আল জাজিরার প্রতিবেদন

সামরিক শক্তিতে ইসরায়েলের চেয়ে ‘তিন ধাপ’ এগিয়ে ইরান, তবু ইসরায়েলের দাপট কেনো?

  • আল জাজিরা
  • আপডেট: ০৯:০৮:১৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪
  • ৬৬

ইরানের হামলা ঠেকাতে সক্রীয় করা হয়েছে ইসরাইলের আয়রন ডোম। ছবি-সংগৃহিত

ইসরায়েলের কয়েকটি বড় শহরে গত মঙ্গলবার রাতে অন্তত ১৮০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে হামলা চালিয়েছে ইরান। দেশটির বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) বলেছে, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান হত্যাকাণ্ড এবং অতিসম্প্রতি লেবাননে তাদের বিমান হামলা, একই সঙ্গে আইআরজিসি, হামাস ও হিজবুল্লাহ নেতাদের হত্যার জবাব এ হামলা।

আইআরজিসি আরও বলেছে, মূলত তেল আবিবে ইসরায়েলের তিনটি সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে মঙ্গলবার হামলা চালানো হয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোর ভাষ্য, তেহরান এবারই প্রথম ‘ফাতাহ’ হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবহার করেছে। আল–জাজিরা অবশ্য এ বক্তব্য নিরপেক্ষ সূত্রে যাচাই করতে পারেনি।

এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ইরান ‘এক বড় ভুল করেছে’ এবং এ জন্য দেশটিকে ‘মূল্য দিতে হবে’।

অন্যদিকে তেহরানের হামলা প্রতিহত করতে ইসরায়েলকে সহায়তা করা হয়েছে জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশটির প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ইরানি হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, ‘ইসরায়েলের সুরক্ষা ও দেশটিকে হামলা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পেরে আমরা গর্বিত। আমরা স্পষ্ট করে বলছি, ওই হামলার পরিণাম সইতে হবে আর তা হবে মারাত্মক এবং আমরা ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করব।’

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘাত ঘিরে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করছেন অনেকে। কারণ, দুটি দেশই সামরিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। সামরিক শক্তিধর শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে উভয় দেশই অবস্থান করছে। সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে র‍্যাঙ্কিংয়ে ইরানের অবস্থান ১৪তম আর ইসরায়েলের অবস্থান ১৭তম।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইরান সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইসরায়েলের তুলনায় তিন ধাপ এগিয়ে আছে। এ অবস্থায় দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা, একে অপরকে আক্রমণ করার ক্ষমতা ও নিজ ভূখণ্ড রক্ষার সামর্থ্য কতটুকু—এসব বিষয় খতিয়ে দেখেছে আল–জাজিরা।

সেনাসদস্যের সংখ্যা

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) এর ‘দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্যসংখ্যা ৬ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে ৩ লাখ ৫০ হাজার সেনাসদস্য, ১ লাখ ৯০ হাজার বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সদস্য, ১৮ হাজার নৌসেনা, ৩৭ হাজার বিমানসেনা ও ১৫ হাজার বিমানপ্রতিরক্ষা সদস্য। দেশটির রয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার রিজার্ভ সেনাও।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্যসংখ্যা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য ১ লাখ ২৬ হাজার, নৌসেনা ৯ হাজার ৫০০ এবং বিমানবাহিনীর সদস্য ৩৪ হাজার। দেশটির রয়েছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার রিজার্ভ সেনাও।

“ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্যসংখ্যা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য ১ লাখ ২৬ হাজার, নৌসেনা ৯ হাজার ৫০০ এবং বিমানবাহিনীর সদস্য ৩৪ হাজার। দেশটির রয়েছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার রিজার্ভ সেনাও।”

সামরিক খাতে ব্যয়

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) গত এপ্রিল মাসের তথ্যমতে, ইরান ২০২৩ সালে সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন, অর্থাৎ ১ হাজার ৩০ কোটি ডলার। ২০২২ সালের তুলনায় এটি ০ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।

