তিতাস গ্যাস কোম্পানি গত চার বছরে ১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিক্রির ২২ ভাগই মুনাফা করেছে কোম্পানিটি। অথচ এখন তারাই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে কমিশনে দৌড়ঝাঁপ করছে। অনেকেই একে বলছেন দ্বিমুখী আচরণ।
কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, এখন সাড়ে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে। এরমধ্যে ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমাদের দেশীয় উৎস থেকেই সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিদিন যে ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে তার মধ্যে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট দশ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আনা। ফলে এখানে দামের হেরফের হয়নি৷ স্পট মার্কেট থেকে যে ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি কেনা হচ্ছে তার দামের হেরফের হয়েছে শুধু। ওটার জন্য গ্যাসের দাম কেন দ্বিগুণ করতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে পেট্রোবাংলাসহ তিতাস, জালালাবাদ, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানি গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। একইভাবে চলতি সপ্তাহে বাখরবাদ গ্যাস কোম্পানিও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়।
পেট্রোবাংলা এবং বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে ভবিষ্যতে এলএনজি আমদানিতে বিতরণ ব্যয় বাড়বে। সেজন্য দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু যে ব্যয় বাড়েনি আগেভাগে সেটা দেখিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই।
কমিশন আইন অনুযায়ী এসব গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এবং পেট্রোবাংলার ব্রেক ইভেন লাভ-লোকসানের সমতা বিন্দু পর্যন্ত দাম বাড়ানোর প্রবিধান রয়েছে। সেক্ষেত্রে এতদিন গ্যাস বিক্রি করে কীভাবে কোম্পানিগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করলো তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে কমিশন প্রয়োজনের তুলনায় আগে থেকে অতিরিক্ত দাম বাড়িয়েছে।
তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি কমিশনে যে হিসাব দাখিল করেছে, তাতে বলা হচ্ছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তারা ৩৩৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা লাভ করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লাভের পরিমাণ ছিল ৩৬৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৩৫৯ কোটি ৮১ লাখ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৪৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
তিতাস কমিশনার যে হিসাব দিয়েছে তাতে বলা হচ্ছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তারা সরকারকে উৎসে আয়কর দিয়েছে ৩৪২ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কর দিয়েছে ২৫৭ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কর দিয়েছে ৩৯৫ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরের কর দিয়েছে ৪৪০ কোটি টাকা। এই নিয়ে এই চার বছরে সরকারকে কর দিয়েছে ১৫৪২ কোটি টাকা।
সম্প্রতি গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য বিতরণ কোম্পানিগুলো যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে গড় মূল্য ১১৬ ভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ বতমান দাম প্রতি ঘনমিটারে ৬ টাকা ৯১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা ৯৪ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু পেট্রোবাংলা আরও এক কাঠি এগিয়ে। তারা বলছে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম হতে হবে ২০ টাকা ৩৫ পয়সা। প্রতিষ্ঠানটির দাবি—প্রতিদিন গড়ে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি ধরে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে আজ পর্যন্ত কোনোদিনই পেট্রোবাংলা এ পরিমাণ এলএনজি আমদানি করেনি। গড়ে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানি করে। বছরে কখনও সংকট বাড়লেই ৮০০-৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে দেখা গেছে। সাধারণত গ্রীষ্মকালীন বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেলে ওই সময়ে অতিরিক্ত এলএনজি সরবরাহ করে পেট্রোবাংলা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, ‘এই ধরনের প্রস্তাব নিতান্তই অবাস্তব। কদিন আগেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। পরিবহনে অরাজকতা তৈরি হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ালে একই যুক্তিতে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে। তাই এখনই গ্যাসের দাম বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত হবে না।’
বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন মনে করেন, ‘ভবিষ্যতে জ্বালানির কথা বিবেচনা করে গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত। তবে বিতরণ কোম্পানিগুলো এখন যে দামের প্রস্তাব দিয়েছে তা অনেক বেশি। কমিশনের বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’
বিশেজ্ঞদের অভিমত করোনার মধ্যে এমনিতেই সাধারণ মানুষের আয় কমেছে। তার উপর যদি গ্যাসের দাম বাড়ে বাড়বে গাড়ী ভাড়া একই সাথে বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম। এতে বিপাকে পড়বে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা।