• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ৯ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
সর্বশেষ আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

শিশু ধর্ষণ ও হত্যা বিপদ জনকভাবে বাড়ছে

অনলাইন ডেস্ক
[sharethis-inline-buttons]
মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম এমপি।

অনলাইন ডেস্ক:

শিশু ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যা, মামলা করতে গেলে ওই শিশুর পরিবারকে হুমকি-ধমকি দেওয়া কোনোভাবেই থামছে না। গত দুদিনে দেশে ১০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৫ শিশুর বয়স ৭ বছরের নিচে। দেড় বছরের শিশুকেও ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ফেনী, কেরানীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, পঞ্চগড়, বগুড়া ও নরসিংদী প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে এসব জানা গেছে।

এদিকে শিশু অধিকার ও মানবাধিকার সংগঠন শিশু অধিকার ফোরাম, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি এবং মানুষের জন্য করিসহ বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গত ৫ বছরে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার হার আশঙ্কাজনক। গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রথম ছয় মাসে শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা এবং শিশুদের ওপর অন্যান্য যৌন নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ডসংখ্যক বেড়েছে। এ বছর জুলাই পর্যন্ত প্রথম সাত মাসে ৫৭২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যার মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে অন্তত ২৩ জনকে। এতে বলা হয়েছে, ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ৮৪ জন শিশুর ওপর এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৭৫ জন শিশু। এসব সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত দুই মাসে ধর্ষণের ঘটনা আরও বেড়েছে।

সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিদিন শিশু এবং নারী ধর্ষণের খবরে মানুষের মধ্যে একটা সহনীয়তা চলে আসছে। আমরা শিশুর উচ্চশিক্ষা, আর্থিক উন্নয়ন নিয়ে সবাই ব্যস্ত। কিন্তু যেখানে দেড় বছরের শিশুর নিরাপত্তা নেই সেই সমাজ এবং রাষ্ট্রকে কিছুদিন পর বিশ^ গ্রহণ করতে চাইবে না। তারা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সব জায়গায় বিষয়টি নিয়ে সচেতন হওয়া এবং কথা বলার সময় হয়ে গেছে। সবাইকে বলতে হবে শিশু এবং নারী সর্বোপরি ধর্ষকের সমাজ আমাদের জন্য নিরাপদ নয়।

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, সমাজের অবক্ষয়ের ধারাবাহিকতার কুফল হলো প্রতিদিন শিশু এবং নারী ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের প্রভাবশালীদের দায়হীনতার বোঝা টানছে অবুঝ শিশুরা।

এখনো সময় আছে, সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে ধর্ষণের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে হবে। না হয় এই এত এত উন্নয়ন, চাকচিক্য সবই শূন্য হয়ে যাবে। কারণ রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান পরিবার কেউই এই দায় থেকে মুক্ত থাকতে পারবে না। আমাদের শিশু-কিশোরদের ওপর এই ধর্ষণের ঘটনা বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ইতোমধ্যে আমরা কিশোর গ্যাং দেখছি। তিনি বলেন, ধর্ষকের বিচার হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক।

মনোবিজ্ঞানী ডা. মেহতাব খানম দেশ রূপান্তরকে বলেন, এত অনিরাপদ যদি দেড় বছরের শিশুটিও হয়ে যায় তাহলে সমাজ কোথায়। মাদকের মতোই এটি সংক্রমিত হচ্ছে। এতে অভিভাবকরা শুধু কন্যা শিশুই নয়, তাদের যেকোনো শিশু-কিশোরকে নিয়েই আতঙ্কিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে শিশুদের ধারণা দিতে হবে। টিভি এবং মিডিয়ায় সচেতনতামূলক

অনুষ্ঠান বাড়াতে হবে। না হয় আগামী ১০ বছরে আমাদের শিশু-কিশোরদের মধ্যে যেসব ভালো সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার কথা তার উল্টোটা হবে। তিনি বলেন, এখানে ধর্ষকদের শাস্তি পাওয়াটা জরুরি। কারণ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় একজন ধর্ষককে দেখে আরও অনেকে উৎসাহিত হয়। তারা মনে করে, এটা কোনো অপরাধ নয়। কারণ জৈবিক চাহিদা খাবারের ক্ষুধা অনুভব হওয়ার মতোই। এই ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা জরুরি। তিনি বলেন, এখন ছেলে শিশুরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এটাও আরও বাড়বে। ভয়াবহ পরিস্থিতি ঠেকাতে হলে সবাইকে নামতে হবে। আমাদের প্রধান দাবি শিশুদের নিরাপত্তা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, সামাজিক নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের অভাবে খুন, ধর্ষণসহ নানা ধরনের সামাজিক অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলছে। তিনি বলেন, প্রতিদিনই একাধিক শিশু ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক।

টেলিভিশন দেখানোর কথা বলে পাঁচ বছর বয়সী শিশু ধর্ষণ : ফেনীর ছাগলনাইয়ায় টেলিভিশন দেখানোর কথা বলে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় মো. আবু তাহের (৬২) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত মঙ্গলবার ফেনীর বিচারিক হাকিম আদালতে ওই শিশু ২২ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। গ্রেপ্তার আবু তাহেরকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। শিশুটি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছাগলনাইয়া থানার ওসি মেজবাহউদ্দিন আহমেদ জানান, গ্রেপ্তার আসামি আবু তাহেরকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ ও আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি প্রদান শেষে শিশুকে তার বাবার হেফাজতে দেওয়া হয়েছে।