একই সময়ে (২০২৩) ইসরায়েলের ব্যয় ছিল ২৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন, অর্থাৎ ২ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। এটি ২০২২ সালের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজায় শুরু করা নজিরবিহীন হামলার কারণে দেশটির ব্যয় এক বছরে এত বেড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

স্থলবাহিনী

দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইরানের রয়েছে ১০ হাজার ৫১৩টি ট্যাংক, ৬ হাজার ৭৯৮টি কামান এবং ৬৪০টির বেশি সাঁজোয়া যান। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর রয়েছে ৫০টি হেলিকপ্টার, বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর রয়েছে আরও ৫টি।

বিপরীতে ইসরায়েলের রয়েছে প্রায় ৪০০ ট্যাংক, ৫৩০টি কামান ও ১ হাজার ১৯০টি সাঁজোয়া যান।

বিমানবাহিনী

দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইরানের বিমানবাহিনীর রয়েছে ৩১২টি যুদ্ধবিমান, বিপ্লবী গার্ডের রয়েছে আরও ২৩টি। বিমানবাহিনীর রয়েছে ২টি জঙ্গি হেলিকপ্টার, সেনাবাহিনীর রয়েছে ৫০টি এবং বিপ্লবী গার্ডের ৫টি।

ইসরায়েলের রয়েছে ৩৪৫টি যুদ্ধবিমান ও ৪৩টি জঙ্গি হেলিকপ্টার।

নৌবাহিনী

দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইরানের রয়েছে ১৭টি সাবমেরিন, ৬৮টি প্যাট্রল ও কোস্টাল কমব্যাটান্ট, ৭টি রণতরি, ১২টি ল্যান্ডিং শিপ, ১১টি ল্যান্ডিং ক্র্যাফট, ১৮টি লজিস্টিকস ও সাপোর্ট সরঞ্জাম।

ইসরায়েলের রয়েছে ৫টি সাবমেরিন ও ৪৯টি প্যাট্রোল ও কোস্টাল কমব্যাটান্ট।

আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা

দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মূলত নির্ভরশীল ‘আয়রন ডোম’–ব্যবস্থার ওপর। মঙ্গলবার রাতে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশই আয়রন ডোম–ব্যবস্থায় প্রতিহত করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

একেকটি আয়রন ডোম–ব্যবস্থায় থাকে একটি রাডার, যা সম্ভাব্য আঘাত হানা ক্ষেপণাস্ত্র বা অন্য বস্তুর গতি ও লক্ষ্যস্থল শনাক্ত করে। পরে নিয়ন্ত্রণকক্ষ হিসাবনিকাশ করে দেখে, এটি কোনো শহরের জন্য হুমকি কি না। হুমকি না হলে ওই ক্ষেপণাস্ত্র বা বস্তুকে ফাঁকা স্থানে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। আর হুমকি মনে হলে সেটি ভূপাতিত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট ইউনিট থেকে ছোড়া হয় ক্ষেপণাস্ত্র।

ইসরায়েলজুড়ে আছে ১০টি আয়রন ডোম ব্যাটারি। আছে আরও কিছু প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, যার সাহায্যেও মধ্যম ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানা প্রতিহত করা হয়।

এদিকে ইরান গত ফেব্রুয়ারিতে স্বল্পপাল্লার আজারখশ (বজ্র) আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন করেছে। এটি একটি ইনফ্রারেড শনাক্তকরণ ব্যবস্থা। সম্ভাব্য আঘাত হানা ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত ও তা প্রতিহত করতে এ ব্যবস্থায় যুক্ত আছে রাডার এবং ইলেক্ট্রো–অপটিক ব্যবস্থা। এটি যানবাহনের ওপরও স্থাপন করা যায়।

