• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২৫ জুন, ২০২২
সর্বশেষ আপডেট : ২৫ জুন, ২০২২

করণিক থেকে জালিয়াতি করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, ৮২ লাখ টাকা আত্মসাৎ

অনলাইন ডেস্ক
[sharethis-inline-buttons]

মো. জহির হোসেন॥

চাঁদপুর সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ফরক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ হান্নান মিজি। তিনি ১৯৯৫ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চাকরী বিধি না মেনে জালিয়াতির মাধ্যমে করণিক হিসেবে নিয়োগ পান। নিয়োগ প্রক্রিয়াটি নিয়ম বহির্ভুত থাকলেও পর্যায়ক্রমে দুর্নীতির মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক হিসেবে একই বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এরপর সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং সর্বশেষ তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে। তার করণিক থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া জালিয়াতি এবং বড় ধরণের এক দুর্নীতি। তিনি প্রতারণা করে এই পর্যন্ত সরকারের ৮২ লাখ টাকার অধিক আত্মসাৎ করেছেন। এসব ঘটনায় বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য তার বিরুদ্ধে চাঁদপুর আদালতে দুটি পৃথক মামলা করেছেন। একই সাথে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এর মহাপরিচালকসহ সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

সম্প্রতি দুর্নীতিতে অভিযুক্ত শিক্ষক হান্নান মিজির দীর্ঘ প্রায় ২৮ বছরের জালিয়াতির সব ধরণের কাগজপত্র ও মামলার কপি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানাগেছে, হান্নান মিজি ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জালিয়াতি ও প্রতারণা করে বিদ্যালয়ে করণিক, সহকারী শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও বিগত দিনের পরিচালনা পর্ষদ একজন প্রভাবশালী নেতার কারণে কোন ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি, এ নেতা আবার মোঃ হান্নান মিজির বাল্যবন্ধু ও একসাথে উক্ত বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। আইনগত ব্যবস্থা না নেয়ায় দায়িত্ব অবহেলার মধ্যে পড়েন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক/সদস্য সচিবরাও।

তার এসব জালিয়াতির খোঁজ ও তথ্য জানতে পেরে বিদ্যালয়ের সর্বশেষ পরিচালনা পর্ষদের অভিভাবক সদস্য মোঃ জাহাঙ্গীর হোসাইন বাদী হয়ে চাঁদপুর আদালতে নির্দিষ্ট জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে হান্নান মিজির বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করেন (মামলা চলমান)। একই সাথে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এর মহাপরিচালক বরাবর বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে অভিযোগ করেন।

মামলা ও অভিযোগের বিবরণ থেকে জানাগেছে, ১৯৯৫ সালে হান্নান মিজি বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করণিক হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্ত ওই নিয়োগ ওই সময়কার চাকরী বিধির নিয়ম গোপন রেখেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এরপর ১৯৯৯ সালের ৩১ মে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের ৩১তম সভায় সিদ্ধান্ত ছিল ৩জন শিক্ষককে মাষ্টার রুলে নিয়োগ প্রদান। তারা হলেন- ক. মো. মাসুদুর রহমান তপদার, খ. মোজ্জাম্মেল হক ঢালী ও গ. মো. জাহাঙ্গীর আলম। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে মোঃ হান্নান মিজির মাস্টার রোলে নিয়োগের কথা রেজুলেশনে উল্লেখ ছিলনা। সভার পরে প্রভাব খাটিয়ে ‘ঘ’ বর্ণ ব্যবহার করে ৪র্থ ব্যাক্তি হিসেবে নিয়োগ দেখান হান্নান। রেজুলেশনে লেখা মুছে আবার নতুন করে অন্য হাতের লেখা খুবই স্পষ্ট। এই জালিয়াতি থেকে শুরু করে বাকী পদে চাকরীর চূড়ান্ত পর্যায়ের দুর্নীতিতে অবতীর্ণ হন তিনি।

এই রেজুলেশনের উপর ভিত্তি করে হান্নান পরবর্তীতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত হন। কিন্তু সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত হওয়ার জন্য ওই সময়কার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিধি ২০৩ অনুযায়ী স্নাতকসহ বিএ, বিএড সকল পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেনী/বিভাগ থাকতে হবে। কিন্তু হান্নান মিজির সনদপত্রে স্নাতক সম্পূরক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, এইচএসসি তৃতীয় ও এসএসসিতে দ্বিতীয়। এইসব তথ্য গোপন রেখে এবং প্রভাব খাটিয়ে ২০১৫ সালে তিনি আবার সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান।

জালিয়াতি এখানেই শেষ নয়, হান্নান মিজি করণিক পদ থেকে পদত্যাগ না করেই সহকারী শিক্ষক হিসেবে মাষ্টার রোলে নিয়োগ পান ১৯৯৯ সালে। এরপর তিনি ২০০১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত জালিয়াতি করে করণিক ও সহকারী শিক্ষক হিসেবে সরকারিসহ সব ধরনের দুটি বেতন-ভাতা একই সঙ্গে সুবিধা গ্রহন করেন।

