অসম শক্তির দুই প্রতিবেশী দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন। একদিকে পরাশক্তি রাশিয়ার বিশাল সামরিক বহর, অন্যদিকে খুঁড়িয়ে চলা ইউক্রেন। তবে রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেওয়ার পর থেকে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে নজর দিয়েছে ইউক্রেন। গড়ে তুলেছে ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম সশস্ত্রবাহিনী। তাদের সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও ইউরোপের কিছু দেশ। কিন্তু, আসলেই কি তারা রাশিয়াকে মোকাবিলার শক্তি অর্জন করেছে?
একসময় দুই দেশই ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। কিন্তু, ১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর স্বাধীনতা লাভ করে ইউক্রেন। ওই সময় সামরিক পর্যায়ে দুই দেশের সম্পর্ক চরমভাবে অবনতিশীল হয়। এর প্রধান কারণ- সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিরক্ষাসামগ্রী ও সমরাস্ত্রের বড় একটি অংশ মোতায়েন করা ছিল ইউক্রেনের মাটিতে। ইউক্রেন স্বাধীনতা লাভের পর মস্কো এসব অস্ত্র ফেরত চাইলে বিরোধের সূচনা।
ওই সময় ইউক্রেনের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে প্রায় ৫ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র ছিল, যা সোভিয়েত সশস্ত্র বাহিনীর মোট পারমাণবিক অস্ত্রের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি। এসব অস্ত্রের পারমাণবিক নকশা ও কিছু প্রোডাকশন ফ্যাসিলিটিসও ছিল ইউক্রেনের মাটিতে। এছাড়া ছিল ইউআর-হান্ড্রেড মডেলের ১৩০টি ও আরটি-২৩ মডেলের ৪৬ আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল। সব মিলে ১৭০০ ওয়াহারহেড ছিল ইউক্রেনের মাটিতে। ছিল সোভিয়েত বিমান বাহিনীর ৩৩টি হেভি বোম্বারসহ অনেকগুলো সামরিক বিমান। স্বাধীনতা লাভের পর ইউক্রেন এগুলো দখল করলেও পরিচালনা করার মতো প্রযুক্তি ও দক্ষ লোকবলের কোনটিই ছিল না তাদের। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দরকষাকষির এক পর্যায়ে ইউক্রেন পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির আওতায় এসব অস্ত্র ধ্বংস করে। আর কয়েক বছর পরে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানির বকেয়া মওকূফের বিনিময়ে রাশিয়াকে কিছু যুদ্ধবিমান ফেরত দেয়।
১৯৯৪ সালে ইউক্রেন ন্যাটোর পার্টনারশিপ প্রোগ্রামে যুক্ত হলে মস্কোর সাথে তিক্ততা আরো বাড়ে। মাঝখানে ইউক্রেনের মস্কোপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানোকেভিচের সময়ে সম্পর্ক মধুর হলেও ২০১৪ সালে ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদে মদদ ও ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া। যে কারণে দুই দেশের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি হয়।