ইরানের আছে বিভিন্ন পাল্লার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। এর মধ্যে আছে ৪২টির বেশ দূরপাল্লার রাশিয়ার তৈরি এস–২০০ ও এস–৩০০ এবং স্থানীয়ভাবে নির্মিত বাভার–৩৭৩; ৫৯টির বেশি মধ্যম পাল্লার যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এমআইএম–২৩ হক, এইচকিউ–২জে ও খোরদাদ–১৪। আছে চীন থেকে কেনা স্বল্পপাল্লার সিএইচ–এসএ–৪ ও ৯কে৩৩১ টর–এম১ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) মিসাইল ডিফেন্স প্রজেক্টের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ইরানের অস্ত্রভান্ডারে রয়েছে অন্তত ১২ ধরনের মধ্যম ও স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলোর একটি টনডার ৬৯, এর পাল্লা ১৫০ কিলোমিটার। এ ছাড়া আছে খোরামশাহর ও সেজিল। এগুলোর পাল্লা ২ হাজার কিলোমিটার (১ হাজার ২৪৩ মাইল) পর্যন্ত।

অপর দিকে ইসরায়েলের রয়েছে অন্তত চার ধরনের স্বল্প ও মধ্যম এবং মধ্যবর্তী পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে এলওআরএ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ২৮০ কিলোমিটার (১৭৪ মাইল) ও জেরিকো–৩ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৪ হাজার ৮০০ কিলোমিটার (২ হাজার ৯৮৩ মাইল) থেকে ৬ হাজার ৫০০ কিলোমিটার (৪ হাজার ৩৯ মাইল)।

পারমাণবিক সক্ষমতা

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ইসরায়েলের আনুমানিক ৯০টি পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে।

এদিকে ধারণা করা হয়, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নেই। তবে তার রয়েছে খুবই সমৃদ্ধ পারমাণবিক কর্মসূচি। দেশটি বেশ কিছু পারমাণবিক স্থাপনা ও গবেষণাকেন্দ্র পরিচালনা করছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি পারমাণবিক অস্ত্রের উৎপাদন নিষিদ্ধ করে ২০০০ সালের শুরুতে একটি ফতোয়া দেন। ওই ধর্মীয় নির্দেশনার যুক্তি হিসেবে বলেন, ‘ইসলামে এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ।’ অবশ্য ইসরায়েলের আগ্রাসন ও বৈশ্বিক হুমকি বিবেচনায় গত মে মাসে তেহরান তার অস্তিত্ব রক্ষায় পারমাণবিক নীতিতে বদল আনার হুমকি দিয়েছে।

সর্বাধিক পঠিত

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি সদস্য মোতাহার হোসেন পাটোয়ারী’র সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যাপক জনসমাগম

আল জাজিরার প্রতিবেদন

সামরিক শক্তিতে ইসরায়েলের চেয়ে ‘তিন ধাপ’ এগিয়ে ইরান, তবু ইসরায়েলের দাপট কেনো?

আপডেট: ০৯:০৮:১৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪

ইসরায়েলের কয়েকটি বড় শহরে গত মঙ্গলবার রাতে অন্তত ১৮০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে হামলা চালিয়েছে ইরান। দেশটির বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) বলেছে, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান হত্যাকাণ্ড এবং অতিসম্প্রতি লেবাননে তাদের বিমান হামলা, একই সঙ্গে আইআরজিসি, হামাস ও হিজবুল্লাহ নেতাদের হত্যার জবাব এ হামলা।

আইআরজিসি আরও বলেছে, মূলত তেল আবিবে ইসরায়েলের তিনটি সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে মঙ্গলবার হামলা চালানো হয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোর ভাষ্য, তেহরান এবারই প্রথম ‘ফাতাহ’ হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবহার করেছে। আল–জাজিরা অবশ্য এ বক্তব্য নিরপেক্ষ সূত্রে যাচাই করতে পারেনি।

এ হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ইরান ‘এক বড় ভুল করেছে’ এবং এ জন্য দেশটিকে ‘মূল্য দিতে হবে’।

অন্যদিকে তেহরানের হামলা প্রতিহত করতে ইসরায়েলকে সহায়তা করা হয়েছে জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশটির প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ইরানি হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, ‘ইসরায়েলের সুরক্ষা ও দেশটিকে হামলা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পেরে আমরা গর্বিত। আমরা স্পষ্ট করে বলছি, ওই হামলার পরিণাম সইতে হবে আর তা হবে মারাত্মক এবং আমরা ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করব।’

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘাত ঘিরে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করছেন অনেকে। কারণ, দুটি দেশই সামরিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। সামরিক শক্তিধর শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে উভয় দেশই অবস্থান করছে। সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে র‍্যাঙ্কিংয়ে ইরানের অবস্থান ১৪তম আর ইসরায়েলের অবস্থান ১৭তম।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইরান সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইসরায়েলের তুলনায় তিন ধাপ এগিয়ে আছে। এ অবস্থায় দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা, একে অপরকে আক্রমণ করার ক্ষমতা ও নিজ ভূখণ্ড রক্ষার সামর্থ্য কতটুকু—এসব বিষয় খতিয়ে দেখেছে আল–জাজিরা।

সেনাসদস্যের সংখ্যা

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) এর ‘দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্যসংখ্যা ৬ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে ৩ লাখ ৫০ হাজার সেনাসদস্য, ১ লাখ ৯০ হাজার বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সদস্য, ১৮ হাজার নৌসেনা, ৩৭ হাজার বিমানসেনা ও ১৫ হাজার বিমানপ্রতিরক্ষা সদস্য। দেশটির রয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার রিজার্ভ সেনাও।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্যসংখ্যা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য ১ লাখ ২৬ হাজার, নৌসেনা ৯ হাজার ৫০০ এবং বিমানবাহিনীর সদস্য ৩৪ হাজার। দেশটির রয়েছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার রিজার্ভ সেনাও।

“ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্যসংখ্যা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য ১ লাখ ২৬ হাজার, নৌসেনা ৯ হাজার ৫০০ এবং বিমানবাহিনীর সদস্য ৩৪ হাজার। দেশটির রয়েছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার রিজার্ভ সেনাও।”

সামরিক খাতে ব্যয়

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) গত এপ্রিল মাসের তথ্যমতে, ইরান ২০২৩ সালে সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন, অর্থাৎ ১ হাজার ৩০ কোটি ডলার। ২০২২ সালের তুলনায় এটি ০ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।

একই সময়ে (২০২৩) ইসরায়েলের ব্যয় ছিল ২৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন, অর্থাৎ ২ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। এটি ২০২২ সালের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজায় শুরু করা নজিরবিহীন হামলার কারণে দেশটির ব্যয় এক বছরে এত বেড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

স্থলবাহিনী

দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইরানের রয়েছে ১০ হাজার ৫১৩টি ট্যাংক, ৬ হাজার ৭৯৮টি কামান এবং ৬৪০টির বেশি সাঁজোয়া যান। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর রয়েছে ৫০টি হেলিকপ্টার, বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর রয়েছে আরও ৫টি।

বিপরীতে ইসরায়েলের রয়েছে প্রায় ৪০০ ট্যাংক, ৫৩০টি কামান ও ১ হাজার ১৯০টি সাঁজোয়া যান।

বিমানবাহিনী

দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইরানের বিমানবাহিনীর রয়েছে ৩১২টি যুদ্ধবিমান, বিপ্লবী গার্ডের রয়েছে আরও ২৩টি। বিমানবাহিনীর রয়েছে ২টি জঙ্গি হেলিকপ্টার, সেনাবাহিনীর রয়েছে ৫০টি এবং বিপ্লবী গার্ডের ৫টি।

ইসরায়েলের রয়েছে ৩৪৫টি যুদ্ধবিমান ও ৪৩টি জঙ্গি হেলিকপ্টার।

নৌবাহিনী

দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইরানের রয়েছে ১৭টি সাবমেরিন, ৬৮টি প্যাট্রল ও কোস্টাল কমব্যাটান্ট, ৭টি রণতরি, ১২টি ল্যান্ডিং শিপ, ১১টি ল্যান্ডিং ক্র্যাফট, ১৮টি লজিস্টিকস ও সাপোর্ট সরঞ্জাম।

ইসরায়েলের রয়েছে ৫টি সাবমেরিন ও ৪৯টি প্যাট্রোল ও কোস্টাল কমব্যাটান্ট।

আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা

দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মূলত নির্ভরশীল ‘আয়রন ডোম’–ব্যবস্থার ওপর। মঙ্গলবার রাতে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশই আয়রন ডোম–ব্যবস্থায় প্রতিহত করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

