তরুণের হাতে সেদিন পতাকা তুলে দিই একটি বার্তা দেওয়ার জন্য

  • আপডেট: ০৫:৪২:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০১৯
  • ৪০

মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম

৯৭১ সালে আমি সেনাবাহিনী থেকে ডেপুটেশনে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) দায়িত্ব পালন করছিলাম। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর আমি বাঙালি সৈন্যদের একত্রিত করতে থাকি। ২৪ মার্চ আমার হেডকোয়ার্টারে জেসিও ইনচার্জকে বললাম, তোমরা বার্তাগুলো সীমান্তে পাঠিয়ে দাও এবং প্রস্তুত হও। এর মধ্যে একটা বার্তা ছিল ‘অ্যারেঞ্জ সাম উড ফর মি’ অর্থাৎ বোঝানো হয়েছে যুদ্ধ শুরুর জন্য প্রস্তুত হও। আধা ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হবে। দ্বিতীয় বার্তা ছিল ‘ব্রিং সাম উড ফর মি’। অর্থ ছিল যুদ্ধ শুরু কর। তোমার এলাকার অবাঙালি সৈন্যদের বোমা দিয়ে ধ্বংস করে শহরে তোমাদের অবস্থান নাও। মেসেজগুলো পাঠিয়ে আমি অপেক্ষা করছিলাম। সীমান্ত থেকে সৈন্যরা এলে আমি শহর দখল করব।

চট্টগ্রাম বন্দর, নেভাল ব্রিজ, বিমানবন্দর দখল করে এই এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলব। যাতে পাকিস্তানিরা দখল নিতে না পারে। চট্টগ্রাম রেলের পাহাড়ে আমরা হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেছিলাম। সীমান্ত থেকে মেসেজ পেয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম। এমন সময় দেখলাম একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে কর্নেল চৌধুরী এবং মেজর জিয়াউর রহমান আসলেন। তারা বললেন, ‘আজকে রাত্রে যুদ্ধ শুরু করলে আমরা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারব না।’ তাদের যুক্তি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনা এখনো চলছে। এই মুহূর্তে যুদ্ধে জড়ানো যাবে না। তখন আমি বাধ্য হয়ে যুদ্ধ করার বার্তা স্থগিত করলাম।

২৫ মার্চ ঢাকার পরিস্থিতি বিষয়ে খবর আনলেন ডা. জাফর। তাদের সামনে আমি সুবেদার জয়নালকে বললাম, আমি যে বার্তাটি স্থগিত করেছিলাম তা আবার পাঠিয়ে দিন। সৈন্যদের নিয়ে হালিশহর দখল নিন। জিয়াউর রহমানকে গিয়ে বলেন, আমি যুদ্ধ শুরু করেছি। তাহলে তিনি তার করণীয় বুঝতে পারবেন। এরপর আমরা একটি বুলেটও খরচ না করে হাত-পা বেঁধে পশ্চিমা সেনাদের বন্দী করলাম। আগে থেকে কৌশলে তাদের নিরস্ত্র করে রেখেছিলাম। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সৈন্যদের হত্যা করে শহরের দিকে এগিয়ে আসছিল। শহরে মাইকিং হচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। ২৬ মার্চ পাকিস্তানিদের একটা দল কুমিল্লা থেকে শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে চট্টগ্রামের দিকে আসছে এরকম বার্তা পেলাম। তারা জানত না আমি শহর দখল করে ফেলেছি। ইকবাল শফির নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যের বিশাল একটি দল আসছিল। আমি সুবেদার মুসাকে বললাম, কুমিরায় অবস্থান নিয়ে অ্যামবুশ করতে। এই অ্যামবুশের মধ্যে পড়ে ৭২ জন পাকিস্তানি অফিসার-সৈনিক, অস্ত্র, যানবাহন সব ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবে তাদের শহর দখলের পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়।

২ এপ্রিল পর্যন্ত আমরা শহর দখলে রেখেছিলাম। এরপর উড়োজাহাজে পাকিস্তানি সৈন্য আনা শুরু হলো। চারদিক থেকে ওরা এগিয়ে আসতে থাকল। এদিকে আমাদের গোলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে আসছিল তখন আমরা প্রতিরক্ষা অবস্থানে গেলাম।

