মতলব উত্তর প্রতিনিধি:
মতলব উত্তরে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার (এটিইও) মো. অলিউল্লাহ’র বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন বরাদ্দ থেকে কয়েক লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তার দায়িত্বে থাকা ক্লাস্টারের অন্তত ৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্লিপ, ক্ষুদ্র মেরামত ও রুটিন ম্যান্টিনেন্সের বরাদ্দের চিঠিতে সই করতে ঘুষ নিয়ে পকেট ভারি করেছেন। শিক্ষকরা প্রতিবাদ করলেই ঠুনকো অভিযোগও শোকজসহ হয়রানি করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
কথায় আছে, সরিষার মধ্যে যদি থাকে ভূত তাহলে সেই সরিষা, ভূত তাড়ানোর কাজে লাগে না। তেমনি যদি একটি কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িয়ে দূর্নীতি করেন এবং শিক্ষকদের দুর্নীতি করতে সহযোগিতা করেন, তবে ভালোটা কি ভাবে আশা করা যায়। এমনটি চরিত্র ধরা পড়েছে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায়। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. অলিউল্লাহ এর অনিয়ম দুর্নীতির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন উপজেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
জানা গেছে, স্লিপের বরাদ্দের টাকা থেকো সহকারী শিক্ষা অফিসার মো. অলিউল্লাহকে ঘুষ না দিলে তিনি কাগজপত্র আটকে দেন। পরে টাকা দিলে কাজ করে দেন। রুটিন বরাদ্দ থেকেও দুই হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। করোনাকালীন বরাদ্দের ১৮ হাজার টাকা নিয়ে মালামাল কিনে দিছেন মাত্র ২ হাজার টাকার। শিক্ষকদের কাছ থেকে তিনি মাসোহারা নেন, না দিলে কতৃপক্ষের মাধ্যমে হয়রানি করবেন বলে হুমকি দেন। এক শিক্ষক আবেদনপত্রের মাধ্যমে কতৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে অসুস্থতার ছুটি নেওয়ার পরও তার কাছ থেকে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ ঘুষ আদায় করেছেন। এক বিদ্যালয়ের হারমনিয়াম তার বাসা এনে প্রায় চার বছর ধরে নিজের বাচ্চাকে শিখানোর জন্য এনে রেখেছেন। এ ব্যাপারে কথা বললে ওই স্কুলের শিক্ষককের চাকুরী খেয়ে ফেলবেন বলে হুমকি দিয়েছেন এটিইও মো. অলিউল্লাহ। শুধু তাই নয় তিনি যেই ইউনিয়নে ট্যাগ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ওখান থেকে তিনি প্রতিবার অবৈধভাবে বস্তায় বস্তায় চাউল নিয়ে যান। তার এহেন দুর্নীতির কর্মকাণ্ডের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। এমনকি লেখাপড়া ও বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন হুমকির মুখে পড়েছে।
মতলব উত্তর উপজেলা শিক্ষা অফিস সুত্রে জানা গেছে, এটিইও মো. অলিউল্লাহ গত ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে এই উপজেলায় যোগদান করেন। সেইকাল থেকে এ পর্যন্ত একই ক্লাস্টারের দায়িত্বে কাজ করছেন। দীর্ঘ ৬ বছর তিনি ছেংগারচর ও মোহনপুর ক্লাস্টারে দায়িত্ব পালন করার এমন অনিয়ম দুর্নীতি করার সুযোগ পেয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন অনেক শিক্ষক ও শিক্ষক নেতারা। তাকে উৎকোচ দিতে চাইলে শিক্ষকদের গালমন্দ করেন এবং খারাপ আচরণ করেন। এমনকি চাকুরী খেয়ে ফেলবেন বলেও হুমকি দেন। তার ঘুষের টাকা না দেওয়ায় গত বছর এখলাছপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা জান্নাতি আক্তারের