এদিকে, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদটি শূন্য। কিন্তু মোঃ হান্নান মিজি অবৈধভাবে প্রভাব খাটিয়ে প্রধান শিক্ষকের পদটিও ভারপ্রাপ্ত প্রদান শিক্ষক হিসেবে দখল করে আছেন। বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ বার বার প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদটি পূরণ করার জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে হান্নান মিজি প্রধান শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে রেখেছেন।

অভিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. হান্নান মিজি এই বিষয়ে বলেন, আমার সনদপত্র যা দেয়া আছে তা সঠিক। আমি বিএ,বিএড পাশ করেছি। কোন ধরণের প্রতারণা কিংবা জালিয়াতি করিনি। তবে করণিক পদ থেকে অব্যাহতি না দিয়েই সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়েছি। যদি অব্যাহতির পর সহকারী শিক্ষক নিয়োগ না হত, তাহলে আমি চাকরী হারাতাম। যে কারণে অব্যাহতি দেইনি। তবে আমি কোন কাজেই প্রভাব খাটাইনি। বরং সাবেক প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন হাওলাদার আমার নিয়োগের রেজুলেশন বুক বুঝিয়ে দেননি। যার কারণে আমি থানায় জিডি করেছি।

মামলার বাদী মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন বলেন, হান্নান মিজির প্রথম করনিক পদে নিয়োগই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চাকরী বিধির মধ্যে হয়নি। যার ফলে গত ২৭ বছর তিনি সরকারের যে বেতন ভাতা ভোগ করেছেন তার পরিমান প্রায় ৮২ লাখ টাকার অধিক। ইতোমধ্যে তার জালিয়াতির কয়েকটির প্রমাণ আদালতে শিক্ষা কর্মকর্তা তদন্ত শেষে মতামত দিয়েছেন।

সাবেক প্রধান শিক্ষক রুহুল হাওলাদার বলেন, আমি দায়িত্ব শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হান্নান মিজিকে তালিকা করে বুঝিয়ে দিয়েছি। তিনি সঠিক কথা বলছেন না।

বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি ড. মো. হাসান খান বলেন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. হান্নান মিজির চাকরীতে যোগদানের কাগজপত্রের বিষয়টি আমি দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে গোপন ছিল। তাকে সহকারী প্রধান শিক্ষক কিংবা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হওয়ার বিষয়ে আমাদের কোন হাত ছিল না। তার বাল্যবন্ধু কেন্দ্রীয় নেতা সুজিত রায় নন্দী। তার বিভিন্ন পদে পদায়নের বিষয়টি তিনিই প্রভাব বিস্তার করে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিয়েছেন। কেউ এসব বিষয়ে এখনো প্রতিবাদ করলে তাকে চরম হয়রানির শিকার হতে হয়। যারা বিগত দিনে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখনও করেন সকলের কাছে একই তথ্য পাওয়া যাবে।

বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান সভাপতি সিরাজুল ইসলাম তালুকদার বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদ গত ৪ বছর শূন্য। বর্তমান পর্ষদ চেষ্টা করেছে একজন প্রধান শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া করার জন্য। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পক্ষে চাঁদপুরের জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও একজন কেন্দ্রীয় নেতার তদ্বির ও আকুতি মিনতির কারণে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারি নাই। তবে তার বিষয়ে যেসব অভিযোগ এবং মামলা হয়েছে এসব বিষয়গুলোর জন্য আগের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকরাও ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কারণ তারাই তাকে নিয়োগের সহযোগিতা করেছেন। আমিও বিভিন্ন ধরণের চাপে করতে পারিনি।

চাঁদপুর জেলা শিক্ষা অফিসের গবেষণা কর্মকর্তা ও মামলার তদন্ত অফিসার মোহাম্মদ মাসুদুল আলম ভুঁইয়া বলেন, হান্নান মিজির বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। একটি মামলার তদন্ত রিপোর্ট আমি দিয়েছি। বোর্ডের একটি অভিযোগের তদন্ত আমার কাছে আছে। সেটির রিপোর্ট এখনো দেইনি। প্রথম তদন্তে আমি মতামত দিয়েছি-আসামী মো. হান্নান মিজি ১৯৯৫ সালের ০১ জুলাই হতে ২০০১ সালের মার্চ পর্যন্ত করণিক হিসেবে বেতন ভাতা গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৯৯ সালের ৫ মে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সময় করণীক পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার কোন কাগজপত্র এবং সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল বিবরণী, নিয়োগপত্র ও যোগদানপত্র উপস্থাপন করতে পারেননি। তিনি যে একই সাথে দুই পদের টাকা উত্তোলন করেছন সেই কাগজপত্রও বাদী ও বিবাদী কেউ দেখাতে পারেননি।

Sharing is caring!

[sharethis-inline-buttons]

আরও পড়ুন

  • চাঁদপুর সদর এর আরও খবর
error: Content is protected !!