণ ও আরও কট্টর প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের আরও ক্ষমতাবান হওয়ার সুযোগ তৈরি হলো, যাঁরা দেশের ভেতরে নিপীড়নের জোয়াল আরও শক্ত করতে পারেন আর বিদেশে আরও আগ্রাসী ভূমিকা নিতে পারেন।
ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন শক্ত মতাদর্শের একজন বিপ্লবী। একেবারে শুরুর দিকে বিচারসংক্রান্ত নানা কর্মকাণ্ডে তিনি যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৮ সালে রাইসি ইরানের তথাকথিত মৃত্যু কমিশনের সদস্য হন। এ কমিশনের বিরুদ্ধে ৫ হাজারের বেশি রাজনৈতিক বন্দীর মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এরপর তাঁর ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় কেটেছে ইরানি শাসকদের অন্ধকার অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত থেকে। একপর্যায়ে তিনি বিচার বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এতটা অভিজ্ঞতা ও আনুগত্য থাকার পরও রাইসি খামেনির কাছে পছন্দের উত্তরাধিকারী ছিলেন কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষক ও ইরানিদের মধ্যে সংশয় ছিল। জনগণের বিশাল অংশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন বিরূপ, তখন ইরানে সরকার পরিচালনা করাটা একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। সেই চ্যালেঞ্জ উতরে যেতে হলে, অস্বাভাবিক রকমের ধূর্ততা, বুদ্ধিমত্তা ও নিষ্ঠুরতা থাকতে হয়। ইব্রাহিম রাইসির মধ্যে শুধু শেষেরটাই ছিল।
খামেনিকে এখন তাঁর মতাদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নির্ভরশীল কাউকে খুঁজে বের করতে হবে এবং কল্পিত একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতায় বসাতে হবে। কিন্তু সেটা করা খুব সহজ হবে না। কারণ, ইরানে বিপ্লবের মাধ্যমে যাঁরা রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এমন শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত হয়েছে যে পুরোনো প্রজন্মের বিপ্লবীদের মধ্যে এখন খুব কমসংখ্যকই অবশিষ্ট আছেন।
ইরানের নতুন যে রাজনৈতিক পটভূমি, সেখানে আধিপত্য করছেন অপেক্ষাকৃত তরুণেরা। তাঁরা খোলাখুলিভাবে আগের প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি, বিপ্লবপনার ঘাটতি এবং ক্ষয়িষ্ণু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে না পারার ব্যর্থতাকে সমালোচনা করেন। এ কারণেই বিপ্লবী মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখতে এবং ধর্মভিত্তিক শাসনকে অক্ষত রাখতে হলে খামেনিকে এই তরুণ প্রজন্মের ওপর অবশ্যই নির্ভর করতে হবে।
নতুন দলটি বেশ কয়েকটি জনবিদ্রোহের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। এদের অনেকে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোয় ও রেভল্যুশনারি গার্ডের সদস্য। অতিকট্টরপন্থী পায়দারি পার্টির ভেতরেও তারা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। দলটি এখন ইরানের পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদের মধ্যে সবচেয়ে জোরালো কণ্ঠস্বর হলেন দলটির অন্যতম নেতা মুরতাদা আকা-তেহরানি ও রাইসি সরকারের সড়ক ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী মেহরদাদ বজরপাস। তাঁরা সাইদ জালিলির মতো প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীর পক্ষে থাকবেন। সাইদ জালিলি ইরানের হয়ে পরমাণু চুক্তিসংক্রান্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহির প্রতি তিনি অবজ্ঞা দেখিয়ে আসছেন।
ইরানের সীমানার বাইরের ব্যাপারে রাইসির বক্তব্য ছিল কম। যদিও রাইসি ইরানের সাম্রাজ্যবাদী অভিযান ও ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাতে সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু খামেনির তরুণতর অনুসারীরা এমন এক যুগে রাজনীতিতে এসেছেন, যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাচ্ছে এবং কথিত অনন্ত যুদ্ধ থেকে ওয়াশিংটন বেরিয়ে আসছে। আগের প্রজন্ম ‘পশ্চিমেও নয়, পুবেও নয়’, এমন নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের জোট গড়ে তোলার পক্ষে।
রাইসির মৃত্যুতে এই তরুণতর প্রজন্মের প্রভাব বাড়বে। তাতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির হিসাব-নিকাশেও বড় পরিবর্তন আসতে পারে। পরমাণু অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষার ক্ষেত্রে খামেনির যে সাবধানী নীতি, সেটা বদলে যেতে পারে। আবার আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারে ইরান এখন যে বহুজাতিক প্রক্সি বাহিনীগুলোকে লালন-পালন করছে, সেই নীতি প্রায় অপরিবর্তিত থেকে যেতে পারে।
খামেনির উত্তরসূরি কে হচ্ছেন, সেটি এখন ইরানের সামনে সবচেয়ে বড় ইস্যু। অনেকে বলতে চান, মোজতবাই তাঁর বাবার উত্তরাধিকার হবেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পদে বসার ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হচ্ছে নেতৃত্বের ক্যারিশমা ও ধর্মে অগাধ পাণ্ডিত্য থাকা। কিন্তু ইরান রাজবংশীয় উত্তরাধিকারের পক্ষে নয়। সে ক্ষেত্রে মোজতবাইকে পর্দার পেছন থেকেই তাঁর ভূমিকা পালন করতে হবে। এর মানে হচ্ছে, অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্টের সদস্য আয়াতুল্লাহ আহমদ খাতামির মতো কট্টরপন্থীদের মধ্যে কেউ ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা মনোনীত হতে পারেন।
এসব ভবিষ্যদ্বাণীই ইরানের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য ভালো কোনো সংবাদ নয়। আগের প্রজন্ম তাদের বিপ্লবের সফলতা ধরে রাখার অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেশের ভেতরে নিপীড়ন আর বাইরের দেশে আগ্রাসনের পথ বেছে নিয়েছিল। কিন্তু প্রকাশ্যে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা যাঁরা প্রকাশ করছেন, এমন মানুষের প্রতি রাইসির প্রজন্মের চেয়ে নতুন প্রজন্ম আরও বেশি কঠোর।
রাইসির মৃত্যু তরুণ প্রজন্মের সামনে অবশেষে নিজেদের দিন আনার সুযোগ করে দিল।
● রুল মার্ক গ্যারেচ ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের রেসিডেন্ট স্কলার
● রে টেকে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের সিনিয়র ফেলো
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত