আজ ভয়াল ২৫ ফেব্রুয়ারি

  • আপডেট: ০৪:৫৫:১৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০
  • ১৬
অনলাইন ডেস্ক:

আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের সেই কালো দিন। ১১ বছর আগে এই দিনে পিলখানায় সাবেক বিডিআর ও বর্তমান বিজিবি সদর দপ্তরে ঘটে গেছে ইতিহাসের এক নির্মম ও নৃশংস ঘটনা। তখন সকাল ৯টা ২৭ মিনিট। দরবার হলে চলমান বার্ষিক দরবারে একদল বিদ্রোহী বিডিআর সৈনিক ঢুকে পড়ে। সিপাহি মঈন নামে একজন বিডিআর সদস্য মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা। বিডিআরের বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলে। পুরো পিলখানায় এক নারকীয় ও বীভৎস ঘটনার সৃষ্টি করে তারা। এ সময় তারা ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিজিবি’র সদর দপ্তর পিলখানায় সেদিন বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর কোনো বাহিনীর বিদ্রোহের ইতিহাসে পাওয়া যায় না।

পিলখানায় নারকীয় হত্যার ঘটনায় দায়ের করা হয় দুটি মামলা। এর মধ্যে সেনা কর্মকর্তাদের নিহতের ঘটনায় দণ্ডবিধি আইনে করা হয় হত্যা মামলা। অপরটি হয় বিস্ফোরক আইনে। দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতের দেয়া ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয়। ৮ জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও ৪ জনকে খালাস দেয়া হয়। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। হাইকোর্টে আপিল চলার সময়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়। খালাস পান ১২ জন আসামি। চূড়ান্ত বিচার কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় এখনও সাজা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি দোষীদের। বর্তমানে বিডিআর হত্যামামলায় হাইকোর্টের আদেশের কপির অপেক্ষায় আছে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ। হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের কপি হাতে পেলে দুপক্ষই এ মামলায় আপিল করবে বলে জানা গেছে।

পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে শহীদ ব্যক্তিদের স্মরণে আজ মঙ্গলবার শাহাদাতবার্ষিকী পালন করবে বিজিবি। দিনের কর্মসূচিতে রয়েছে- পিলখানাসহ বিজিবি’র সব রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় বাদ ফজর খতমে কোরআন, বিজিবির সব মসজিদে এবং বিওপি পর্যায়ে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় সকাল ৯টায় বনানীর সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ৩ বাহিনীর প্রধান (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক (একসঙ্গে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া আসামিকাল বুধবার বাদ আসর পিলখানার বীর উত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার মিলনায়তনে শহীদ ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

এছাড়া, স্বরাষ্ট্র সচিব, বিজিবি মহাপরিচালক, শহীদ ব্যক্তিদের নিকটাত্মীয়রা, পিলখানায় কর্মরত সব কর্মকর্তা, জুনিয়র কর্মকর্তা, অন্যান্য পদবির সৈনিক ও বেসামরিক কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করবেন।

গতকাল সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গত ৮ জানুয়ারি আলোচিত বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত এ মামলায় ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশিত হয়। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চের ওই তিন বিচারপতি রায়ে স্বাক্ষর করার পর তা সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

জানা গেছে, প্রথমে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি মো. শওকত হোসেন মূল রায় লেখেন। তিনি প্রায় সাড়ে ১১ হাজার পৃষ্ঠার রায় লিখে বেঞ্চের অন্য দুই বিচারপতির কাছে পাঠান। এরপর বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী পৃথকভাবে তার অংশ লিখেছেন। তিনি লিখেছেন প্রায় ১৬ হাজার পৃষ্ঠা। এরপর বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার লিখেছেন এক হাজার ১০০ পৃষ্ঠা। এই তিনজনের লেখা রায় একত্র করে তা চূড়ান্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আসামির ফাঁসির আদেশসংবলিত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে।

নিয়ম অনুযায়ী হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পর আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবে উভয়পক্ষই। এরপর আপিলের বিচারের মধ্য দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে। যদিও এরপর রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না। এই নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কারণে ‘বিডিআর’ নামটি পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) করা হয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুব আলম বলেন, হাইকোর্টের রায়ে ২৮৩ জনকে খালাস দেয়া হয়েছে। আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর তাদের ব্যাপারে আপিল করবে রাষ্ট্রপক্ষ।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন। চূড়ান্ত রায় প্রকাশিত হলেও তাদের কাছে এখনো সার্টিফাইড কপি হাতে এসে পৌঁছেনি। ওই কপি হাতে পেলেই সাজাপ্রাপ্তদের খালাস চেয়ে আপিল করা হবে।

বিস্ফোরক দ্রব্য মামলা

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলা এখনো নিম্ন আদালতের গণ্ডিই পেরোতে পারেনি। এই মামলা সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বিস্ফোরক আইনের মামলাটি। এই মামলায় আসামি রয়েছেন ৮৩৪ জন। এর মধ্যে একজন সিভিলিয়ান, বাকি আসামিরা বিডিআরের জওয়ান। এই মামলায় আসামিদের মধ্যে ২৪ জন মারা গেছেন। জীবিত আসামি ৭৯০ জন। পলাতক রয়েছেন ২০ জন আসামি। এই মামলায় ১৪৬ জন সাক্ষী দিয়েছেন, রাষ্ট্রপক্ষের প্রায় ১২ শত সাক্ষী রয়েছে। আসামি ৮ মার্চ পরবর্তী সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহনের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। মামলার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়া প্রসঙ্গে এই মামলার আইনজীবী  ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ বাহারুল ইসলাম বলেন, বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। তবে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে খুব একটা উপস্থিত হচ্ছেন বলে এর বিচার প্রক্রিয়া ধীর গতিতে হচ্ছে। তবে এই মামলায় সব সাক্ষী প্রয়োজন নেই। মোটামুটি একটা পর্যায়ে গেলেই এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। আশা করছি এ বছরের মধ্যে এই মামলার রায় দেয়া সম্ভব হবে।

বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, নিরাপত্তার কারণে বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলার বিচার সম্পন্ন করতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। প্রায় এক কোটি টাকা খরচ করে পুরান ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়েছে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামীম সরদার বলেন, উচ্চ আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। তবে বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলা চলছে ধীরগতিতে। এতে অনেক আসামিকে কারাগারে বন্দি থাকতে হচ্ছে।

নিহতদের স্বজনদের অনেকেই বলেছেন যে, তারা রায়ের বাস্তবায়ন দেখতে চান। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি বলে দাবি করেছেন পিলখানা ট্র্যাজেডিতে নিহত মেজর মমিনুল ইসলাম সরকারের বোন নূরজাহান চৌধুরী।

শহীদ কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদের বড়বোন দিলরুবা খাতুন বলেন, বিচারের রায় হয়েছে। তা দ্রুত এখন কার্যকর করা দরকার। আমরা বিচারকাজ দ্রুত শেষ করার দাবি জানাচ্ছি।

শহীদ মেজর তানভীর হায়দার নূরের বাবা নূর মোহাম্মদ বলেন, ছেলেকে হারিয়েছি। এখন বিচার চলছে। কিন্তু ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না।

মেজর মিজানুর রহমানের বৃদ্ধ মা কহিনূর বেগম ছেলের স্মৃতিচারণ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ঘটনার দিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে আমাকে বলে, মা তুমি সামিকে (মিজানের ছেলে) দেখ। এরপর আমার বাবা আমাকে আর মা ডাকল না। আর কথা বলল না। সামির বয়স তখন তিন। এখন সামি স্কুলে যায়। কিন্তু মিজান কিছুই দেখতে পেল না।

মিজানুরের বড় ভাই সেনাবাহিনীতে কর্মরত লে. কর্নেল ফেরদৌস বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী সদরে। দেশপ্রেম থেকেই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছি। মিজান আমার ছোট। ঘটনার আট মাস আগে ওর স্ত্রী রেবেকা ফারহানা রোজী মারা যায়। তাদের দুই ছেলে। বড় ছেলে তাহসিন রহমান রামি (১৬) ও ছেটে ছেলে ফারজিন রহমান সামি (১১)। আমিই এখন দুই ছেলের দেখাশোনা করি। ছোট ছেলেটা মায়ের কাছে থাকে।

তিনি বলেন, ছেলে দুটির মুখের দিকে তাকালে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। ওদের তো কেউ নেই। বাবা-মা সব আল্লাহ নিয়ে গেছে। আমার বৃদ্ধা মা এই কষ্ট কীভাবে সহ্য করবেন?

শহীদ মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছোট বোন রুবিনা নেসা নিনি বলেন, এর নেপথ্যে কারা তা জানা দরকার। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।

কী ঘটেছিল সেদিন?

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা পিলখানা এলাকায় অবস্থিত বিডিআর সদর দপ্তরে বিডিআর থেকে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের কর্তৃত্বের অবসান, রেশন ও বেতনবৈষম্য দূর করাসহ বেশ কিছু দাবিতে সশস্ত্র বিদ্রোহ করে। অনেকেই নানাভাবে সেদিনের দরবার হলের ঘটনার বিবরণ দেন, কিন্তু সেগুলো পরে ঘটনার নিষ্ঠুরতা জানার পর এবং স্বজনের কান্নাকাটিতে পরিস্থিতির চাপে কিছুটা মোটিভেটেড বলে মনে হয়েছে। বিপুলসংখক বীভৎস মৃতদেহ দেখে তীব্র প্রতিক্রিয়া, আবেগের ভেতর থেকে আসল সত্য বের করে আনা সত্যই কঠিন ছিল। কিন্তু কেন এ হত্যাযজ্ঞ, এই ঘটনা কি পূর্ব পূর্বপরিকল্পিত? না নিছক উত্তেজনার বসে? কী ঘটেছিল সেদিন?

বিডিআর সৈনিকদের চাপা ক্ষোভ অনেক বছর আগে থেকেই ছিল। নবনির্বাচিত সরকার অপেক্ষাকৃত কম রক্ষণশীল, কম সেনা তোষণকারী এবং উদার মনে হওয়া প্রধানমন্ত্রীকে বেশ কিছুদিন আগেই তৈরি করা মূল তিনটি দাবিসহ ৬ দফা দাবিসহ একটি স্মারকলিপি দেয়ার উদ্যোগ চলছিল, তাদের ধারণা হয়েছিল নবনির্বাচিত আওয়ামী সরকারই তাদের জুলুম কিছুটা নিরসন করতে পারবে। কিছুদিন আগে স্থানীয় সাংসদ তাপস জিগাতলা দলীয় ক্যাম্পে এলে তার কাছে কিছু সৈনিক পরামর্শের জন্য আসে, তিনি শুধু রেশনের ব্যাপারটা ছাড়া অন্য ব্যাপারগুলো তার আওতার বাইরে বলে জানান। পরে তাদেরকে প্রপার চ্যানেলে যাওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়। পরে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেয়েও কোনো সুবিধা পায়নি। এরপরের মাসে বিডিআর সপ্তাহে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ডিজি শাকিল এভাবে দেওয়া ঠিক হবে না মন্তব্য করেন, নিজেই প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে কথা বলবেন বলে মত দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী প্যারেডে সালাম গ্রহণ করার জন্য পিলখানায় আসলে তিনি তা দেননি বা আলোচনার চেষ্টাও করেননি।

পরদিন সকালে দরবার হলে পূর্ব নির্ধারিত বিডিআর ডিজি শাকিলের বক্তব্য শুরু করার কিছুক্ষণ পরই উত্তেজনা বািবতণ্ডা। স্মারকলিপি কেন দেওয়া হয়নি, ইউএন মিশনে না নেওয়া, ডাল-ভাত, শপিংমলের হিসাব, সীমান্তের চোরাই মাল আটকের-লুণ্ঠনের ভাগ আফিসার সৈনিক অনুপাত ৮৯:১১ কেন? ৬০:৪০ চাই। এসবের কোনো সুরাহা না হওয়ায় একটা হট্টগোলের সূত্রপাত। উচ্চস্বরে ধমকের শব্দ। এরপর ডিজি শাকিল এভাবে হৈচৈ না করে একজনকে সামনে এসে বক্তব্য দিতে বলেন। সামনে একজনের জায়গায় দুজন এসেছিল বলে জানা যায়। বািবতণ্ডায় একপর্যায়ে একজন জোয়ানকে স্টেজের ওপরে দেখা যায়। হুমকির সুরে কিছু একটা বলে অ্যাবাউট টার্ন করে চলে যেতে চায়। তখন একজন অফিসার তাকে ধরে ফেলে, বলে— ‘কি বলছ পাগলের মতো’ অপমানিত ডিজি শাকিলের হাতে পিস্তল। হট্টগোলের ভেতর স্টেজের সৈনিকটি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখা যায়। সাধারণ সৈনিকরা স্বাভাবিকভাবেই ভুল বোঝে যে, লুটিয়ে পরা সৈনিকটি বুঝি শাকিলের গুলিতেই মারা গেছে। এরপর উপস্থিত সৈনিকরা একযোগে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। সবাই হল ছেড়ে চলে যায়। এর পরের ঘটনা ভয়াবহ। সৈনিকরা দরবার হল ত্যাগ করার পর বাইরে গুজব ছড়িয়ে যায় যে জে. শাকিল এক সৈনিককে গুলি করে হত্যা করেছে। এরপর সংঘবদ্ধ হয়ে অস্ত্রাগার রক্ষীকে মারধর করে চাবি কেড়ে নিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বের করা, ভিন্ন আরেকটি গোলাবারুদের গুদাম থেকে গুলিভর্তি ম্যাগাজিন তুলে নেওয়া হয়। একটি দল দরবার হলের দিকে যায়, এরপর প্রথম গুলিবর্ষণের শব্দ, অটোমেটিক রাইফেলের ব্রাশফায়ার। প্রত্যক্ষদর্শী সৈনিকের বক্তব্যে জানা যায়, হত্যাকারীরা প্রথমে আকাশের দিকে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে, পরে উত্তেজনা বেড়ে গেলে কয়েক জন দরবার হলের দেয়াল, বদ্ধ দরজা-জানালা লক্ষ করে এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ার করতে থাকে। ডিজি শাকিল ও অফিসাররা বার বার ধমক দিয়ে সৈন্যদের দরবারে ফিরে আসতে বলতে থাকে, এর ভেতর সেনাপ্রধানের সাথে ফোনে কথা হয়। এর কিছু পরেই এক পশলা গুলি ছুটে আসে, কিছু গুলি নরম দেয়াল-পার্টিশন কাচের দরজা ভেদ করে শাকিলসহ অন্যদের দেহে বিদ্ধ হয়, অনেকেই মাটিতে শুয়ে প্রাণে রক্ষা পান, কর্নেল কামরুজ্জামানসহ অনেকে স্টেজের পাসের উইংসে ঢুকে পরে গুলির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। হাজার হাজার গুলি নিক্ষিপ্ত হলেও কোনো বিদ্রোহীকেই দরবার হলে ঢুকে গুলি করতে দেখা যায়নি। দরবার হল লক্ষ্য করে হাজার হাজার গুলি নিক্ষিপ্ত হলেও অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তার গায়ে কোনো গুলি লাগেনি। হত্যাকারীরা হত্যা নিশ্চিত করতে একবারও হলে  ঢোকেনি বা লক্ষ্য স্থির করে গুলি করতে দেখা যায়নি। বিডিআরের ১৬ হাজার উচ্ছৃঙ্খল জোয়ানের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারায় বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বিদ্রোহী জোয়ানরা হত্যা ছাড়াও পিলখানার অভ্যন্তরে বসবাসরত বিডিআর কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার-পরিজনকে জিম্মি করে।

এ ছাড়াও এই হত্যাকাণ্ডে বিদ্রোহী বিডিআরের গুলিতে কয়েকজন পথচারী ও ছাত্র নিহত হয়। কিছু রক্তপিপাসু সৈনিক ঘটনার পর পরই শাকিলের বাসভবন আক্রমণ করে, অগ্নিসংযোগ-লুণ্ঠন করে। এতে মিসেস শাকিল নিহত হয়। সন্ধ্যার পর কিছু দুষ্কৃতকারী সৈনিক কিছু অফিসারের বাসা লুণ্ঠনের সময় কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। তবে ভিতরে আটকে পড়া শিশু ও মহিলাদের বিডিআর সদর দপ্তরের ভিতর থেকে বের করে আনা সম্ভব হয়েছিল।

ঘটনার পরে ২৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে বিডিআরের সদস্যদের একাংশ আত্মসমর্পণ করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত বিডিআর ক্যাম্পে উত্তেজনার খবর পাওয়া যায়। ঐদিন প্রধানমন্ত্রী জাতীর উদ্দেশে ভাষণে বিডিআরকে আবারো তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার আশ্বাস প্রদান করেন।

Tag :
সর্বাধিক পঠিত

গুপ্টিতে আদালতের আদেশ অমান্য করে চলাচলের রাস্তায় ওয়াল নির্মাণ করায় ফরিদগঞ্জ থানা রিসিভার গ্রহণ করে

আজ ভয়াল ২৫ ফেব্রুয়ারি

আপডেট: ০৪:৫৫:১৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০
অনলাইন ডেস্ক:

আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের সেই কালো দিন। ১১ বছর আগে এই দিনে পিলখানায় সাবেক বিডিআর ও বর্তমান বিজিবি সদর দপ্তরে ঘটে গেছে ইতিহাসের এক নির্মম ও নৃশংস ঘটনা। তখন সকাল ৯টা ২৭ মিনিট। দরবার হলে চলমান বার্ষিক দরবারে একদল বিদ্রোহী বিডিআর সৈনিক ঢুকে পড়ে। সিপাহি মঈন নামে একজন বিডিআর সদস্য মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা। বিডিআরের বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলে। পুরো পিলখানায় এক নারকীয় ও বীভৎস ঘটনার সৃষ্টি করে তারা। এ সময় তারা ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিজিবি’র সদর দপ্তর পিলখানায় সেদিন বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর কোনো বাহিনীর বিদ্রোহের ইতিহাসে পাওয়া যায় না।

পিলখানায় নারকীয় হত্যার ঘটনায় দায়ের করা হয় দুটি মামলা। এর মধ্যে সেনা কর্মকর্তাদের নিহতের ঘটনায় দণ্ডবিধি আইনে করা হয় হত্যা মামলা। অপরটি হয় বিস্ফোরক আইনে। দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতের দেয়া ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয়। ৮ জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও ৪ জনকে খালাস দেয়া হয়। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। হাইকোর্টে আপিল চলার সময়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়। খালাস পান ১২ জন আসামি। চূড়ান্ত বিচার কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় এখনও সাজা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি দোষীদের। বর্তমানে বিডিআর হত্যামামলায় হাইকোর্টের আদেশের কপির অপেক্ষায় আছে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ। হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের কপি হাতে পেলে দুপক্ষই এ মামলায় আপিল করবে বলে জানা গেছে।

পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে শহীদ ব্যক্তিদের স্মরণে আজ মঙ্গলবার শাহাদাতবার্ষিকী পালন করবে বিজিবি। দিনের কর্মসূচিতে রয়েছে- পিলখানাসহ বিজিবি’র সব রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় বাদ ফজর খতমে কোরআন, বিজিবির সব মসজিদে এবং বিওপি পর্যায়ে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় সকাল ৯টায় বনানীর সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ৩ বাহিনীর প্রধান (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক (একসঙ্গে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া আসামিকাল বুধবার বাদ আসর পিলখানার বীর উত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার মিলনায়তনে শহীদ ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

এছাড়া, স্বরাষ্ট্র সচিব, বিজিবি মহাপরিচালক, শহীদ ব্যক্তিদের নিকটাত্মীয়রা, পিলখানায় কর্মরত সব কর্মকর্তা, জুনিয়র কর্মকর্তা, অন্যান্য পদবির সৈনিক ও বেসামরিক কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করবেন।

গতকাল সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গত ৮ জানুয়ারি আলোচিত বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত এ মামলায় ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশিত হয়। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চের ওই তিন বিচারপতি রায়ে স্বাক্ষর করার পর তা সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

জানা গেছে, প্রথমে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি মো. শওকত হোসেন মূল রায় লেখেন। তিনি প্রায় সাড়ে ১১ হাজার পৃষ্ঠার রায় লিখে বেঞ্চের অন্য দুই বিচারপতির কাছে পাঠান। এরপর বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী পৃথকভাবে তার অংশ লিখেছেন। তিনি লিখেছেন প্রায় ১৬ হাজার পৃষ্ঠা। এরপর বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার লিখেছেন এক হাজার ১০০ পৃষ্ঠা। এই তিনজনের লেখা রায় একত্র করে তা চূড়ান্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আসামির ফাঁসির আদেশসংবলিত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে।

