টানা ভারী বর্ষণে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার শত শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। খাবারের কষ্ট এবং গৃহপালিত পশু নিয়ে দুর্বিষহ দিনযাপন করছেন তারা। বসতবাড়ি, মাঠ-রাস্তাঘাট, চাষকৃত পুকুর ও ঘেরের মাছ, বীজতলা ও ফসলিখেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সকাল থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, সদর উপজেলার বাগাদী, ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা, কড়ইতলি, পৌরসভা, রূপসা, গুপ্টি পূর্ব এবং গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নে অতি বৃষ্টির কারণে বহু ঘরবাড়ি ও সড়ক পানিতে নিমজ্জিত। এ ছাড়া এদিন সকাল থেকে পুরো জেলায় হালকা থেকে মাঝারি আকারের বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, এসব এলাকায় বেশির ভাগ মানুষের বাড়িতে পানি, উঠানে পানি থই থই করছে। কোনোভাবে চলছে জীবনযাপন। রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে।
সদর উপজেলার বাগাদি ইউনিয়নের বাসিন্দা জামাল হোসেন বলেন, গত চার দিনের বৃষ্টিতে আমার তিনটি ঘরে পানি উঠেছে। গবাদিপশু নিয়ে খুবই বিপাকে আছি। রান্নাও করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ নেই গত দুদিন। কেউ এসে আমাদের খোঁজখবরও নেয় না।
ফরিদগঞ্জ পৌরসভার পশ্চিম বড়ালি গ্রামের গ্রামের রবিন ও মাসুদ বলেন, গত চার দিনের বৃষ্টিতে আমাদের বাড়িতে পানি উঠেছে। আমাদের ঘরবাড়ি তলিয়ে যাচ্ছে। চুলা, রান্নাঘর সব পানির নিচে। তাই রান্না করে খেতে পারছি না। এ ছাড়া কাজও বন্ধ। গবাদিপশু নিয়ে আছি খুবই বিপাকে। এখন আমাদের খুব কঠিন অবস্থা যাচ্ছে।
সুমন নামের এক যুবক বলেন, আমার বড় ভাই কাউন্সিলর জাহিদ খানের মুরগির খামারের ১৫০০ মুরগি বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে অর্ধেক মুরড়ি পেয়েছি। যার অর্ধেক আবার মারা গেছে। পানির কারণে বাড়িতে ঢুকতে পারছি না। তাই কলাগাছ কেটে ভেলা বানিয়ে বাড়িতে যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছি।
ফরিদগঞ্জ পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমি একজন প্রতিবন্ধী। এলাকায় একটি দোকান দিয়ে সংসার চালাই। বৃষ্টির পানিতে তা তলিয়ে গেছে। তিনি সরকারি সহায়তা কামনা করেন।
নারকেলতলা এলাকার রফিক বলেন, আমাদের এখানে বন্যার অবস্থা খুবই খারাপ। ২০০৪ সালের চেয়ে এখন পানির পরিমাণ বেশি। রান্না করার মতো অবস্থা নেই। তাই সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।
রূপসা উত্তর ইউনিয়নের বদরপুর এলাকার আলমগীর পাটোয়ারী বলেন, আমি দুই লাখ টাকার মাছ চাষ করেছি। বৃষ্টির পানিতে সব মাছ শেষ হয়ে গেছে।
রূপসা গ্রামের রেনু বেগম বলেন, বৃষ্টির পানিতে ঘরের ভেতর ও বাইরে পানি। রান্নাঘরেও পানি। খাওয়া-দাওয়া করতে পারছি না। বাচ্চাদের নিয়ে খুব বিপদে আছি। সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
ফরিদগঞ্জ বালিথুবা ইউনিয়নের গাঁও গ্রামের সৈয়দ গাজী বলেন, টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা হয়ে গ্রামের অনেকেই পানিবন্দি। রাস্তায় পানি থাকায় বাড়ি থেকে বের হতে পারছি না।
পাশের মানিকরাজ গ্রামের সোহেল আহমেদ বলেন, আজকে দুদিন এলাকার প্রায় ১০ বাড়ির লোকজন পানির কারণে বাড়ি থেকে নামতে পারছে না। বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের নিয়ে অনেক কষ্টে রাস্তা পার হতে হয়। পানি না কমায় ফসলেরও ক্ষতি হচ্ছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার শ্রমিক দলের সভাপতি আজিম খান বলেন, বৃষ্টির পানিতে প্রায় ২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালের চেয়ে এবার পানি বেশি।
চরবাগাদি পাম্প হাউজের মেশিন অপারেটর মো. হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি পানি নিষ্কাশনের। দিন ও রাতে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বর্তমানে সেচ প্রকল্পের ভেতরে পানির লেভেল ৩.৯৫ থেকে ৪.২০ মিলিমিটার। এটা বাড়ছে এবং কমছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, বৃষ্টি মৌসুমের আগে থেকেই আমরা উপজেলা মৎস্য খামারিদের নেট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছি। সে আলোকে তারা ব্যবস্থা নিয়েছেন। তারপরও গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে অনেক খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাব।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কল্লোর কিশোর সরকার বলেন, গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে উপজেলায় ১৬২ টন হেক্টর আউশ ধান, আমনের বীজতলা ২৬০ হেক্টর, রোপণকৃত আমন ৩৯৫ হেক্টর, বিভিন্ন শাকসবজি ১২৫ হেক্টর এবং ১২৮ হেক্টর আখের ফসল বৃষ্টির পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছি। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করব, যেন তাদের পুনর্বাসন করা যায়।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌলি মন্ডল বলেন, উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়নে অতিবৃষ্টির কারণে লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের খোঁজখবর নিচ্ছি। আমাদের সকল দপ্তরের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। সাড়ে ৩০০ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। তবে পৌরসভায় পানি একটু কম।
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মো. রহুল আমিন বলেন, গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে সেচ প্রকল্প এলাকায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকল্প এলাকা হচ্ছে ১০০ কিলোমিটার। আমরা পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। পানি কমালেও বৃষ্টিতে আবার একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের পাম্প হাউজ ছাড়াও প্রকল্প এলাকার হাজিমারা পাম্প হাউজ দিয়ে পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে। আশা করি বৃষ্টি কমলে দুদিনের মধ্যে পানি স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বশির আহমেদ বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে জেলার কয়েকটি উপজেলার লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে শাহরাস্তি উপজেলায় ২৮ হাজার ৯৪০টি পরিবার, হাজীগঞ্জ উপজেলার এক ইউনিয়নে ১২ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৪ ইউনিয়নের ৬০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তাদেরকে শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সদরের ৮ ইউনিয়নের ৮০০ এবং হাইমচরে এক হাজার পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধ নজরদারিতে রাখা হয়েছে। মেঘনার পানির বর্তমান লেভেল হচ্ছে ৩.৭৮ মিলিমিটার।