অনলাইন ডেস্ক:
মোদি সরকার গত ৫ আগস্ট অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের ওপর থেকে বিশেষ মর্যাদা তুলে নেয়ার পর থেকেই কাশ্মীরি নারীদের আপন করে কাছে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ভারতীয় পুরুষেরা। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের ঘটনাকে তারা নাকি কাশ্মীরের সুন্দরী নারীদের এতদিন পর ভোগ করার সুযোগ হিসেবেই দেখছে। তাই বুঝি গত ৫ আগস্ট অমিত শাহের এই ঘোষণার পরপরই গুগলে ‘কাশ্মীরি গার্ল’সার্চ করতে শুরু করেছেন সেখানকার পুরুষেরা। কেবল সাধারণ পুরুষ নয়, বিভিন্ন নেতা এমনকি খোদ মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত কাশ্মীরি নারীদের বিয়ে করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। আর নিজেদের এসব বিকৃত বাসনা গোপন করার কোনো চেষ্টাই তারা করেননি। বরং জন সমাবেশে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ঘোষনা করেছেন।
হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাত্তার গত শুক্রবার এক জনসভায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘আমাদের পথের কাঁটা সরে গেছে। এখন কেবল বিহার থেকে নয়, আমরা এখন কাশ্মীর থেকেও মেয়ে আনতে পারবো।’
এই পরিস্থিতিতে কাশ্মীরি নারীদের ওপর ভারতীয় সেনাদের ধর্ষণসহ নানা নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরেছেন পশ্চিমবঙ্গে স্কুল শিক্ষিকা জিনাত রেহেনা ইসলাম। বুধবার তার লেখা‘কাশ্মীরের কলি তা হলে হাতের নাগালেই’শিরোনামের নিবন্ধটি প্রকাশ করেছে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাটি।
নিবন্ধের শুরুতেই তিনি লিখেছেন, ‘আন্তর্জালে কাশ্মীরি মেয়ে ও ‘ম্যারি কাশ্মীরি গার্ল’ সার্চ করে বিশ্ব কাঁপালেন আপনারা। ভাগ্যিস, গুগল ছিল! নইলে জানাই যেত না আপনাদের এমন সৌন্দর্যবোধের কথা। আপনাদের দেখার চোখও এত সুন্দর! তবে কী জানেন, যে মেয়েদের জন্য আপনারা এত উতলা হয়ে উঠেছেন, তাদের কোমরে বন্দুকের বাটের দাগটা বোধহয় আপনাদের চোখে পড়েনি, না? পিঠে ভারী মেটাল বেল্টের কালশিটেও আপনাদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু মুখে নেকড়ের আঁচড়ের মতো সেই দগদগে ক্ষতটাও কী করে চোখ এড়িয়ে গেল?’
এরপরই তিনি সেখানকার নারীদের ওপর ভারতীয় সেনাদের গণধর্ষণের ঘটনাগুলো বর্ণনা করেছেন। তার ভাষায়, ‘আসুন, আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই আরও কয়েক জন কাশ্মীরি মেয়ের সঙ্গে। ওই মহিলাকে দেখছেন? খেতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। এখন সেখানেই বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে আছেন। বাড়িতে রয়েছে ওঁর পাঁচ বিবাহযোগ্য কন্যা। বেচারা এই অপমান সইতে পারলেন না। হাসপাতালে যাওয়ার পথেই মারা গেলেন! আচ্ছা, আপনি কি কারও গোঙানি শুনতে পাচ্ছেন?
ওই দেখুন, আর এক কাশ্মীরি মেয়ে! বুটের আঘাত আর অত্যাচারে রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছিল না। ওঁর পেটে ১০টি সেলাই পড়েছে। ওই যে, আর এক মেয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। বন্দুকের নলের আঘাতে জরায়ুতে গভীর ক্ষত। এখন পচতে শুরু হয়েছে। প্রাণে বাঁচতে গেলে জরায়ু কেটে বাদ দিতে হবে। এই মহিলা কোনও দিন আর মা হতে পারবেন না।
দূরের ওই গ্রাম দু’টি দেখতে পাচ্ছেন? কুনান ও পোশপোরা। সেখান থেকেই এক রাতে ৩২ জন মেয়ে উধাও হয়ে যান। দৃষ্টিহীন বৃদ্ধ বাবা কাঁদছেন! পাগলের মতো স্বামী খুঁজছেন। সন্তানদের কান্না থামানো যাচ্ছে না। কী অপরূপ দৃশ্য, তাই না? ওই যে, আর এক কাশ্মীরি ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে রয়েছে। তাকে করাত দিয়ে কাটা হয়েছে। ত্রেহগামের সরকারি বিদ্যালয়ের গবেষণাগারের সহকারীর কপালে আর কী-ই বা জুটত? আর ক্রালখুদের অর্চনা কিংবা শিক্ষা বিভাগের সেই নারী কর্মকর্তা? পরিবারের সকলের সামনেই চলে অত্যাচার এবং শেষতক হত্যা!