সামরিক শক্তিতে রাশিয়ার চেয়ে সে সময় অনেকগুণ পিছিয়ে থাকা ইউক্রেন তার ক্রিমিয়া উপদ্বীপ রক্ষায় তেমন কোন প্রতিরোধই করতে পারেনি। তবে এরপর তারা মনোযোগী হয়েছে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে। রাশিয়ার মতো বৃহৎ পরাশক্তির পাশে টিকে থাকার লক্ষ্যে সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়ন করতে শুরু করে কিয়েভ। এতে তারা সহযোগিতা পেয়েছে ন্যাটোসহ ইউরোপ ও আমেরিকার। অন্য দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া তার জৌলুস হারালেও পুতিনের দুই দশকের শাসনে দেশটি আবার ঘুড়ে দাড়িয়েছে।
সামরিক শক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্সের তথ্য মতে ২০২১ সালে সামরিক শক্তির র্যাঙ্কিংয়ে বিশে^র ১৪০টি দেশের মধ্যে ইউক্রেনের অবস্থান ২৫ নম্বরে। দেশটির সামরিক বাজেট ৯৬০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৪ সালের পর ইউক্রেন প্রতিরক্ষা বাজেট দ্রুত বাড়াতে থাকে। ওই বছর দেশটির সামরিক বাজেট ছিল জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১৯ সালে যা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর মোট জনবল ১২ লাখ ৪৫ হাজার। এর মধ্যে ২ লাখ ৫৫ হাজার নিয়মিত সদস্য এবং ৯ লাখ রিজার্ভ সদস্য। এছাড়া প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্য রয়েছে আরো ৯০ হাজার।
ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর মোট ৫টি বিভাগ। গ্রাউন্ড ফোর্স বা সেনাবাহিনী, এয়ারফোর্স, নেভি, এয়ার অ্যাসল্ট ফোর্স ও স্পেশাল অপারেশন্স ফোর্স। দেশটির স্থল বাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডারে আছে ২ হাজার ৪৩০টি ট্যাঙ্ক, প্রায় সাড়ে ১১ হাজার সাঁজোয়া যান। সেল্ফ প্রোপেল্ড আর্টিলারি বা ভ্রাম্যমান কামান ৭৮৫ টি। টাউড আর্টিলারি বা অন্য যানবাহনের ওপর স্থাপনযোগ্য কামানের সংখ্যা ২০৪০টি। আর রকেট প্রজেক্টর আছে ৫৫০টি।
২০১৪ সালে রাশিয়ার স্পেশাল ফোর্স যখন ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়, তখন কোন প্রতিরোধই করতে পারেনি অঞ্চলটিতে মোতায়েন ২০ হাজার ৩০০ ইউক্রেনীয় সৈন্য। অভিজ্ঞতা ও উন্নত সমরাস্ত্রের ঘাটতি ছাড়াও তাদের বড় অংশ রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল বলে জানা যায়। একই বছর ডোনবাস অঞ্চলে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে যুদ্ধে বড় ধরনের দুর্বলতা দেখা গেছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে। ইউরোপের একটি দেশের সেনাবাহিনীর এত দুর্বল ওয়ার পারফরম্যান্স অনেকের কাছেই অবিশ^াস্য ঠেকেছে, যদিও তাদের প্রতিপক্ষ ছিল সরাসরি রাশিয়ার মদদপুষ্ঠ।
ইউক্রেনের স্থল যুদ্ধের বেশির ভাগ অস্ত্রই সোভিয়েত যুগের। পরবর্তীতে তার কিছু কিছু আধুনিকায়ন করা হয়েছে। টি-৮০, টি-৬৪ এর মতো ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে ইউক্রেনীয় সেনারা। অবশ্য ২০১৪ সালের যুদ্ধের পর সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে বড় ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছে ইউক্রেন। দ্রুত বাড়ানো হয়েছে সৈন্য সংখ্যা। বর্তমানে ফ্রান্স ও রাশিয়ার পর ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী ইউক্রেনের। বাহিনীর আধুনিকায়নে সহযোগিতা করেছে ন্যাটোসহ পশ্চিমা দেশগুলো। তুরস্কের কাছ থেকেও প্রতিরক্ষা সামগ্রী কিনতে শুরু করেছে ইউক্রেন।
