• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০ নভেম্বর, ২০১৯
সর্বশেষ আপডেট : ১০ নভেম্বর, ২০১৯

বাংলাদেশের অতিবিপন্ন বন্যপ্রাণী; বনরুই

অনলাইন ডেস্ক
[sharethis-inline-buttons]

অনলাইন ডেস্ক:

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অনেক রকম বন্য প্রাণীর বসবাস। সেদিন ক্যাম্পাস হতে বনরুই বা প্যাঙ্গোলিনের দেখা পাই।বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনোরম ও নিরীহ এই প্রাণী টি আজ অতি সংকটময় দশায় (Critically Endangered) টিকে আছে। [IUCN report 2015]

প্যাঙ্গোলিন ম্যানিডি (Manidae) পরিবারভুক্ত একটি স্তন্যপায়ী মেরুদণ্ডী প্রাণী। যদিও পূর্বে এদেরকে দাঁতহীন স্তন্যপায়ী দের অন্তর্ভুক্ত করা হত। কিন্তু কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্যের জন্য এদের কে বর্তমানে ফোলিডোটা বর্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার একমাত্র সদস্য এই বনরুই।

বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাসঃ-

Kingdom: Animalia

Phylum: Chordata

Class: Mammalia

Order: Pholidota (Weber, 1904)

Family: Manidae (Gray, 1821)

ম্যানিডি পরিবারের তিন টি গণ রয়েছে। এরা হলো:-

১.Manis -যার অন্তর্ভুক্ত প্রজাতি সংখ্যা চার টি। যাদের বসবাস এশিয়া মহাদেশে।

২. Phataginus– যার অন্তর্ভুক্ত প্রজাতি সংখ্যা দুইটি। এদের বসবাস আফ্রিকায়। এবং

৩. Smutsia– যার অন্তর্ভুক্ত প্রজাতি সংখ্যা দুইটি এবং এরাও আফ্রিকায় বসবাস করে।

এশিয়া মহাদেশে বসবাসরত Manis গণের চারটি প্রজাতির মধ্যে তিনটি ই আমাদের দেশে পাওয়া যায়। এরা হলো যথাক্রমে-

১. দেশি বনরুই (Indian Pangolin)- Manis crassicaudata। এদের কে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পাওয়া যায়।

২. চায়না বনরুই (Chinese Pangolin)- Manis pentadactyla। বাংলাদেশের ঠিক কোন কোন স্থানে এদের বিস্তৃতি সে সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

৩. মালয়ী বনরুই (Sunda Pangolin) Manis javanica। এদের কে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়।

আমাদের দেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী আইন ( সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) এর তফসিল-১ অনুযায়ী তিনটি প্রজাতি ই সংরক্ষিত।

বনরুই দের ‘বনরুই ‘ নামকরণ এর পেছনে একটি মজার কারণ রয়েছে। বনের মধ্য দিয়ে আঁইশাকার ও মাছের মত আকৃতির এই প্রাণীটির হেলেদুলে দেহ বাঁকিয়ে চলা অনেক টা রুই মাছের মত দেখতে বলেই এই নামকরণ।

এদের ইংরেজি নাম ‘Pangolin’ এসেছে মালয় ভাষার ‘পেঙ্গুলিং’ শব্দ থেকে যার অর্থ গুটিয়ে নেয়া। বিপদের আভাস পেলে এরা দেহ কে গুটিয়ে নেয় বলে এমন নাম হয়েছে।

দেশী বনরুইঃ- বৈজ্ঞানিক নাম- Manis crassicaudata (Gray, 1827)। এদের মাথা ছোট ও ত্রিকোণাকার।মাথা ও পিঠসহ দেহ প্রায় ১৫-১৮ সারি শক্ত আঁইশে ঢাকা; লেজে রয়েছে প্রায় ১৪-১৬ সারি। পুরুষ বনরুই সাধারণত আকারে স্ত্রীর চেয়ে বড়। (ক)

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত,পাকিস্তান এবং শ্রীলংকায় দেশী বনরুই পাওয়া যায়।