একেকটি আয়রন ডোম–ব্যবস্থায় থাকে একটি রাডার, যা সম্ভাব্য আঘাত হানা ক্ষেপণাস্ত্র বা অন্য বস্তুর গতি ও লক্ষ্যস্থল শনাক্ত করে। পরে নিয়ন্ত্রণকক্ষ হিসাবনিকাশ করে দেখে, এটি কোনো শহরের জন্য হুমকি কি না। হুমকি না হলে ওই ক্ষেপণাস্ত্র বা বস্তুকে ফাঁকা স্থানে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। আর হুমকি মনে হলে সেটি ভূপাতিত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট ইউনিট থেকে ছোড়া হয় ক্ষেপণাস্ত্র।

ইসরায়েলজুড়ে আছে ১০টি আয়রন ডোম ব্যাটারি। আছে আরও কিছু প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, যার সাহায্যেও মধ্যম ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানা প্রতিহত করা হয়।

এদিকে ইরান গত ফেব্রুয়ারিতে স্বল্পপাল্লার আজারখশ (বজ্র) আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন করেছে। এটি একটি ইনফ্রারেড শনাক্তকরণ ব্যবস্থা। সম্ভাব্য আঘাত হানা ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত ও তা প্রতিহত করতে এ ব্যবস্থায় যুক্ত আছে রাডার এবং ইলেক্ট্রো–অপটিক ব্যবস্থা। এটি যানবাহনের ওপরও স্থাপন করা যায়।

ইরানের আছে বিভিন্ন পাল্লার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। এর মধ্যে আছে ৪২টির বেশ দূরপাল্লার রাশিয়ার তৈরি এস–২০০ ও এস–৩০০ এবং স্থানীয়ভাবে নির্মিত বাভার–৩৭৩; ৫৯টির বেশি মধ্যম পাল্লার যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এমআইএম–২৩ হক, এইচকিউ–২জে ও খোরদাদ–১৪। আছে চীন থেকে কেনা স্বল্পপাল্লার সিএইচ–এসএ–৪ ও ৯কে৩৩১ টর–এম১ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) মিসাইল ডিফেন্স প্রজেক্টের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ইরানের অস্ত্রভান্ডারে রয়েছে অন্তত ১২ ধরনের মধ্যম ও স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলোর একটি টনডার ৬৯, এর পাল্লা ১৫০ কিলোমিটার। এ ছাড়া আছে খোরামশাহর ও সেজিল। এগুলোর পাল্লা ২ হাজার কিলোমিটার (১ হাজার ২৪৩ মাইল) পর্যন্ত।

অপর দিকে ইসরায়েলের রয়েছে অন্তত চার ধরনের স্বল্প ও মধ্যম এবং মধ্যবর্তী পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে এলওআরএ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ২৮০ কিলোমিটার (১৭৪ মাইল) ও জেরিকো–৩ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৪ হাজার ৮০০ কিলোমিটার (২ হাজার ৯৮৩ মাইল) থেকে ৬ হাজার ৫০০ কিলোমিটার (৪ হাজার ৩৯ মাইল)।

পারমাণবিক সক্ষমতা

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ইসরায়েলের আনুমানিক ৯০টি পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে।

এদিকে ধারণা করা হয়, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নেই। তবে তার রয়েছে খুবই সমৃদ্ধ পারমাণবিক কর্মসূচি। দেশটি বেশ কিছু পারমাণবিক স্থাপনা ও গবেষণাকেন্দ্র পরিচালনা করছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি পারমাণবিক অস্ত্রের উৎপাদন নিষিদ্ধ করে ২০০০ সালের শুরুতে একটি ফতোয়া দেন। ওই ধর্মীয় নির্দেশনার যুক্তি হিসেবে বলেন, ‘ইসলামে এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ।’ অবশ্য ইসরায়েলের আগ্রাসন ও বৈশ্বিক হুমকি বিবেচনায় গত মে মাসে তেহরান তার অস্তিত্ব রক্ষায় পারমাণবিক নীতিতে বদল আনার হুমকি দিয়েছে।