জুলাই বিপ্লবের আগে পরে আলোচনায় ছিলেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। এবার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। লেখাটি যুগান্তরের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো –
‘অনেকে রাজনৈতিক দল হিশাবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে চাইছেন। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার উদাহরণ বাংলাদেশে রয়েছে, অতএব আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করবার পক্ষে বিস্তর যুক্তি দেওয়া সম্ভব। আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট দল হিশাবে অবিলম্বে নিষিদ্ধ করবার পক্ষে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি রয়েছে। আইন ও রাজনীতি উভয় দিক থেকে সেই সকল যুক্তি আমাদের বিবেচনা করা দরকার। সেই ক্ষেত্রে ইউরোপে ফ্যাসিস্ট দলগুলো নিষিদ্ধ করবার উদাহরণ এবং ইউরোপের অভিজ্ঞতার আলোকে যেমন বিষয়টি আমাদের বিশ্লেষণ করা উচিত, তেমনি স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগের ভূমিকা আমাদের অবশ্যই কঠোর ভাবে বিচার করে দেখতে হবে। তবে মনে রাখা দরকার আওয়ামী লীগ একাই শুধু ফ্যাসিস্ট নয়, বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেকুলার ও ধর্মীয় নানান ফ্যাসিস্ট প্রবণতা রয়েছে। এদের মোকাবিলা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
এই আলোচনা আমাদের অনেক আগেই শুরু করা উচিত ছিল। কিন্তু উপদেষ্টা সরকারের আওয়ামী প্রীতি ও দুর্বলতা গভীর সন্দেহ তৈরি করছে যে আসলে আওয়ামী-ফ্যাসিস্ট শক্তি টিকিয়ে রাখা ও পুনর্বাসন করা তাদের প্রধান কাজ হয়ে উঠেছে। ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে ফ্যাসিস্ট প্রেসিডেন্টের কাছে ফ্যাসিস্ট সংবিধান রক্ষার শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়েই সেটা পরিষ্কার। তাছাড়া আমরা বারবারই সবার আগে নেলসন মান্ডেলার ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশান কমিশনে’-এর আদলে জাতীয় বিভেদ মীমাংসা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য অবিলম্বে ‘জাতীয় কমিশন’ গঠন করবার কথা বলেছিলাম। তার যে কোন নাম হতে পারে। আমার বিভিন্ন বক্তব্যে আমি বারবারই সেটা বলেছি। কিন্তু আসল কমিশন বাদ দিয়ে উপদেষ্টা সরকার বিভিন্ন কমিশন ওপর থেকে চাপিয়ে দিচ্ছে, এতে দুষ্কৃতকারিরা বিশৃঙ্খলা ও গণবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
কেন ফ্যাসিস্ট দল হিশাবে অবিলম্বে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা উচিত, ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি বিবেচনা করতে পারি।
১. গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন
ফ্যাসিস্ট দলগুলোর একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে একনায়কী ফ্যাসিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বাংলাদেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন ও গণমাধ্যমের উপর দমনমূলক কার্যকলাপ বেড়েছে। নির্বাচনে বিরোধী দলকে অংশ নিতে বাধা দেওয়া, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ ও দমন করা এবং বিরোধী দল ও সমালোচকদের গ্রেপ্তার বা নির্যাতনের মতো পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইউরোপ, যেমন জার্মানি ও ইতালিতে—ফ্যাসিস্ট দলগুলোকে নিষিদ্ধ করার মূল কারণ ছিলো এ ধরনের রাজনৈতিক আচরণ, তারা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে কাজ করেছিলো এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূল করেছিলো। বাংলাদেশে একইভাবে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলগুলোর উপর অত্যাচার চালিয়েছে এবং রাজনীতি থেকে বিরোধী দলকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছে। অতএব আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা ছাড়া আমাদের পক্ষে কখনোই গণতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব হবে না।
২. রাজনৈতিক সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতন
আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীকে দমন করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং দলীয় ক্যাডারদের নিয়মিত ব্যবহার করেছে। এই ধরনের সহিংসতা এবং নির্যাতন গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিপন্থী এবং ফ্যাসিস্ট শক্তির আধিপত্য ও শাসনের লক্ষণ হিসাবে বিবেচিত। এই ফ্যাসিস্ট শক্তি এখনো কার্যকর এবং জনগণের ক্ষোভ বিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে নতুন ভাবে হাজির হয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করে দিতে পারে।
ইতালির মতো দেশে ফ্যাসিস্ট দলগুলো নিষিদ্ধ করার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সহিংসতা ও রাজনৈতিক সন্ত্রাস ছড়ানো। একইভাবে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে, একে আমরা যেভাবে উপেক্ষা করছি—তা বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।
৩. রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর ফ্যাসিস্ট শক্তির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং সাংবিধানিকভাবে একজন ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা
বাংলাদেশের সংবিধান সাংবিধানিকভাবেই একনায়কতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট। ক্ষমতাবান সংবিধানের কারণেই ফ্যাসিস্ট হতে বাধ্য। এই সংবিধান বাতিল ও ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু না করার কোনো বিকল্প নাই। কিন্তু উপদেষ্টা সরকার সেটা করেনি। সংবিধান সংস্কার করবার কোনো সুযোগ নাই। আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে এবং বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এর ফলে বাংলাদেশে কোনো গণতান্ত্রিক তর্কবিতর্কের পরিবেশ পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। অতএব আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নাই।
জার্মানির ফ্যাসিস্ট দল নিষিদ্ধ করার অন্যতম কারণ ছিলো নাজি পার্টির রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করে ফ্যাসিস্ট শাসন চালানো, যার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিশেষ ফারাক নাই। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতেও আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র ফ্যাসিস্ট আধিপত্য কমেছে বলে কোনো প্রমাণ নাই।
৪. জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্যকে উসকে দেওয়া
আওয়ামী লীগের কারণে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অভাব ঘটেছে এবং মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে। মুসলিম দেশগুলোতে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার বা নিপীড়ন যখন ঘটে, তখন তা রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার আওতায় আসে। এ ধরনের কার্যক্রম ফ্যাসিস্ট দলের আচরণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, কারণ ফ্যাসিস্ট দলগুলো প্রায়ই জাতিগত বা ধর্মীয় বৈষম্য উসকে দেয়।
ফ্রান্সে তাই জাতিগত বিদ্বেষ বা জাতিগত বৈষম্য উস্কে দেওয়া দলগুলো নিষিদ্ধ করা হয়, বাংলাদেশেও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার উপর আক্রমণ করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।
৫. আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে রয়েছে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং রাজনৈতিক বন্দীদের নির্যাতন। এগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ফ্যাসিস্ট দল বা শক্তি হিশাবে আওয়ামী লীগকে আন্তর্জাতিক ভাবে নিন্দিত করেছে।
অস্ট্রিয়া এবং জার্মানির মতো দেশগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ফ্যাসিস্ট দলগুলো নিষিদ্ধ। কারণ তারা ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল। বাংলাদেশেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে, যা মোকাবিলা করতে হলে ফ্যাসিস্ট দল ও শক্তিকে নিষিদ্ধ করা জরুরি।
ইউরোপে ফ্যাসিস্ট দল নিষিদ্ধ করার প্রধান কারণ ছিলো গণতন্ত্র এবং মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রয়োজনে। বাংলাদেশের বাস্তবতাও তাই। জার্মানি, ইতালি এবং অস্ট্রিয়াতে ফ্যাসিস্ট দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে যাতে তারা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে ধ্বংস করতে না পারে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন না ঘটে। একইভাবে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে তারা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে ধ্বংস করেছে, দুর্বল করেছে এবং মৌলিক অধিকারগুলোকে ক্ষুণ্ণ করছে।
তাহলে অবিলম্বে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা দরকার। কিন্তু সেটা চিরকাল নিষিদ্ধ রাখার জন্য নয়। নেলসন মান্ডেলার ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশান কমিশন’-এর আদলে ‘জাতীয় বিভেদ মীমাংসা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য’ অবিলম্বে ‘জাতীয় কমিশন’ গঠন করার মধ্য দিয়ে আমাদের সকলকেই একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে এবং রাষ্ট্রের গোড়ায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, ব্যক্তির স্বাধীনতা ও মর্যাদা, মানবাধিকারের গুরুত্ব এবং রাষ্ট্র গঠন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমরা আলাপ-আলোচনা করতে পারি।
পারস্পরিক শত্রুতা ও ক্ষত ভুলে দেশ গঠনে সকলের ইতিবাচক ভূমিকা নিশ্চিত করাই এখন আমাদের কাজ।’