নিয়ম অনুযায়ী হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পর আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবে উভয়পক্ষই। এরপর আপিলের বিচারের মধ্য দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে। যদিও এরপর রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না। এই নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কারণে ‘বিডিআর’ নামটি পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) করা হয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুব আলম বলেন, হাইকোর্টের রায়ে ২৮৩ জনকে খালাস দেয়া হয়েছে। আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর তাদের ব্যাপারে আপিল করবে রাষ্ট্রপক্ষ।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন। চূড়ান্ত রায় প্রকাশিত হলেও তাদের কাছে এখনো সার্টিফাইড কপি হাতে এসে পৌঁছেনি। ওই কপি হাতে পেলেই সাজাপ্রাপ্তদের খালাস চেয়ে আপিল করা হবে।

বিস্ফোরক দ্রব্য মামলা

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলা এখনো নিম্ন আদালতের গণ্ডিই পেরোতে পারেনি। এই মামলা সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বিস্ফোরক আইনের মামলাটি। এই মামলায় আসামি রয়েছেন ৮৩৪ জন। এর মধ্যে একজন সিভিলিয়ান, বাকি আসামিরা বিডিআরের জওয়ান। এই মামলায় আসামিদের মধ্যে ২৪ জন মারা গেছেন। জীবিত আসামি ৭৯০ জন। পলাতক রয়েছেন ২০ জন আসামি। এই মামলায় ১৪৬ জন সাক্ষী দিয়েছেন, রাষ্ট্রপক্ষের প্রায় ১২ শত সাক্ষী রয়েছে। আসামি ৮ মার্চ পরবর্তী সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহনের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। মামলার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়া প্রসঙ্গে এই মামলার আইনজীবী  ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ বাহারুল ইসলাম বলেন, বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। তবে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে খুব একটা উপস্থিত হচ্ছেন বলে এর বিচার প্রক্রিয়া ধীর গতিতে হচ্ছে। তবে এই মামলায় সব সাক্ষী প্রয়োজন নেই। মোটামুটি একটা পর্যায়ে গেলেই এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। আশা করছি এ বছরের মধ্যে এই মামলার রায় দেয়া সম্ভব হবে।

বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, নিরাপত্তার কারণে বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলার বিচার সম্পন্ন করতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। প্রায় এক কোটি টাকা খরচ করে পুরান ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়েছে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামীম সরদার বলেন, উচ্চ আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। তবে বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলা চলছে ধীরগতিতে। এতে অনেক আসামিকে কারাগারে বন্দি থাকতে হচ্ছে।

নিহতদের স্বজনদের অনেকেই বলেছেন যে, তারা রায়ের বাস্তবায়ন দেখতে চান। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি বলে দাবি করেছেন পিলখানা ট্র্যাজেডিতে নিহত মেজর মমিনুল ইসলাম সরকারের বোন নূরজাহান চৌধুরী।

শহীদ কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদের বড়বোন দিলরুবা খাতুন বলেন, বিচারের রায় হয়েছে। তা দ্রুত এখন কার্যকর করা দরকার। আমরা বিচারকাজ দ্রুত শেষ করার দাবি জানাচ্ছি।

শহীদ মেজর তানভীর হায়দার নূরের বাবা নূর মোহাম্মদ বলেন, ছেলেকে হারিয়েছি। এখন বিচার চলছে। কিন্তু ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না।

মেজর মিজানুর রহমানের বৃদ্ধ মা কহিনূর বেগম ছেলের স্মৃতিচারণ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ঘটনার দিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে আমাকে বলে, মা তুমি সামিকে (মিজানের ছেলে) দেখ। এরপর আমার বাবা আমাকে আর মা ডাকল না। আর কথা বলল না। সামির বয়স তখন তিন। এখন সামি স্কুলে যায়। কিন্তু মিজান কিছুই দেখতে পেল না।

মিজানুরের বড় ভাই সেনাবাহিনীতে কর্মরত লে. কর্নেল ফেরদৌস বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী সদরে। দেশপ্রেম থেকেই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছি। মিজান আমার ছোট। ঘটনার আট মাস আগে ওর স্ত্রী রেবেকা ফারহানা রোজী মারা যায়। তাদের দুই ছেলে। বড় ছেলে তাহসিন রহমান রামি (১৬) ও ছেটে ছেলে ফারজিন রহমান সামি (১১)। আমিই এখন দুই ছেলের দেখাশোনা করি। ছোট ছেলেটা মায়ের কাছে থাকে।

তিনি বলেন, ছেলে দুটির মুখের দিকে তাকালে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। ওদের তো কেউ নেই। বাবা-মা সব আল্লাহ নিয়ে গেছে। আমার বৃদ্ধা মা এই কষ্ট কীভাবে সহ্য করবেন?