চিত্রঃ- দেশী বনরুই।

চায়না বনরুইঃ- বৈজ্ঞানিক নাম- Manis pentadactyla (Linnaeus , 1758)। এদের মাথা ছোট ও সূচালো এবং মুখ সরু। নাক মাংসল ও এর প্রান্তদেশে নাসারন্ধ্র; জিহ্বা সরু। মাথাসহ দেহের দৈর্ঘ্য ৪৮-৫৮ সেমি, লেজ ২৬-৪০ সেমি ও ওজন ২-৯ কেজি। (ক) মজার ব্যাপার হলো চায়না বনরুই এর লেজ Prehensile অর্থাৎ এরা এদের লেজ দিয়ে বানরের মত গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে ঝুলতে পারে।

বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, ভারত , হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল, মায়ানমার ও চীনে চায়না বনরুই পাওয়া যায়।

চিত্রঃ- চায়না বনরুই।

মালয়ী বনরুইঃ- বৈজ্ঞানিক নাম- Manis javanica (Desmarest, 1822)। এদের দেহে আঁইশ হতে উদ্ভূত লোম রয়েছে। মাথা ছোট চোঙাকার ও চোখ ছোট। চোখ মোটা ‘চোখের পাতা’ দ্বারা রক্ষিত। প্রাপ্তবয়স্ক এই প্রজাতির বনরুইয়ের মাথাসহ দেহের দৈর্ঘ্য ৫০-৬০ সেমি এবং লেজ ৫০-৮০ সেমি। লেজসহকারে আঁইশ দৈর্ঘ্যে ৭৯-৮৮ সেমি। আদর্শগতভাবে পুরুষ বনরুই আকারে স্ত্রীর চেয়ে বড়। (ক)

বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা থাইল্যান্ড ,ইন্দোনেশিয়া ( জাভা, সুমাত্রা , বোর্নিও, এবং সুন্দা দ্বীপপুঞ্জ), ভিয়েতনাম ,লাওস ,কম্বোডিয়া , মালয়েশিয়া , এবং সিঙ্গাপুরে মালয়ী বনরুই দেখা যায়।

চিত্রঃ- মালয়ী বনরুই।

বনরুই রা মূলত নিশাচর প্রাণি এবং দিনের বেলায় দেহ গুটিয়ে গোল বলের মত বানিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। পিঁপড়া এবং উইঁপোকা (Termites) এদের প্রধান খাবার। তবে এরা বিভিন্ন পোকামাকড় ও এদের লার্ভা ও খেতে পারে। এদের লম্বা জিহ্বা দিয়ে পিঁপড়া ধরে খায়। প্রায়শ ই দেখা যায় এদের কে পিঁপড়ার বাসা বা উঁই এর ঢিবি খুঁড়ে পিঁপড়া ও উঁইপোকা খেতে।এদের দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তি অতি কম হলেও ঘ্রাণশক্তি বেশ প্রবল। দৈনিক এরা ১৪০-২০০ গ্রাম পোকামাকড় খেয়ে থাকে।

বনরুইয়ের দেহ কেরাটিন নির্মিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের হাতের নখ ও এই একই পদার্থে গঠিত। শত্রুর আক্রমণে এরা দেহ বাঁকিয়ে গোল বলের মত করে তোলে এবং এদের শক্ত ও ধারালো আঁইশ এর দেহ ঢাল বা Armour এর মত কাজ করে। মলদ্বারের নিকটবর্তী একটি গ্রন্থি হতে এরা বিকট অস্বাস্থ্যকর গন্ধযুক্ত রাসায়নিক নির্গত করতে পারে (noxious-smelling chemical)।

এদের মুখে দাঁত নেই। যার দরুন এরা খাবার চিবাতে পারে না। এরা খাবার খাওয়ার সময় ছোটছোট পাথর বা নুড়ির টুকরা গ্রহণ করে যা এদের পাকস্থলী তে খাবার পিষতে সহায়তা করে। তাছাড়াও এদের পাকস্থলীর গিজার্ডে বিদ্যমান কেরাটিনময় স্পাইন খাবার পেষণ ও হজমে সহায়তা করে।

