ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনৈতিক পথে একজন মানুষ অর্থ-বিত্তে তরতর করে কতটা ওপরে উঠে যেতে পারে, তার তরতাজা নিদর্শন শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। রাজধানীর লাগোয়া জেলা নরসিংদীর মেয়ে সে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন আওয়ামী যুব মহিলা লীগের নরসিংদী জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিল সে (বর্তমানে বহিষ্কৃত)। গত ২২ ফেব্রুয়ারি দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাকে আটক করে র্যাব। খবরে বলা হয়েছে, তার ওপর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগে থেকেই নজর রাখছিল। তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তাকে গোয়েন্দা নজরদারির নেটওয়ার্কে নিয়ে আসে। আটকের পর তার সম্পর্কে যেসব খবরাখবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গেছে সবারই। মাত্র পাঁচ বছরে একজন তরুণী কী করে এত বিত্ত-বৈভবের মালিক হলো, তা এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। খবরে বলা হয়েছে, রাজধানীর অন্যতম অভিজাত হোটেল ওয়েস্টিনে তিন মাসে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করেছে পাপিয়া। পাঁচ তারকা ওই হোটেলের প্রেসিডেন্ট সুটটি তার নামে বরাদ্দ থাকত সব সময়। হোটেলটির বারে সে নাকি প্রতি মাসে বিল পরিশোধ করত আড়াই লাখ টাকা। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করলে বিষয়টি টের পেয়ে তড়িঘড়ি দেশত্যাগের চেষ্টা করে পাপিয়া। কিন্তু বিধি বাম। পালানোর আগ মুহূর্তে বিমানবন্দরে র্যাবের হাতে স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন, ব্যক্তিগত সহকারী শেখ তায়্যিবা এবং সাব্বির খন্দকারসহ আটক হয় সে। গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে এসেছে পাপিয়ার অপকর্মের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে কাজ আদায় করতে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য সুন্দরীদের হোটেলে সরবরাহ, চাঁদাবাজি, এমনকি অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গেও তার সম্পৃক্ত থাকার খবর পাওয়া গেছে। এসব অনৈতিক ও অবৈধ কাজ করে সে রীতিমতো ধনকুবের বনে গেছে। ঢাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বাড়ি, গন্ডাখানেক গাড়ি, বিস্তর জমিসহ বিপুল বিত্তের মালিক পাপিয়া-সুমন দম্পতি। অথচ তার প্রদর্শিত আয়ের উৎস নরসিংদীর একটি গাড়ি সার্ভিসিং সেন্টার।
পাপিয়ার এ উত্থানের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশয়ের কাহিনী। একজন সাধারণ তরুণী থেকে ক্ষমতাসীন দলের একটি সহযোগী সংগঠনের জেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে তার অধিষ্ঠানের পেছনে বড়ভাই-বোনদের আশীর্বাদের বিষয়টি ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে এসেছে। মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমেই সে তার অপকর্ম চালিয়েছে নির্বিঘ্নে। খবরে বলা হয়েছে, নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতার আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে পাপিয়াকে কেন্দ্র থেকে ওই পদে বসিয়ে দেওয়া হয়। পাপিয়ার স্বামী সুমন এক সময় ছাত্রলীগের নরসিংদী শহর শাখার আহ্বায়ক ছিল। একসময় এ দম্পতি নরসিংদী থেকে ঢাকায় এসে তাদের অবৈধ কাজকারবার শুরু করে। পাপিয়া পরিণত হয় মক্ষীরানিতে। বিভিন্ন স্থান থেকে সুন্দরী তরুণীদের এনে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও প্রভাবশালী আমলা এবং রাজনৈতিক নেতাদের মনোরঞ্জনের জন্য সরবরাহ করত। তারপর গোপনে ভিডিও করে তা দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল করত। হাতিয়ে নিত লাখ লাখ টাকা। পাপিয়ার অনৈতিক কাজকারবার সম্পর্কে যেসব খবর ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তার ফিরিস্তি অনেক লম্বা।
সবকিছু ছাপিয়ে এখন যে প্রশ্নটি সচেতন ব্যক্তিদের তাড়িত করছে তাহলো, রাজনীতির জার্সি গায়ে একদল দুর্বৃত্ত এমনসব ক্রীড়া নৈপুণ্য কি দেখাতেই থাকবে? এদের এসব অপকর্ম যে রাজনীতির গায়ে অনপনেয় কালি লাগিয়ে দিচ্ছে তা কি আমাদের রাজনীতির ধারকরা ভেবে দেখেছেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এরা রাজনীতিকে? কীভাবে নিয়ে যাচ্ছে? এরা তো একা একা হেঁটে এতদূর আসতে বা উপরে উঠতে পারেনি। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, ‘ওপরে ওঠার সময় অপরের সাহায্য লাগে, নিচে নামার সময় কারো সাহায্য প্রয়োজন হয় না।’ পাপিয়াদের রাজনীতির মঞ্চে উঠে আসার পেছনে কারো না কারো সাহায্য-সহযোগিতা তো ছিলই। সে সাহায্যকারী কারা? কোথায় তাদের অবস্থান? গত বছর যখন রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয় এবং ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন ডাকসাইটে নেতা সে জালে ধরা পড়ে, প্রশ্নটি তখনো উঠেছিল। একজন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া বা ইসমাইল হোসেন সম্রাট হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি, একা একাও বেড়ে ওঠেনি। গ্রেপ্তারের পর সম্রাট তো বলেও ছিল, আমি একা কেন সাজা পাব? আমার থেকে যারা সুবিধা নিয়েছে তারা কোথায়? এই ‘তারা’রা সব সময় পর্দার অন্তরালেই থেকে যায়। তারা পেছন থেকে খালেদ, সম্রাট, পাপিয়াদের প্রম্পট করে, সামনে ঠেলে দিয়ে সুবিধা নেয়। আবার বিপদ দেখলে নিজেদের শামুকের মতো শক্ত খোলের ভেতর গুটিয়ে ফেলে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারির বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়ার মুখ থেকে পিলে চমকানো তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সে জানিয়েছে তার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম। কারা তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, কমিটিতে বড় পদ পাইয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছে এবং কারা তার কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছে, এসব তথ্য এখন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে। ফলে অনেক রাজনৈতিক নেতার নাকি ঘুম হারাম হয়ে গেছে পাপিয়া-দুশ্চিন্তায়। সঙ্গত কারণেই পাপিয়ার পাপের অংশীদাররা এখন ভয়ে তটস্থ। যে কোনো সময় থলের বিড়াল বেরিয়ে ঘটিয়ে দিতে পারে মহাসর্বনাশ।