শহীদ মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছোট বোন রুবিনা নেসা নিনি বলেন, এর নেপথ্যে কারা তা জানা দরকার। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।

কী ঘটেছিল সেদিন?

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা পিলখানা এলাকায় অবস্থিত বিডিআর সদর দপ্তরে বিডিআর থেকে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের কর্তৃত্বের অবসান, রেশন ও বেতনবৈষম্য দূর করাসহ বেশ কিছু দাবিতে সশস্ত্র বিদ্রোহ করে। অনেকেই নানাভাবে সেদিনের দরবার হলের ঘটনার বিবরণ দেন, কিন্তু সেগুলো পরে ঘটনার নিষ্ঠুরতা জানার পর এবং স্বজনের কান্নাকাটিতে পরিস্থিতির চাপে কিছুটা মোটিভেটেড বলে মনে হয়েছে। বিপুলসংখক বীভৎস মৃতদেহ দেখে তীব্র প্রতিক্রিয়া, আবেগের ভেতর থেকে আসল সত্য বের করে আনা সত্যই কঠিন ছিল। কিন্তু কেন এ হত্যাযজ্ঞ, এই ঘটনা কি পূর্ব পূর্বপরিকল্পিত? না নিছক উত্তেজনার বসে? কী ঘটেছিল সেদিন?

বিডিআর সৈনিকদের চাপা ক্ষোভ অনেক বছর আগে থেকেই ছিল। নবনির্বাচিত সরকার অপেক্ষাকৃত কম রক্ষণশীল, কম সেনা তোষণকারী এবং উদার মনে হওয়া প্রধানমন্ত্রীকে বেশ কিছুদিন আগেই তৈরি করা মূল তিনটি দাবিসহ ৬ দফা দাবিসহ একটি স্মারকলিপি দেয়ার উদ্যোগ চলছিল, তাদের ধারণা হয়েছিল নবনির্বাচিত আওয়ামী সরকারই তাদের জুলুম কিছুটা নিরসন করতে পারবে। কিছুদিন আগে স্থানীয় সাংসদ তাপস জিগাতলা দলীয় ক্যাম্পে এলে তার কাছে কিছু সৈনিক পরামর্শের জন্য আসে, তিনি শুধু রেশনের ব্যাপারটা ছাড়া অন্য ব্যাপারগুলো তার আওতার বাইরে বলে জানান। পরে তাদেরকে প্রপার চ্যানেলে যাওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়। পরে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেয়েও কোনো সুবিধা পায়নি। এরপরের মাসে বিডিআর সপ্তাহে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ডিজি শাকিল এভাবে দেওয়া ঠিক হবে না মন্তব্য করেন, নিজেই প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে কথা বলবেন বলে মত দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী প্যারেডে সালাম গ্রহণ করার জন্য পিলখানায় আসলে তিনি তা দেননি বা আলোচনার চেষ্টাও করেননি।