বনরুইদের লালা আঁঠালো। ফলে খুব সহজেই পিঁপড়া বা অন্যান্য খাবার লম্বা জিহ্বা দিয়ে ধরার সময় আটকে যায়।

এদের চার টি নখরযুক্ত পা এর মধ্যে সম্মুখ পা দু’টির শক্ত পোক্ত গড়ন মাটি খুড়ে খাবার বের করার জন্য সহায়ক।

এরা একাকী বসবাস করলেও সঙ্গমের জন্য একত্রিত হয়। স্ত্রী অপেক্ষা ৪০ শতাংশ বেশী ভারী পুরুষ রা তাদের বসতির আশপাশে প্রস্রাব কিংবা মল ত্যাগ করে রাখে যার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে স্ত্রী বনরুই রা এসে মিলিত হয়।

বছরে মূলত একবার গ্রীষ্মকাল কিংবা শরৎকালে এরা প্রজনন করে থাকে। প্রজাতিভেদে গর্ভের সময় বিভিন্ন (প্রায় ৭০-১৪০ দিন)। এই গর্ভকাল শেষে এরা ১-৩ টি বাচ্চা প্রসব করে। জন্মের সময় বাচ্চাদের গায়ের আঁইশ গুলো নরম ও সাদা থাকে। ধীরে ধীরে শক্ত হয়। মা বনরুই গর্ত খুঁড়ে বাচ্চাদের কে গর্তে লালনপালন করে। বিপদের আঁচ পেলে মা তার বাচ্চাদের কে আগলে রাখে পরম যত্নে। প্রথম ২-৪ সপ্তাহ বাচ্চা রা গর্তেই থাকে।

এক মাস বয়সে বাচ্চা মায়ের পিঠে চেপে গর্ত হতে বেরিয়ে আসে। তিন মাসে এরা আস্তে আস্তে স্তন পান ছেড়ে দিয়ে পোকামাকড় খাওয়া আরম্ভ করে। প্রায় ২ বছর বয়সে এরা পরিপূর্ণ ও প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে।

কিন্তু আফসোসের বিষয় এই সুন্দর প্রাণী টিও আজ আমাদের দেশে সংকটময় দশায় টিকে আছে। মাংস ও চামড়ার জন্য হত্যা, অবৈধ পাচার, বন জঙ্গল উজাড় করে আমরা মানুষ ই এদের কে এহেন বিপদ সংকুল দশায় ফেলে দিয়েছি।

পার্বত্য এলাকায় ‘পাতালপুরীর মাছ’ নামে পরিচিত ২-১০ কে.জি. ওজনের এই প্রাণী টি অনেক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী কর্তৃক হত্যা হয়ে চলছে নানাবিধ কারণে। যেমন টোটকা ওষুধ তৈরি। তাছাড়াও এদেশের নানা স্থানে হার্বাল ওষুধ এর বরাত দিয়ে এদের হত্যা করা হয়।অনেক স্বনামধন্য হার্বাল প্রতিষ্ঠান ও এদের দিয়ে ওষুধ বানানোর জন্য নির্বিচারে বনরুই হত্যা করে চলছে। গণক শ্রেণির মানুষ রাও এদের কে নানারকম টোটকার জন্য হত্যা করে থাকে। প্রাণিবিদ দের মতে বনরুই হতে তৈরি এই ওষুধের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটা মানুষ কে ধোকা দিয়ে মোটা অর্থ হাতানোর ধান্ধা ছাড়া আর কিছুই না।

এছাড়া পাচার তো আছেই। ঘানা সহ নানা দেশে এদের কে অবৈধভাবে পাচার করা হয়। বনরুই এর চামড়া পোষাক তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়।

সবার উচিৎ এই প্রাণীটি রক্ষায় এগিয়ে আসা। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। বন্যপ্রাণী আমাদের দেশের সম্পদ। এদের রক্ষা করা আমাদের পরিবেশের সুশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অতি জরুরি।

রেফারেন্সঃ-

১. ক- জিয়া উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত, বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ, ২৭ খণ্ড, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।

Sharing is caring!

[sharethis-inline-buttons]

আরও পড়ুন

  • বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এর আরও খবর
error: Content is protected !!