দীর্ঘদিন সম্পর্কের সূত্র ধরে মাঝে মধ্যেই সাভারের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) সামসুদ্দোহা খান মজলিশের বাড়িতে যাতায়াত করতেন সুবল কুমার রায়। একপর্যায়ে মজলিশের বড় মেয়ে শামীমা খান মজলিশ ওরফে পপির সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন সুবল। ঘটনা জানাজানি হলে ওই বাড়িতে আসামি সুবলের যাতায়াত বন্ধ করে দেন পপির মা ভিকটিম সেলিমা খান মজলিশ।
এরপরও গোপনে যোগাযোগ ছিল সুবল-পপির। একদিন ভোরে সুবলকে দেখে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন সেলিমা খান মজলিশ। পরে পপির সহায়তায় সুবল গলায় ছুরিকাঘাত করে সেলিমার। পরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে ভিকটিমের মাথায় দেওয়া হয় ইলেকট্রিক শক। মুমূর্ষু অবস্থয় চার দিন হাসপাতালে থাকার পর মারা যান সেলিমা।
দীর্ঘ ১৩ বছর পর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর ধানমন্ডি পিবিআই হেডকোয়ার্টার্সে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার এসব তথ্য জানান।
পিবিআইপ্রধান বলেন, সেলিমা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এরইমধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা সবাই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। গ্রেফতাররা হলেন- ইলেকট্রিশিয়ান সুবল কুমার রায় (৫০), ভিকটিমের নিজ কন্যা শামীমা খান মজলিশ ওরফে পপি (৫৭) এবং গৃহকর্মী আরতি সরকার (৬০)। সাভারের ভাগলপুর এবং পাকিজা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, দীর্ঘদিন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন না হওয়ায় একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় মামলার তদন্ত কাজ। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে নির্দেশনা আসে। আমরা ঘটনার তদন্ত শুরু করি। ভিকটিমের বড় মেয়ে পপির পাশাপাশি বাকি দুই মেয়েকেও সন্দেহের মধ্যে রাখি। জানতে পারি, একজন ইলেকট্রিশিয়ান মাঝে মাঝে ওই বাসায় আসতেন। কিন্তু বহুদিন ধরে তার ওই বাসায় আসা-যাওয়া নেই। আরও জানতে পারি, তিনি গত ৩০ বছর ধরে সাভারে ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন। সেই সঙ্গে তার একটি বড় মুদির দোকানও আছে।
পিবিআইপ্রধান বলেন, তদন্তকালে যেসব তথ্য জানতে পারি তার মধ্যে বাসার সুইচ বোর্ডটি ভাঙা এবং সেখান থেকে দুটি তার বের করে রাখার একটা বিষয় উঠে এসেছিল। এরপর আমরা আসামি ইলেকট্রিশিয়ান সুবল কুমার রায়কে নিয়ে আসি। সুবল জানান- সাবেক সংসদ সদস্য সামসুদ্দোহা খান মজলিশ তাকে পছন্দ করতেন। তাই তিনি মাঝে মধ্যে ওই বাসায় যাতায়াত করতেন। বাড়ির ইলেকট্রিকের কাজও করে দিতেন তিনি। ১৯৯৮ সাল থেকে সুবল কুমার ওই বাড়িতে যাতায়াত করতেন।
আদালতে দেওয়া সুবলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে বনজ কুমার জানান, ভিকটিম সেলিমা খান মজলিশের (৬৩) বড় মেয়ে পপি তার স্বামীকে নিয়ে নিচতলায় বসবাস করতেন। ২০০১ সালে সুবল এবং পপি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। ২০০৫ সালে জানাজানি হলে সুবল কুমার রায়কে মারধর এবং অপমান করে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাকে আর ওই বাসায় যেতে নিষেধ করা হয়। ২০০৮ সালে সুবল বিয়ে করেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি আবার সেই বাসায় যাতায়াত শুরু করেন। ২০১১ সালের ১৪ জুন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঘটনার দিন ফজরের নামাজের সময় ভিকটিম সেলিমা খান মজলিশ ছাদে উঠেছিলেন এবং সেখান থেকে দেখতে পান সুবল কুমার রায় চুপিচুপি তার বাড়ির দিকে আসছেন। সুবলকে দেখে তিনি চিৎকার করতে করতে নিচে নামছিলেন। তখন আসামি সুবল এবং পপি মায়ের চিৎকার থামাতে ওপরে যান। মাকে থামানোর জন্য পপি তাকে জাপটে ধরেন। পাশে থাকা একটি ফল কাটার চাকু দিয়ে গলার দুই পাশে তিনটি পোচ দেন। পরে সুবল ইলেকট্রিক বোর্ড ভেঙে সেখান থেকে দুটি তার বের করে ভিকটিমের মাথায় ইলেকট্রিক শক দেয়।
পিবিআইপ্রধান আরও বলেন, জবানবন্দি থেকে জানা যায়- ২০১১ সালের ১৪ জুন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। বাসার ডাইনিং রুমে ভিকটিমের গলার দুই পাশে ফল কাটার ছুরি দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত অবস্থায় ভিকটিমকে তার প্রতিবন্ধী ছেলে সেতুর কক্ষে নেওয়া হয়। সেখানে খাটের চাদরের উপরে একটি পুরাতন পত্রিকা বিছিয়ে ভিকটিমের মাথার কাছে দুটি বালিশ দিয়ে চাপা দিয়ে এবং ঘাড়ের নিচে তোশক দিয়ে শুইয়ে রেখে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন আসামিরা।