রাশিয়া আছে সামরিক শক্তির র্যাঙ্কিংয়ে দুই নম্বরে। দেশটির প্রতিরক্ষা বাজেট ৪ হাজার ২১২ কোটি মার্কিন ডলার। যা ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বাজেটের চারগুনেরও বেশি। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর মোট জনবল ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার। সক্রিয় সদস্য ১০ লাখ ১৪ হাজার, রিজার্ভ সদস্য ২০ লাখ। আর প্যারামিলিটারি বাহিনীতে আছে ৫ লাখ ৫৫ হাজার সদস্য।
রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানত ছয়টি বিভাগ। এগুলো হলো- রাশিয়ান গ্রাউন্ড ফোর্সেস, রাশিয়ান অ্যারোস্পেস ফোর্সেস, নেভি, এয়ারবর্ন ফোর্সেস, স্ট্রাটেজিক মিসাইল ফোর্সেস ও স্পেশাল অপারেশন ফোর্সেস। অ্যারোস্পেস ফোর্সের দুটি বিভাগ- এয়ার ফোর্স বা বিমান বাহিনী এবং স্পেস ফোর্স বা মহাশূন্য বাহিনী।
রুশ স্থল বাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডারে আছে ১৩ হাজার ট্যাঙ্ক, ২৭ হাজার ১০০টি সাঁজোয়া যান। সেল্ফ প্রোপেল্ড আর্টিলারি বা ভ্রাম্যমান কামান ৬ হাজার ৫৪০টি। টাউড আর্টিলারি বা অন্য যানবাহনের ওপর স্থাপনযোগ্য কামানের সংখ্যা ৪ হাজার ৪৬৫টি। আর রকেট প্রজেক্টর আছে ৩ হাজার ৮৬০টি।
সমরাস্ত্রের দিক থেকে রাশিয়া সব সময়ই পাল্লা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। তাই তাদের সেনাবাহিনীর সমরাস্ত্রও বিশে^র সেরা। রাশিয়ার সেনাবাহিনী আরমাটা ট্যাংক, বুমেরাং ও কুরগানেটসের মতো অত্যাধুনিক আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার ব্যবহার করে। টি-৭২, টি-৮০, টি-৯০ এর মতো ট্যাঙ্কের বদলে রাশিয়া এসব যুদ্ধ যান আনছে। আরমাটা বিশে^র সেরা কয়েকটি ট্যাঙ্কের একটি।
ইউক্রেনের বিমান বাহিনীর মোট বিমান সংখ্যা ২৮৫টি। এর মাঝে ফাইটার জেট ও ইন্টারসেপটর আছে ৪২টি, ডেডিকেটের অ্যাটাক ফাইটার ২৫টি। অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৩৪টি। তবে তাদের ফাইটার বহরের সবই সোভিয়েত যুগের। এগুলোর মাঝে রয়েছে ৩৩টি সুখোই সু-২৭ মাল্টিরোল এয়ারক্রাফট, ১৩টি সু-২৫ অ্যাটাক ফাইটার, ১৮টি সু-২৪ অ্যাটাক ফাইটার এবং ৩৬টি মিগ-২৯ ফাইটার। তবে একটি জায়গায় চমক দেখিয়েছে ইউক্রেন। তারা ইতোমধ্যেই সংগ্রহ করেছে তুরস্কের তৈরি সর্বাধুনিক বেরাকতার টিবি টু ড্রোন। তুরস্কের এই ড্রোনটিকে এখন বিশে^র সেরা কয়েকটি ড্রোনের একটি হিসেবে ধরা হয়। নাগোরনো কারাবাখের যুদ্ধে ও লিবিয়ার সরকারের পক্ষে এই ড্রোনের সফলতা বিশ^কে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ১২টি টিবি টু ড্রোন হাতে পেয়েছে ইউক্রেন। সব মিলিয়ে ৪৮টি কেনার জন্য চুক্তি করেছে তারা।
এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের ক্ষেত্রে ইউক্রেন ব্যবহার করছে সোভিয়েত যুগের এস থ্রি হান্ড্রেড। এছাড়া আছে ‘কুব’ সারফেস টু এয়ার মিসাইল। আরো আছ নাইক-কে-থার্টিসেভেন ‘বুক’ সারফেস টু এয়ার মিসাইল ও মাঝারি পাল্লার তর মিসাইল ব্যাটারি। আছে মাঝারি ও স্বল্প পাল্লার ওএসএ মিসাইল।
অন্যদিকে রাশিয়ার বিমান বাহিনীর বহরে যোগ হয়েছে পঞ্চম প্রজন্মের স্টিলথ ফাইটার সুখোই সু-৫৭। যেটির তুলনা চলে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের এফ-থার্টিফাইভ ফাইটারের সাথে। এছাড়া আছে সু-৩৫, সু-৩৪ ফোরের মতো ফাইটার জেট। আগামী এক দশকে আরো বেশ কয়েকটি মডেলের সর্বাধুনিক ফাইটার যুক্ত করবে রাশিয়া। ইউক্রেনের বিমান বাহিনী যেসব মডেলের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে, রাশিয়া সেগুলোকে অনেক আগেই সার্ভিস থেকে সরিয়ে উন্নত এসব বিমান যুক্ত করেছে।
এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের ক্ষেত্রে এস-৪০০ এর পর রাশিয়া ইতোমধ্যেই এস-৫০০ এর ডেভলমেন্টের কাজ চালাচ্ছে। এস-৪০০ কে এই মূহুর্তে বিশে^র সবচেয়ে উন্নত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর রাশিয়ার মিসাইল ভাণ্ডার যা আছে তা দিয়ে শুধু ইউক্রেন কেন, পুরো পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে হামলা চালাতে পারবে তারা। এক্ষেত্রে তাদের সেরা অস্ত্র আর-থার্টি সিক্স এম ব্যালেস্টিক মিসাইল। ন্যাটো যার কোড নেম দিয়েছে শয়তান।
পারমাণবিক অস্ত্রবাহী এই মিসাইলের রেঞ্জ ১৬ হাজার কিলোমিটার। এটির অনেকগুলো সংস্করণ তৈরি করেছে রাশিয়া। মুড ওয়ান থেকে মুড সিক্স পর্যন্ত- এখন পর্যন্ত ছয়টি পৃথক সংস্করণ এসেছে এর। এছাড়াও বিভিন্ন পাল্লার অনেকগুলো মডেলের ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল রয়েছে রাশিয়ার হাতে।
ইউক্রেনের নৌবাহিনী খুবই ছোট। কৃষ্ণ সাগরের উপকূল পাহাড়া দেয়ার জন্য তাদের আছে শুধুমাত্র ১টি ফ্রিগেট, ১টি মাইন অনুসন্ধানী জাহাজ আর ১১টি টহল নৌযান। সাবমেরিন, বিমানবাহী রণতরী, ডেস্ট্রয়ার কিছুই নেই দেশটির। ইউক্রেনের নৌবাহিনী বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর। বাহিনীর বেশির ভাগ ঘাটি ও নৌযান ছিল ক্রিমিয়াতে। কিন্তু সেগুলো আর ফেরত দেয়নি রাশিয়া। যে কারণে আগে থেকেই দুর্বল ইউক্রেনীয় নৌবাহিনী আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্তমানে বাহিনীর সদস্য সংখ্যা মাত্র সাড়ে ছয় হাজার। তবে তুরস্কের কাছ থেকে বেশ কিছু যুদ্ধজাহাজ কেনার চুক্তি করেছে তারা।
অন্যদিকে, রাশিয়ার রয়েছে একটি বিমানবাহী রণতরী। সাবমেরিন রয়েছে ৬০টি। এর মধ্যে ১২ ব্যালেস্টিক মিসাইল সাবমেরিন, ১০ ক্রুজ মিসাইল সাবমেরিন। এসবের মধ্যে ১৪টি সাবমেরিন থেকে পারমাণবিক হামলা চালানো যায়। এছাড়া পাঁচটি ক্রুজার, ১২টি ডেস্ট্রয়ার, ১১টি ফিগ্রেটসহ যুদ্ধজাহাজের বিশাল বহর রয়েছে রাশিয়ার।