গুরিহাকার সেই মেয়ের কথা মনে আছে? ভরা পরিবারে শ্বশুর ও ননদের সঙ্গে বসেছিলেন তিনি। সকাল তখন ৯টা। বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। ঠিকই তখনই ভারী বুট রাস্তা থেকে উঠে এল একেবারে ঘরে। বন্দুকের নল গিয়ে ঠেকল বাচ্চার বুকে। মাকে নির্দেশ মতো উঠে যেতে হল। কিছুক্ষণ পরে শোনা গেল চিৎকার। পুলওয়ামার আহারবল জলপ্রপাতে কান পাতলে এখনও হয়তো সেই চিৎকার শোনা যাবে। কাশ্মীরি মেয়েরা সুন্দরী! শুনে দেখবেন এক বার, তাঁদের আতর্নাদও কেমন মিষ্টি!
মবিনা গনি বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িই পৌঁছতে পারলেন না। পথেই মবিনা আর তার খালারর উপর চালানো হলো গণধর্ষণ। ২৪ বছরের হাসিনা ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছলেন। হাত-পা-মুখ ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার। জেলা হাসপাতালে হিহামা গ্রামের সেদিন সাত মেয়ে হাজির। বিয়ের আসর ভেঙে গিয়েছে। নববধূ-সহ সবার শরীরে ক্ষত। বিহোটায় এক মেয়েকে ছাড়াতে ২০ জন মেয়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা আটক থাকলেন। বাকিটা ইতিহাস।
সাইদপোরা গ্রামের ১০ থেকে ৬০ বছরের মেয়েরাও জানতেন না, কখন কে অর্ডার হাতে নিয়ে এসে বলবে, ‘সার্চ ইউ’। তার পরে মধ্যরাতে এসে ছিঁড়ে ফেলবে কাপড়। ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে দেখবে আর এক ছোট্ট মেয়ে। সেও জানবে, এক দিন এমনি করেই সার্চ অর্ডার আসবে তারও।
দরজা খুলেই তৈরি হতে হবে তল্লাশির জন্য। আয়াতের মতো মুখস্থ হয়ে যাবে সেই দু’টি বাক্য—‘আই হ্যাভ অর্ডার। আই হ্যাভ টু সার্চ ইউ।’ প্রতিবাদী বৃদ্ধার বুকে লাথি মেরে উল্টে ফেলা হবে। বেঁধে ফেলা হবে তার মুখ। তার পরে সেই ভবিতব্য।’
শিক্ষিকা জিনাত রেহেনা ইসলাম কাশ্মীরি নারীদের ওপর ভারতীয় সেনদের পাশবিক নির্যাতনের ঘটনাগুলো অনেকটা রয়েসয়েই লিখেছেন। ভারতীয় সেনারা যে জঙ্গি দমনের নামে এইসব নিরস্ত্র মেয়েদের ওপর যখন তখন কুকুরের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের গণধর্ষণ করে, এ কথাটি সরাসরি উল্লেখ পর্যন্ত করতে পারেননি ওই শিক্ষিকা। অথচ মানবাধিকার গোষ্ঠী হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে এইসব ধর্ষণ আর পাশবিক নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা। এই নির্যাতনের শুরু ১৯৯০ সালের জানুয়ারি থেকে, যখন কাশ্মীরে মানুষ ভারতীয় শাসকদের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য বিদ্রোহ শুরু করে। ভারতীয় শাসকদের দৃষ্টিতে যা ছিল কেবলই ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’, যার জন্য তারা পাকিস্তানকে অনবরত দোষ দিয়ে আসছে। এইসব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে ধর্ষণের চেয়ে যুৎসই ব্যবস্থা আর কি হতে পারে!
কাশ্মীরি নারীদের ওপর ভারতীয় সেনাদের নির্যাতনের একটি উদাহরণ হয়ে আছে মবিনা গনির ঘটনাটি। ১৯৯০ সালের মে মাসে বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার পথে নববধূ যুবতী মুবিনা গণিকে আটক করেছিল বিএসএফের সৈন্যরা। তারা তাকে গণধর্ষণ করাছিল। ওই লোলুপ হায়নাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি তার খালাও। ভারতীয় সেনারা তারা খালাও ধর্ষণ করেছিলেন।
নব্বই দশক থেকেই ভারতীয় সেনাদের এই পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে কাশ্মীরের কিশোররী থেকে বৃদ্ধারা পর্যন্ত। এসব ধর্ষণ বা গণধর্ষণ কোনোটিরই বিচার হয়নি, আর কখনও হবে তেমন সম্ভাবনাও নেই। এইসব ধর্ষণের ঘটনা কালের প্রভাবে হয়তো কিছুটা মলিন হয়ে পড়েছিলো, আন্তর্জাতিক খবর থেকে কিছুটা আড়ালেই চলে গিয়েছিলো উপত্যকার লোকজন। কিন্তু সম্প্রতি ৩৭০ ধারা বিলোপের পর ফের খবরের শিরোনাম হচ্ছে কাশ্মীর।
আর গত ৫ আগস্টের পর ভারতীয় পুরুষদের ‘কাশ্মীরি গার্ল’র প্রতি দুর্বলতা দেখে সেইসব ধর্ষণের ঘটনা দগদগে ঘায়ের মত উন্মোচন হয়ে পড়লো। ভারতীয় পুরুষদের এইসব বিবৃত মানসিকতা কাশ্মীরে আরো ভয়ানক কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। সামনে কি দুর্দিন অপেক্ষা করছে কাশ্মীরি নারীদের জন্য, তা আল্লাহই জানেন!