অনলাইন ডেস্ক:
লবিং-গ্রুপিং আর নেতৃত্বের প্রতিযোগিতাই রাজনীতির সৌন্দর্য। তবে স্থায়ী রূপ নিয়েছে জাতীয় পার্টির (জাপা) লড়াই-গ্রুপিং। এ লড়াই পার্টির চেয়ারম্যান পদ নিয়ে। চেয়ারম্যান হওয়ার বাসনা দলের দুই নেতার। একজন এরশাদপত্নী রওশন এরশাদ অন্যজন এরশাদের ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের। শীর্ষ নেতৃত্বের চেয়ার পেতে কাদেরের পুঁজি ব্যক্তি ইমেজ এবং উত্তরাধিকার আর রওশনের ডানে-বাঁয়ে সিনিয়র নেতা ছাড়াও আছে উচ্চ মহলের বিশেষ আশীর্বাদ। পার্টির একাধিক নেতার মন্তব্য, জাপার নেতৃত্বে নতুন মোড় নিতে পারে শিগগিরই। আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো জাপাতেও আসতে পারে নারী নেতৃত্ব। তবে তার জন্য পার্টির কাউন্সিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর আগ পর্যন্ত থাকছেন পুরুষ নেতৃত্বই।
কালের আবর্তে পাঁচ খণ্ড হয়েছে জাতীয় পার্টি। জাপার প্রতিষ্ঠাতা এইচএম এরশাদের মৃত্যুর আগের গ্রুপিং এখন পরিণত হয়েছে অগ্নিগর্ভে। প্রয়াত এরশাদের স্মরণে সভার আয়োজন করছেন জি এম কাদেরপন্থিরা। তবে গ্রুপিংয়ের কারণে তাতে অংশ নিচ্ছেন না রওশনপন্থি নেতাকর্মীরা।
এ চিত্র দেখে পার্টির নীতিনির্ধারকরা আশঙ্কা করছেন, নেতৃত্বের বাহ্যিক লড়াইটা হয়তো উপযুক্ত সময়ের জন্য থমকে আছে। তবে তা যেকোনো সময় প্রকাশ্য রূপ নেবে। সব কূল বিবেচনায় এখনই বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত না নিলে দলটি আবারো খণ্ডিত হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এম হাফিজ উদ্দিন খান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, নদীভাঙনের মতো কালে কালে ভেঙেছে জাতীয় পার্টি। এরশাদের জীবদ্দশায় দলটি পাঁচ খণ্ড হয়েছে, তার মৃত্যুর পর আরো খণ্ডিত হবে বলে তাদের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে।
দলের বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির সাবেক ও দীর্ঘ সময়ের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, যে যখন দায়িত্বে থাকে চেষ্টা করে ভালো করতে কিন্তু প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক হলেই কেবল সমালোচনা হয়ে থাকে।
তিনি মনে করেন, দলের সঠিক ও শীর্ষ নেতৃত্ব দেখতে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। সাধারণ নেতাকর্মীদের চাহিদামতো জাতীয় পার্টি গঠন করাই প্রয়াত চেয়ারম্যানের শেষ ইচ্ছা ছিল বলে জানান হাওলাদার।
দলের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের খবরকে জানান, রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদেরের দূরত্ব বহুদিনের। একসময় রওশন এরশাদ ছিলেন বিএনপির সঙ্গে জোটের পক্ষপাতী। জিএম কাদের ছিলেন এর বিপক্ষে। পরে রওশন আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকলে জিএম কাদের সরকারের সমালোচক হিসেবে আবির্ভূত হন।
আলোচনা রয়েছে, এই সময়ে জাতীয় পার্টি দুই বলয়ে বিভক্ত। একটি বলয় রওশন এরশাদকেই পার্টির প্রধান ধরে ভবিষ্যৎ হিসাব কষছেন। তাতে সায় আছে সরকারের উচ্চ মহলেরও। সংসদ নেতার জন্য অপেক্ষা করছেন রওশন এরশাদ। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন স্বামীর মৃত্যুর ৪০ দিনের মধ্যে তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেবেন না। আগামী ২২ আগস্ট এরশাদের মৃত্যুর ৪০ দিন পূর্ণ হবে। এরই মধ্যে দেশে ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন রওশন এরশাদ। সংসদের বিরোধীদলীয় নেতাসহ বেশ কয়েকটি ইস্যু নিয়ে তিনি বৈঠক করবেন। রওশন এরশাদ নিজেই চেয়ারম্যান হতে আগ্রহী। এর জন্য এরশাদের জীবদ্দশায় তিনি রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছেন।
জাতীয় পার্টিতে এই সময়ে রওশনপন্থি হিসেবে চাউর রয়েছে পার্টির প্রেসিডিয়াম মেম্বার ড. আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ফিরোজ রশিদ, ফখরুল ইমাম ও সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারসহ সিনিয়র নেতা এবং বেশিরভাগ এমপির নাম। রওশন এরশাদ তার স্বামীর মৃত্যুর ৪০ দিনের বিধিনিষেধের কারণে সভায় অংশ নিচ্ছেন না, তবে তার অনুসারীরাও একই পথ অবলম্বন করছেন।
এদিকে ছোট ভাই জিএম কাদেরকে তার চেয়ারে দেখার স্বপ্ন থেকেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন এরশাদ। দলের মধ্য ও তৃণমূল নেতাকর্মীরাও এরশাদের এই সিদ্ধান্তকে সঠিক আখ্যা দিয়ে কাদের আহুত সভা-সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন। তার সঙ্গে আছেন কিছু সিনিয়র নেতাসহ সংসদের এমপিরাও। পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার বাড়ি উত্তরাঞ্চলে। তাই মহাসচিব হিসেবে রাঙ্গাকেই গ্রহণ করেছেন তিনি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি কমিটিও দিয়েছেন। বিভিন্ন স্তরে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করছেন। এ নিয়ে রওশান এরশাদ ক্ষুব্ধ। রওশনের মান ভাঙাতে এবং দলের দ্বন্দ্ব দূর করতে গত ২০ জুলাই রাজধানীর গুলশানে রওশনের বাসভবনে বৈঠক করেন কাদের। কিন্তু ক্ষোভ কাটেনি রওশনের। তাই রাঙ্গার ঘোষণায় ‘জাপার চেয়ারম্যান কাদের’ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রওশন এরশাদ। তিনি কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তাই বিবৃতি দিয়ে ক্ষোভের কথা প্রকাশ করেছেন।
২০১৬ সালে জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান করেন এরশাদ। রওশন এরশাদ এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। নানা নাটকীয়তার পর তাকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করা হয়। একাদশ নির্বাচনের পর প্রথমে জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় উপনেতা করা হয়। পরে তাকে সরিয়ে রওশন এরশাদকে এ পদ দেন এরশাদ। জিএম কাদের তখন কো-চেয়ারমম্যান পদ হারালেও পরে রংপুরের নেতাদের চাপে ফিরে পান।
দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, রওশন এরশাদ পার্টির সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। কিন্তু সারা দেশে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যে বয়সের প্রয়োজন, তার এখন তা নেই।