উপর মানসিক টর্চার চালান। ১ হাজার টাকা ঘুষ না পেয়ে ওই শিক্ষিকাকে এক বছরের প্রশিক্ষণে অকৃতকার্য দেখিয়ে দেন। ফলে ওই শিক্ষিকা ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা যায়। এ ঘটনায় ওই শিক্ষককের পরিবার আইনী পদক্ষেপ নিতে চাইলে শিক্ষক নেতারা তা দমিয়ে রাখেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান, ৫ম শ্রেণির ডিআর ফরম ও প্রশ্ন নিয়ে ঘুষ বাণিজ্য করেন। শিক্ষকরা কথা বললেই শোকজের ভয় দেখান। প্রতিটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল নতুন পাঠ্যবই দেওয়ার সময় ৩০০-৫০০ টাকা উৎকোচ নেন। টাকা না দিলে বই দেন না। তার দায়িত্বে করা ২০২২ সালের প্রশ্নেও ছিল ব্যাপক ভুল। ঝিনাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা অসুস্থতার ছুটি নেওয়ার পরও তাকে ব্লেকমেইল করে তার কাছ থেকে কয়েক হাজার টাকা ঘুষ নেন। তার ক্লাস্টারের স্কুলগুলোর খেলা সামগ্রী কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে তিনি নিজেই সাপ্লাই দিতেন। এছাড়াও যেকোন ব্যানার এবং শিক্ষা সামগ্রী তিনি নিজেই সাপ্লাই দেন কম দামী জিনিসপত্র। ৬ টি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমন অডিও রেকর্ড রয়েছে।
কয়েকটি স্কুলে খোঁজ নিলে দেখা গেছে, বাচ্চাদের করোনাকালীন সামগ্রী ক্রয়ের ১৮ হাজার টাকা বরাদ্দ থেকে তিনি মাত্র এক দেড় হাজার টাকার মালামাল কিনে দিয়েছেন নিয়ম বহির্ভূত। এরও কোন ভাউচার দেখাতে পারে নি। অথচ ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রেজুলেশন করে এইসব সরকারি বরাদ্দের টাকা খরচ করার নিয়ম থাকলেও এটিও অলিউল্লাহ নিজেই দূর্নীতি করছেন। শুধু তাই নয়, ২১ শে ফেব্রুয়ারী, ১৭ মার্চ, ১৫ আগস্ট, ১৬ ডিসেম্বর সহ সকল সরকারি দিবসগুলোর ব্যানার তিনি প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে অধিক টাকা নিয়ে কম দামে দাউদকান্দি এলাকা থেকে নিজেই সরবরাহ করেন। আর প্রতি ব্যানার থেকে প্রায় ৩০০-৪০০ টাকা দুর্নীতি করেন। বার্ষিক পরীক্ষার প্রতিটি প্রশ্নের বিল করেন ৯ টাকা। অথচ পাশের উপজেলায় ৬ টাকা করা হয়। হাজীগঞ্জের ৫ টাকা এবং কচুয়া উপজেলায় খবর নিয়ে জানা গেছে মাত্র ৪ টাকা বিল করা হয়। কিন্তু মতলব উত্তরে তিনি ৯ টাকা করে নিয়ে বিশাল অংকের টাকা ঘুষ বাণিজ্য করছেন। তার এসব দুর্নীতির কারণে বেশ হয়রানি হচ্ছেন শিক্ষকরা। এ ব্যাপারে মুখ খুললে নানান ধরনের হুমকি দেন এটিও অলিউল্লাহ। তার এ দুর্নীতির চাপ পড়ছে পাঠদানে। ফলে এ উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষায় ধ্বস নেমে আসার আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক জানিয়েছে, সরকার শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করছে। কিন্তু মতলব উত্তরে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. অলিউল্লাহর অনিয়মের কারণে তা অনেকটা ভেস্তে যাচ্ছে। তিনি টাকা নীতিতে বিশ্বাসী। শিক্ষকরা প্রতিবাদ করলেই কারণে-অকারণে, অনেক সময় উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে শোকজসহ হয়রানি করা হয়।
এসব দুর্নীতির বিষয়ে কথা হয় সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. অলিউল্লাহ এর সাথে। তিনি বলেন, আমাকে কেউ হেয় করার জন্য এসব তথ্য দিয়েছে। সবকিছু নিয়ম মতই চলছে। আপনারা অধিকতর তদন্ত করে দেখেন আমি কোন দুর্নীতি সাথে জড়িত নেই।