সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। নানা ইস্যুতে যত্রতত্র রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিক্ষোভ-অবরোধে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে আদালত প্রাঙ্গণে হামলা চালিয়ে আইনজীবীকে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বেড়েছে খুনের ঘটনাও। বিভিন্ন জায়গায় ‘মব জাস্টিস’ করে গণপিটুনির ঘটনায় সৃষ্টি হয়েছে উদ্বেগ। গত তিন মাসে গণপিটুনিতে খুন হয়েছেন অন্তত ৬৮ জন। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দেশীয় অস্ত্রসহ লাঠি হাতে হরহামেশাই মহড়া দিতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন গ্রুপকে। এতে তৈরি হচ্ছে ভীতিকর পরিস্থিতি। এসব কারণে জনমনে বিরাজ করছে আতঙ্ক। সব ঘটনায় মামলা হচ্ছে না। তবে পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, দুই মাসে (সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) সারা দেশে মামলা হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত দুই মাসে (সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) সারা দেশের থানাগুলোয় মামলা হয়েছে ২৫ হাজার ৪৫৬টি। এর মধ্যে খুন ও ধর্ষণের মামলা হয়েছে ১ হাজার ২৯৬টি। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৫২২টি (রোহিঙ্গা খুনের তথ্য এখানে নেই)। ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১১১টি। ওই দুই মাসে দস্যুতার ঘটনায় ২৩১টি, দ্রুত বিচার আইনে ২২১টি, দাঙ্গা সংক্রান্ত ২৪টি এবং ধর্ষণের ঘটনায় ৭৭৪টি মামলা হয়েছে। এছাড়া নারী নির্যাতনের ১ হাজার ৮৩৩, শিশু নির্যাতনের ৫২৯, অপহরণের ১৬১, পুলিশ আক্রান্তের ৫৮, সিঁধেল চুরির ৪৮১ এবং চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ৩২৮টি। অন্যান্য কারণে মামলা হয়েছে ১৩ হজার ২১১টি। ওই দুই মাসে অস্ত্র আইনে ২৭০, বিস্ফোরক আইনে ২১৪, মাদকসংক্রান্ত ৫ হাজার ৯৯ এবং চোরাচালানসংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৩৩৮টি।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের তুলনায় চলতি বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। নির্ধারিত দুই মাসে মাদক মামলা কমেছে সাত হাজার ৫০১টি। গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের তুলনায় এ বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে ৬৮টি। এছাড়া ১৯টি দস্যুতা, ৩৪টি খুন, দ্রুত বিচার আইনের ৫৭টি, দাঙ্গা ১১টি, শিশু নির্যাতন ৫৬টি, অপহরণ ৬৩টি, অস্ত্রসংক্রান্ত ৯টি এবং সিঁধেল চুরির ঘটনা বেড়েছে ২৭টি। অপরদিকে ধর্ষণের ঘটনা কমেছে ১০০টি। আর নারী নির্যাতের ঘটনা কমেছে ১১০টি। আগের বছরের চেয়ে এ বছর ওই দুই মাসে পুলিশ আক্রান্তের ঘটনা কমেছে ৬৭টি। এছাড়া চুরির ৩৭১টি ও চোরাচালানের ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে ১৪৩টি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে ১৬ নভেম্বর খুন, ডাকাতি ও আট মাসের শিশু অপহরণের মতো চাঞ্চল্যকর তিনটি ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। ওইদিন পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকায় বাসায় ঢুকে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী এক চিকিৎসককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। আজিমপুর এলাকার এক বাসা থেকে টাকা ও স্বর্ণালংকার লুটের পাশাপাশি গৃহকর্তার ছোট্ট শিশুকেও তুলে নিয়ে যায় ডাকাতরা। ২০ নভেম্বর হাজারীবাগে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় যুবদল নেতা জিয়াউর রহমান জিয়াকে। এর আগের দিন সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে শাহজাহানপুরে খুন হন ইসমাইল হোসেন রাহাত নামের এক শিক্ষার্থী। ২৮ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে নিহত হয় ১৩ বছর বয়সি এক কিশোর। এর আগের দিন রামপুরায় খুন হন এক রিকশাচালক। ২১ অক্টোবর তেজগাঁওয়ে ছুরিকাঘাতে খুন হন ইমরান হোসেন নামের এক যুবক। ২০ অক্টোবর রামপুরার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মনি কিশোরের লাশ। ১১ অক্টোবর মোহাম্মদপুরে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় রবিউল ইসলাম নামের এক নৈশপ্রহরীকে। ফ্ল্যাট নিয়ে বিরোধের জেরে ১০ অক্টোবর পিটিয়ে হত্যা করা হয় তামিম নামের এক যুবককে। ৭ অক্টোবর যাত্রাবাড়ীতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় জাহাঙ্গীর নামের এক ব্যক্তিকে। এর আগের দিন উত্তরায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান সোহান হোসেন সোহাগ নামের যুবক। ৩০ অক্টোবর যাত্রাবাড়ীতে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় রাসেল শিকদার নামের এক কাঁচামাল ব্যবসায়ীকে। ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানে এক দোকান মালিক ও তার কর্মচারীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর বনানীতে ছোট ভাইয়ের হাতে খুন হন বড় ভাই। ২১ সেপ্টেম্বর ছিনতাইকারীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন রিকশাচালক জিন্নাহ মন্ডল। এর আগের দিন মোহাম্মদপুরে নাসির বিশ্বাস নামের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় আহত হন আরও একজন। ওইদিন আফতাবনগরের ঝোপ থেকে উদ্ধার করা হয় বাংলাদেশ মহিলা সমিতির এক প্রশিক্ষকের লাশ। ১৭ সেপ্টেম্বর বাড্ডায় ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় গৃহবধূ বিথী আক্তারকে। ১৪ সেপ্টেম্বর মুগদায় তুচ্ছ ঘটনায় ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় শাকিল নামের এক যুবককে।
মঙ্গলবার বিকালে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে দুই সন্তানসহ স্বামী-স্ত্রীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এদিন চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিতে তার সমর্থকদের হামলায় সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে এক আইনজীবী নিহত হন। ঘটনাটি ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়। পাবনায় গত দেড় মাসে খুনের ঘটনা ঘটেছে সাতটি। এ হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে ১৭ নভেম্বর তুষার হোসেন (১৬) নামের কিশোরকে কুপিয়ে খুন এবং ১৮ নভেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে ওয়ালিফ হোসেন মানিক (৩৫) নামের এক যুবলীগ কর্মীকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনা দুটি ছিল খুবই চাঞ্চল্যকর। ২৫ নভেম্বর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে নিজ দলের প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন বিলাল আহমদ মুন্সী (৩৫) নামের এক যুবদল কর্মী। ৩১ অক্টোবর সুনামগঞ্জে বসতঘরের ভেতর মা ও ছেলেকে হত্যার ঘটনাটি দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় বাড়ির ডিপ ফ্রিজ থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায়ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। নভেম্বরের দুই সপ্তাহে রূপগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ ও ঝিনাইদহে চালককে হত্যা করে ইজিবাইক ছিনতাই করা হয়। ১০ নভেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সানারপাড় বাসস্ট্যান্ডে এক পুলিশ সদস্যকে ‘ভুয়া পুলিশ’ আখ্যা দিয়ে গণপিটুনি দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, অপরাধ কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। অপরাধের যেসব কারণ, সেগুলো সামাজিকভাবে ও ফৌজদারি বিচারিক কার্যক্রমের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। তবে অপরাধের মাত্রা যাতে কমিয়ে আনা যায় এবং অপরাধীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, সেজন্য পুলিশ সর্বদা তৎপর রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। পেশাদারির সঙ্গে আইনানুগ দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে পুলিশ কাজ করছে। পাশাপাশি জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় এবং নগরবাসীর অসুবিধার সৃষ্টি হয়-এমন কোনো ধরনের কাজ যেন কেউ না করে, সেজন্য সবার প্রতি আহ্বান জানাই। (যুগান্তর)