২ মে আমার ১ নম্বর সেক্টরের রামগড় এলাকায় ভীষণ যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিরা যুদ্ধবিমান, ট্যাংক নিয়ে আমাদের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এদিকে আমাদের পিছনে তখন ফেনী নদী। জেনারেল ওসমানী তখন রামগড়ে ছিলেন। এক অবস্থায় তিনি বললেন, চলে আসো। সবাই চলে গেল আমি আর কয়েকজন সৈন্য ছিলাম। আমরা সন্ধ্যার দিকে ফেনী নদী পার হয়ে গেলাম। সীমান্ত পার হয়ে ভারতের সাবরুম চলে গেলাম। তখন আমরা যুদ্ধ করে গেছি কিন্তু যুদ্ধের সার্বিক কৌশল পরিকল্পনা হয়নি।

১০ জুলাই কনফারেন্সে রণকৌশল নির্ধারণ করা হয়। সেখানে ৫ দিনের কনফারেন্সে সেক্টর ভাগ, গেরিলা যুদ্ধ, প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত হয়। ১০টি সেক্টরে ভাগ করা হয় তৎকালীন পূর্বাঞ্চলকে। গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং টার্গেট তৈরির পরিকল্পনা হলো।

১৫ জুলাই আমরা কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের অফিসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সামনে উপস্থিত হলাম। এ সময় নতুন করে তিনটা ফোর্স তৈরির সিদ্ধান্ত হলো। কে ফোর্স খালেদ মোশাররফের, এস ফোর্স শফিউল্লার, জেড ফোর্স জিয়াউর রহমানের। তিনটি ফোর্সে এই তিনজন কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হলো। আমরা সেক্টর কমান্ডাররা সবাই সেদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সামনে সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলাম, সংবিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলাম। এরপর ফিরে এসে সবাই যুদ্ধ ক্ষেত্রে কাজ শুরু করি। বিলোনিয়া অঞ্চল মুক্ত করতে আমরা একটা বড় অপারেশন চালাই। পাকিস্তানের পুরো একটা ব্যাটালিয়নকে ধ্বংস করে দেই। এটা ছিল চূড়ান্ত অভিযানের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

কারণ ওই এলাকা মুক্ত করলে আমরা হাইওয়েতে উঠে চট্টগ্রাম মুক্ত করতে পারব। আরেকটি বাহিনী নোয়াখালী, কুমিল্লার দিকে যেতে পারবে। ডিসেম্বরে ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে আমরা চূড়ান্ত অভিযান শুরু করি। ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিটে ভাটিয়ারিতে ব্রিজ ভেঙে পাকিস্তানিরা অবস্থান নিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানিরা সাদা পতাকা ওড়াল। তখন আমরাও সাদা পতাকা ওড়ালাম। তাদের দুজন অফিসার এগিয়ে এসে বলল, তারা আত্মসমপর্ণের বার্তা পেয়েছে। আমি বললাম, সন্ধ্যা হয়ে গেছে কালকে আনুষ্ঠিকভাবে তোমাদের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করব।

পরের দিন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস মাঠে মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার। খালি পায়ে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মুহুর্মুহু স্লোগান হচ্ছে। আমি হাতে থাকা বাংলাদেশের পতাকা মেলে ধরলাম। পাকিস্তানের পতাকা নামানো হলো। সামনে থাকা এক কিশোরের হাতে পতাকা দিতেই সে ওই স্ট্যান্ডের দড়িতে বেঁধে উড়িয়ে দিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। পতাকা যখন উপরে পৌঁছাল তখন বঙ্গোপসাগরে বইছে মৃদু হাওয়া। আবেগঘন সেই মুহূর্ত আমার চোখে এখনো ভাসে।

এই বিজয়ে লাখো বাঙালির আত্মত্যাগ আছে। তাই বিজয়ের পাশে আছে বেদনাও। সেদিন তরুণের হাতে পতাকা তুলে দিয়েছিলাম আগামী প্রজন্মকে একটা বার্তা দিতে : ‘এই স্বাধীন বাংলাদেশ তোমাদের হাতে দিলাম। এই দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব তোমাদেরকেই নিতে হবে।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন)

Tag :
সর্বাধিক পঠিত

ভারতে মসজিদের স্থানে মন্দির দাবি করে জরিপের চেস্টায় উত্তেজনা, পুলিশের গুলিতে ৩ মুসল্লি নিহত (ভিডিওসহ)

তরুণের হাতে সেদিন পতাকা তুলে দিই একটি বার্তা দেওয়ার জন্য

আপডেট: ০৫:৪২:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০১৯

মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম

৯৭১ সালে আমি সেনাবাহিনী থেকে ডেপুটেশনে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) দায়িত্ব পালন করছিলাম। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর আমি বাঙালি সৈন্যদের একত্রিত করতে থাকি। ২৪ মার্চ আমার হেডকোয়ার্টারে জেসিও ইনচার্জকে বললাম, তোমরা বার্তাগুলো সীমান্তে পাঠিয়ে দাও এবং প্রস্তুত হও। এর মধ্যে একটা বার্তা ছিল ‘অ্যারেঞ্জ সাম উড ফর মি’ অর্থাৎ বোঝানো হয়েছে যুদ্ধ শুরুর জন্য প্রস্তুত হও। আধা ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হবে। দ্বিতীয় বার্তা ছিল ‘ব্রিং সাম উড ফর মি’। অর্থ ছিল যুদ্ধ শুরু কর। তোমার এলাকার অবাঙালি সৈন্যদের বোমা দিয়ে ধ্বংস করে শহরে তোমাদের অবস্থান নাও। মেসেজগুলো পাঠিয়ে আমি অপেক্ষা করছিলাম। সীমান্ত থেকে সৈন্যরা এলে আমি শহর দখল করব।

চট্টগ্রাম বন্দর, নেভাল ব্রিজ, বিমানবন্দর দখল করে এই এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলব। যাতে পাকিস্তানিরা দখল নিতে না পারে। চট্টগ্রাম রেলের পাহাড়ে আমরা হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেছিলাম। সীমান্ত থেকে মেসেজ পেয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম। এমন সময় দেখলাম একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে কর্নেল চৌধুরী এবং মেজর জিয়াউর রহমান আসলেন। তারা বললেন, ‘আজকে রাত্রে যুদ্ধ শুরু করলে আমরা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারব না।’ তাদের যুক্তি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনা এখনো চলছে। এই মুহূর্তে যুদ্ধে জড়ানো যাবে না। তখন আমি বাধ্য হয়ে যুদ্ধ করার বার্তা স্থগিত করলাম।

২৫ মার্চ ঢাকার পরিস্থিতি বিষয়ে খবর আনলেন ডা. জাফর। তাদের সামনে আমি সুবেদার জয়নালকে বললাম, আমি যে বার্তাটি স্থগিত করেছিলাম তা আবার পাঠিয়ে দিন। সৈন্যদের নিয়ে হালিশহর দখল নিন। জিয়াউর রহমানকে গিয়ে বলেন, আমি যুদ্ধ শুরু করেছি। তাহলে তিনি তার করণীয় বুঝতে পারবেন। এরপর আমরা একটি বুলেটও খরচ না করে হাত-পা বেঁধে পশ্চিমা সেনাদের বন্দী করলাম। আগে থেকে কৌশলে তাদের নিরস্ত্র করে রেখেছিলাম। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সৈন্যদের হত্যা করে শহরের দিকে এগিয়ে আসছিল। শহরে মাইকিং হচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। ২৬ মার্চ পাকিস্তানিদের একটা দল কুমিল্লা থেকে শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে চট্টগ্রামের দিকে আসছে এরকম বার্তা পেলাম। তারা জানত না আমি শহর দখল করে ফেলেছি। ইকবাল শফির নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যের বিশাল একটি দল আসছিল। আমি সুবেদার মুসাকে বললাম, কুমিরায় অবস্থান নিয়ে অ্যামবুশ করতে। এই অ্যামবুশের মধ্যে পড়ে ৭২ জন পাকিস্তানি অফিসার-সৈনিক, অস্ত্র, যানবাহন সব ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবে তাদের শহর দখলের পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়।

২ এপ্রিল পর্যন্ত আমরা শহর দখলে রেখেছিলাম। এরপর উড়োজাহাজে পাকিস্তানি সৈন্য আনা শুরু হলো। চারদিক থেকে ওরা এগিয়ে আসতে থাকল। এদিকে আমাদের গোলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে আসছিল তখন আমরা প্রতিরক্ষা অবস্থানে গেলাম।

২ মে আমার ১ নম্বর সেক্টরের রামগড় এলাকায় ভীষণ যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিরা যুদ্ধবিমান, ট্যাংক নিয়ে আমাদের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এদিকে আমাদের পিছনে তখন ফেনী নদী। জেনারেল ওসমানী তখন রামগড়ে ছিলেন। এক অবস্থায় তিনি বললেন, চলে আসো। সবাই চলে গেল আমি আর কয়েকজন সৈন্য ছিলাম। আমরা সন্ধ্যার দিকে ফেনী নদী পার হয়ে গেলাম। সীমান্ত পার হয়ে ভারতের সাবরুম চলে গেলাম। তখন আমরা যুদ্ধ করে গেছি কিন্তু যুদ্ধের সার্বিক কৌশল পরিকল্পনা হয়নি।

১০ জুলাই কনফারেন্সে রণকৌশল নির্ধারণ করা হয়। সেখানে ৫ দিনের কনফারেন্সে সেক্টর ভাগ, গেরিলা যুদ্ধ, প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত হয়। ১০টি সেক্টরে ভাগ করা হয় তৎকালীন পূর্বাঞ্চলকে। গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং টার্গেট তৈরির পরিকল্পনা হলো।

১৫ জুলাই আমরা কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের অফিসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সামনে উপস্থিত হলাম। এ সময় নতুন করে তিনটা ফোর্স তৈরির সিদ্ধান্ত হলো। কে ফোর্স খালেদ মোশাররফের, এস ফোর্স শফিউল্লার, জেড ফোর্স জিয়াউর রহমানের। তিনটি ফোর্সে এই তিনজন কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হলো। আমরা সেক্টর কমান্ডাররা সবাই সেদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সামনে সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলাম, সংবিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলাম। এরপর ফিরে এসে সবাই যুদ্ধ ক্ষেত্রে কাজ শুরু করি। বিলোনিয়া অঞ্চল মুক্ত করতে আমরা একটা বড় অপারেশন চালাই। পাকিস্তানের পুরো একটা ব্যাটালিয়নকে ধ্বংস করে দেই। এটা ছিল চূড়ান্ত অভিযানের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

কারণ ওই এলাকা মুক্ত করলে আমরা হাইওয়েতে উঠে চট্টগ্রাম মুক্ত করতে পারব। আরেকটি বাহিনী নোয়াখালী, কুমিল্লার দিকে যেতে পারবে। ডিসেম্বরে ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে আমরা চূড়ান্ত অভিযান শুরু করি। ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিটে ভাটিয়ারিতে ব্রিজ ভেঙে পাকিস্তানিরা অবস্থান নিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানিরা সাদা পতাকা ওড়াল। তখন আমরাও সাদা পতাকা ওড়ালাম। তাদের দুজন অফিসার এগিয়ে এসে বলল, তারা আত্মসমপর্ণের বার্তা পেয়েছে। আমি বললাম, সন্ধ্যা হয়ে গেছে কালকে আনুষ্ঠিকভাবে তোমাদের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করব।

পরের দিন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস মাঠে মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার। খালি পায়ে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মুহুর্মুহু স্লোগান হচ্ছে। আমি হাতে থাকা বাংলাদেশের পতাকা মেলে ধরলাম। পাকিস্তানের পতাকা নামানো হলো। সামনে থাকা এক কিশোরের হাতে পতাকা দিতেই সে ওই স্ট্যান্ডের দড়িতে বেঁধে উড়িয়ে দিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। পতাকা যখন উপরে পৌঁছাল তখন বঙ্গোপসাগরে বইছে মৃদু হাওয়া। আবেগঘন সেই মুহূর্ত আমার চোখে এখনো ভাসে।

এই বিজয়ে লাখো বাঙালির আত্মত্যাগ আছে। তাই বিজয়ের পাশে আছে বেদনাও। সেদিন তরুণের হাতে পতাকা তুলে দিয়েছিলাম আগামী প্রজন্মকে একটা বার্তা দিতে : ‘এই স্বাধীন বাংলাদেশ তোমাদের হাতে দিলাম। এই দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব তোমাদেরকেই নিতে হবে।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন)