মহান মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টর কমান্ডার, সাবেক সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ৯১’ তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য,চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি) আসনের ৪’বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম এমপির আজ ৭৯তম জন্মদিন।
১৯৪৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার নাওড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার আশরাফ উল্লাহ ও মা রহিমা বেগম। তিন ভাই ছয় বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। জন্মস্থান নাওড়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থেকে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শেষ করেন।
১৯৫৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা মডেল হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশেন ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন।
১৯৮১ সালে তিনি আমেরিকার হার্ভাড বিজনেস স্কুলে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম কোর্স সম্পন্ন করেন।
মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম’র এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে ও মেয়ে প্রবাসি।
রফিকুল ইসলাম ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে লাহোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হন এবং তৎকালিন যশোর ক্যান্টনমেন্ট রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন দায়িত্ব পালন শেষে দিনাজপুরে ইপিআরের ৮ নম্বর উইংয়ের অ্যাসিসটেন্ট উইং কমান্ডার পদে বদলি হন। পরে ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের চট্টগ্রাম সেক্টর হেডকোয়ার্টারে অ্যাডজুট্যান্ট পদে নিয়োগ পান। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেন ১নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৯ এপ্রিল সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নেন।
সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতন হলে ১৯৯০ সালে দেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পান।
তিনি ডিসেম্বর ১৯৯০ সাল থেকে ২০ মার্চ ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ওই সরকারের মন্ত্রীর পদমর্যদায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ শাহরাস্তি নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুর-৫ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি এলাকা থেকে আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত জাতীয় সংসদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে একই আসন থেকে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে একই আসন থেকে তিনি বিপুল ভোটে ৪র্থবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান:
১৯৭১ সালে রফিকুল ইসলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে চট্টগ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে প্রেষণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সেনা মোতায়েন পরিস্থিতি দেখে এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি স্বাধীনতার প্রয়োজনে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তদনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি তার অধীনস্থ বাঙালি অফিসার ও সিপাহিদের সাথে আলোচনা করে কর্তব্য স্থির করেন, এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের সাথে গোপন বৈঠক করে প্রয়োজনে বিদ্রোহের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৭১ এর ২৪শে মার্চ রাতেই ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম কার্যত বিদ্রোহ শুরু করেন। তার আদেশ পেয়ে সীমান্ত ফাঁড়িতে বাঙালি সৈন্যরা অবাঙালি সিপাহিদের নিরস্ত্র ও নিষক্রিয় করে চট্টগ্রামে এসে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদানের জন্যে প্রস্তুত হয়। এম. আর. চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমানের অনুরোধে সেদিন রফিকুল ইসলাম তাদের চট্টগ্রামে আসার নির্দেশ বাতিল করেন। কিন্তু পরদিন ২৫শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে সংঘর্ষ প্রায় অনিবার্য অনুধাবন করে ক্যাপ্টেন রফিক (পরবর্তীতে মেজর) সক্রিয় বিদ্রোহ শুরু করেন এবং ইপিআরের অবাঙালি সৈন্য ও অফিসারদের জীবিত অবস্থায় বন্দী করে রেলওয়ে হিলে তার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। তার অধীনে ন্যস্ত সৈনিকরা এম. ভি. সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমান সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় ২০ বালুচ রেজিমেন্ট-এর সৈন্যরা চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার-এর সহস্রাধিক বাঙালি সৈনিক ও অফিসারকে স্ব-পরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে কালুরঘাট ব্রিজের দিকে অবস্থান নেয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে চট্টগ্রামের অন্যান্য সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আগত ক্যাপ্টেন রফিকের অধীনস্থ ইপিআর সৈনিকদের মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিকের বাহিনীর সাথে যোগদানে বাধা দেন এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের সাথে কালুরঘাট ব্রিজ এলাকায় অবস্থান নিতে বাধ্য করেন। এ কারণে ক্যাপ্টেন রফিক সেনাবলের অভাবে চট্টগ্রামে যথাযথ দখল বজায় রাখতে ব্যর্থ হন এবং এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচুর ক্ষতি সাধন করে পশ্চাদপসরণ করেন। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন রফিক তার বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করেন এবং ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে তার হেডকোয়ার্টার সীমান্তের ওপারে হরিণায় স্থাপন করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে এখান থেকেই তিনি ১নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে চট্টগ্রাম এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে ন্যস্ত হন। ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে ক্যাপ্টেন (মেজর) রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলণ করেন।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা-
মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমকে জীবীত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রদানকৃত সর্বোচ্চ খেতাব বীরউত্তমে ভূষিত করা হয়।
তাঁকে ২০১৯ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯) প্রদান করা হয়।
মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম’র গ্রন্থাবলি-
মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের লেখ ২টি বই হলো-এ টেল অফ মিলিয়ন্স (ইংরেজী) (১৯৭৪), লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে (বাংলা) (১৯৮১), মুক্তির সোপান তলে (২০০১)।
এ ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জতিক ও জাতীয় পত্রিকায় বহুকলাম লিখেছেন তিনি।