পরদিন সকালে দরবার হলে পূর্ব নির্ধারিত বিডিআর ডিজি শাকিলের বক্তব্য শুরু করার কিছুক্ষণ পরই উত্তেজনা বািবতণ্ডা। স্মারকলিপি কেন দেওয়া হয়নি, ইউএন মিশনে না নেওয়া, ডাল-ভাত, শপিংমলের হিসাব, সীমান্তের চোরাই মাল আটকের-লুণ্ঠনের ভাগ আফিসার সৈনিক অনুপাত ৮৯:১১ কেন? ৬০:৪০ চাই। এসবের কোনো সুরাহা না হওয়ায় একটা হট্টগোলের সূত্রপাত। উচ্চস্বরে ধমকের শব্দ। এরপর ডিজি শাকিল এভাবে হৈচৈ না করে একজনকে সামনে এসে বক্তব্য দিতে বলেন। সামনে একজনের জায়গায় দুজন এসেছিল বলে জানা যায়। বািবতণ্ডায় একপর্যায়ে একজন জোয়ানকে স্টেজের ওপরে দেখা যায়। হুমকির সুরে কিছু একটা বলে অ্যাবাউট টার্ন করে চলে যেতে চায়। তখন একজন অফিসার তাকে ধরে ফেলে, বলে— ‘কি বলছ পাগলের মতো’ অপমানিত ডিজি শাকিলের হাতে পিস্তল। হট্টগোলের ভেতর স্টেজের সৈনিকটি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখা যায়। সাধারণ সৈনিকরা স্বাভাবিকভাবেই ভুল বোঝে যে, লুটিয়ে পরা সৈনিকটি বুঝি শাকিলের গুলিতেই মারা গেছে। এরপর উপস্থিত সৈনিকরা একযোগে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। সবাই হল ছেড়ে চলে যায়। এর পরের ঘটনা ভয়াবহ। সৈনিকরা দরবার হল ত্যাগ করার পর বাইরে গুজব ছড়িয়ে যায় যে জে. শাকিল এক সৈনিককে গুলি করে হত্যা করেছে। এরপর সংঘবদ্ধ হয়ে অস্ত্রাগার রক্ষীকে মারধর করে চাবি কেড়ে নিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বের করা, ভিন্ন আরেকটি গোলাবারুদের গুদাম থেকে গুলিভর্তি ম্যাগাজিন তুলে নেওয়া হয়। একটি দল দরবার হলের দিকে যায়, এরপর প্রথম গুলিবর্ষণের শব্দ, অটোমেটিক রাইফেলের ব্রাশফায়ার। প্রত্যক্ষদর্শী সৈনিকের বক্তব্যে জানা যায়, হত্যাকারীরা প্রথমে আকাশের দিকে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে, পরে উত্তেজনা বেড়ে গেলে কয়েক জন দরবার হলের দেয়াল, বদ্ধ দরজা-জানালা লক্ষ করে এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ার করতে থাকে। ডিজি শাকিল ও অফিসাররা বার বার ধমক দিয়ে সৈন্যদের দরবারে ফিরে আসতে বলতে থাকে, এর ভেতর সেনাপ্রধানের সাথে ফোনে কথা হয়। এর কিছু পরেই এক পশলা গুলি ছুটে আসে, কিছু গুলি নরম দেয়াল-পার্টিশন কাচের দরজা ভেদ করে শাকিলসহ অন্যদের দেহে বিদ্ধ হয়, অনেকেই মাটিতে শুয়ে প্রাণে রক্ষা পান, কর্নেল কামরুজ্জামানসহ অনেকে স্টেজের পাসের উইংসে ঢুকে পরে গুলির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। হাজার হাজার গুলি নিক্ষিপ্ত হলেও কোনো বিদ্রোহীকেই দরবার হলে ঢুকে গুলি করতে দেখা যায়নি। দরবার হল লক্ষ্য করে হাজার হাজার গুলি নিক্ষিপ্ত হলেও অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তার গায়ে কোনো গুলি লাগেনি। হত্যাকারীরা হত্যা নিশ্চিত করতে একবারও হলে  ঢোকেনি বা লক্ষ্য স্থির করে গুলি করতে দেখা যায়নি। বিডিআরের ১৬ হাজার উচ্ছৃঙ্খল জোয়ানের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারায় বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বিদ্রোহী জোয়ানরা হত্যা ছাড়াও পিলখানার অভ্যন্তরে বসবাসরত বিডিআর কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার-পরিজনকে জিম্মি করে।

এ ছাড়াও এই হত্যাকাণ্ডে বিদ্রোহী বিডিআরের গুলিতে কয়েকজন পথচারী ও ছাত্র নিহত হয়। কিছু রক্তপিপাসু সৈনিক ঘটনার পর পরই শাকিলের বাসভবন আক্রমণ করে, অগ্নিসংযোগ-লুণ্ঠন করে। এতে মিসেস শাকিল নিহত হয়। সন্ধ্যার পর কিছু দুষ্কৃতকারী সৈনিক কিছু অফিসারের বাসা লুণ্ঠনের সময় কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। তবে ভিতরে আটকে পড়া শিশু ও মহিলাদের বিডিআর সদর দপ্তরের ভিতর থেকে বের করে আনা সম্ভব হয়েছিল।

ঘটনার পরে ২৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে বিডিআরের সদস্যদের একাংশ আত্মসমর্পণ করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত বিডিআর ক্যাম্পে উত্তেজনার খবর পাওয়া যায়। ঐদিন প্রধানমন্ত্রী জাতীর উদ্দেশে ভাষণে বিডিআরকে আবারো তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার আশ্বাস প্রদান করেন।