মানিকগঞ্জে ৬ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার : মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় ছয় বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ঘটনায় শিশুর চাচাতো ভাই জাহিদ হোসেনের (১৮) নামে মামলা হয়েছে। গত মঙ্গলবার বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। শিশুকে উদ্ধার করে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জলিল বলেন, ধর্ষণের শিকার শিশু ও ধর্ষক সম্পর্কে চাচাতো ভাইবোন ও পাশাপাশি বাড়ি। ঘটনার সময় শিশুর বাড়িতে লোকজন না থাকার সুযোগে চাচাতো ভাই বোনকে ধর্ষণ করে। ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তি ৯৯৯ নাম্বারে ফোন করে জানান। বিষয়টি সাটুরিয়া পুলিশকে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার নেওয়ার নির্দেশ আসে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শিশু ও তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়।

শিশুকে কোলে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা : মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার চৌরায়াবাড়ি গ্রামে আত্মীয়ের দেড় বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে ধর্ষণচেষ্টা চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রক্তপাত হতে থাকলে তাকে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত মঙ্গলবার সকালে এ ঘটনার পর গতকাল বুধবার দুপুরে রাজৈর থানায় মামলা হয়েছে।

হাসপাতালে শিশুর মা ও মামা জানান, রাজৈর উপজেলার চৌরাশি গ্রামের আত্মীয় সুষেন ভক্তের ছেলে হৃদয় ভক্ত (২১) বাড়িতে বেড়াতে আসে। গত মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে দেড় বছরের শিশু মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। অনেক সময় পর আবার শিশুকে নিয়ে বাড়িতে আসে।

পঞ্চগড়ে সাত বছরের শিশুকে ধর্ষণ : পঞ্চগড় জেলা শহরের পশ্চিম মোলানি এলাকার ৭ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় আশরাফ আলী (৫৮) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত মঙ্গলবার দুপুরে শিশুকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়। আশরাফ শিশুর সম্পর্কে প্রতিবেশী দাদা। চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা শিশুকে উদ্ধার করে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করে এবং আশরাফকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

মঙ্গলবার রাতে শিশুর বাবা বাদী হয়ে আশরাফকে আসামি করে পঞ্চগড় সদর থানায় ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আশরাফকে বুধবার জেলহাজতে পাঠানো হয়।

চার শিশু ধর্ষণ ভ্যানচালকের : বগুড়ার ধুনটে গাছ থেকে জলপাই পেড়ে দেবে বলে ডেকে নিয়ে চার শিশুকে ধর্ষণ করেছে এক ভ্যানচালক। চার শিশুকে প্রথমে ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এ ঘটনায় ভ্যানচালক জয়নাল আবেদীনকে (৫৫) আটক করে পুলিশে দিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার কথা স্বীকার করেছে জয়নাল।

স্থানীয়রা জানায়, ধুনট উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের গোপালপুর খাদুলী গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন তিন সন্তানের জনক। তার স্ত্রী ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। এ কারণে বাড়িতে একাই থাকত সে। জয়নাল গত শুক্রবার দুপুরে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়–য়া তার প্রতিবেশী দুই শিশুকে এবং রবিবার দুপুরে প্রথম শ্রেণির ছাত্রী দুই শিশুকে ধর্ষণ করে। ওই দুই ঘটনায় ধুনট থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে।

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গাজিউর রহমান জানান, আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে। ওই চার শিশুকে শারীরিক পরীক্ষার জন্য ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

শিবপুরে অপহরণ করে শিশুকে দল বেঁধে ধর্ষণ : নরসিংদীর শিবপুরের শিশুকে অপহরণ করে দল বেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় প্রধান আসামি জাকির হোসেনকে (৩৭) গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-১১। গত সোমবার রাতে নরসিংদী শহরের সাহেপ্রতাপ ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত মঙ্গলবার বিকেলে র‌্যাব-১১ থেকে পাঠানো অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপ থেকে জানা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলায় সাজা হয় মাত্র ১.৩৬ শতাংশ আসামির এবং বাকি ৯৮.৬৪ শতাংশ বেকসুর খালাস পায়। ওই আইনের আওতায় ১ লাখ ৮০ হাজারের ওপর মামলা আদালতে বিচারের অপেক্ষায়।

শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা ২৭২টি সংগঠনের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বা বিএসএএফের নির্বাহী পরিচালক আবদুস শাহিদ মাহমুদ বলেন, ২০১৮ সালে প্রতিদিন গড়ে ১৩ শিশু নির্যাতন, দুই শিশু ধর্ষণ এবং এক শিশু হত্যার শিকার হতো। ২০১৭ সালের চেয়ে ২০১৮ সালে শিশু ধর্ষণ-গণধর্ষণ বেড়েছে অন্তত ৩৪ শতাংশ। এর বাইরেও বহু অপরাধের ঘটনা নিত্যদিনই ঘটে। সেসব ঘটনা রেকর্ডহীন বলে স্থান পায় না থানার হিসাবে। এ বছর শিশু ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপকহারে বেড়েছে।

Sharing is caring!

[sharethis-inline-buttons]

আরও পড়ুন

error: Content is protected !!