অনলাইন ডেস্ক:
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয়দানকারী প্রিয়া সাহার উদ্ভট দেশবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক অভিযোগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তুমুল সমালোচনার ঝড় বইছে। তার এই অভিযোগকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেকেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রিয়া সাহার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলায় চরবানিরীর মাটিভাঙ্গাতে। তার স্বামীর নাম মলয় সাহা। তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন কর্মচারী। থাকেন ঢাকায়। দুই মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশুনার সুবাদে প্রিয়া সাহা প্রায়ই সেদেশে যাতায়াত করেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এ ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ ও আবেদনের সুরে বলছেন, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং সেখানে ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লাখ) হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এরইমধ্যে উধাও হয়ে গেছে । এখনও এক কোটি ৮০ লাখ আছে। যার মধ্যে ১৭ লাখ শিশু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করে। আমাদেরকে সাহায্য করুন। আমি আমার ঘর হারিয়েছি, জমি হারিয়েছি। ইতোমধ্যেই আমার বাড়ি-ঘর দখল করেছে। জ্বালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা সরকার থেকে এর কোনো বিচার পাই নাই। আমরা বাংলাদেশেই থাকতে চাই। আমরা বাংলাদেশ ছাড়তে চাই না। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন।
তার এ নালিশের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জিজ্ঞাসা করেন, কারা এর পেছনে আছে? কারা তোমার বাড়ি-ঘর দখল করেছে।
জবাবে প্রিয়া সাহা বলেন, এর পেছনে মুসলিম মৌলবাদীরা জড়িত। তারা সব সময় রাজনৈতিক সেল্টার পেয়ে থাকে। সব সময়ই পেয়ে থাকে।
এ সময় প্রিয়া সাহার দিকে ট্রাম্পকে হাত বাড়িয়ে দিতে দেখা যায়। প্রিয়া সাহাকে ট্রাম্পের সঙ্গে খুব আগ্রহ নিয়ে হাত মেলাতে দেখা যায়।
জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হওয়া কয়েকজন ব্যক্তি গত বুধবার (১৭ জুলাই) ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউজে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে চীন, তুরস্ক, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমারসহ ১৭টি দেশের নির্যাতিত ব্যক্তিরা ছিলেন।
প্রিয়া সাহার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল চ্যানেল টোয়েন্টিফোরকে বলেছেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশি নারীর নালিশ চক্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
পিরোজপুরে কর্মরত একটি জাতীয় পত্রিকার প্রতিনিধি শিরিনী আফরোজ তার ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘প্রিয়া শাহার দুই মেয়ে অ্যামেরিকায় পড়াশুনা করে। ওর স্বামী মলয় শাহা দুদকের বদনামী একজন কর্মকর্তা। কদিন আগে এই মহিলা প্রায় কোটি টাকার গাড়ি কিনেছেন। এই মহিলা আর তার দোসররা দেশে বসে সরকারের পা চেটে রাজকীয় জীবন নিশ্চিত করে আর বিদেশে গিয়ে আমার সোনার বাংলার বদনাম করে। সরকারের ভাবমুর্তি নষ্ট করে। সরকারের কিছু এমপি মন্ত্রীর এখন থেকেই এদের ব্যাপারে সাবধান হওয়া উচিত।’
প্রিয়া সাহার বক্তব্য ও অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল দৈনিক জাগরণকে তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ওই মহিলার এ ধরনের বক্তব্য ফেসবুকে দেখলাম। কী বলব? তার সব কথাই মিথ্যা। সে দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে চরম মিথ্যাচার করেছে। দেশের বিরুদ্ধে কথা বলা ও কর্মকাণ্ড করা তো অবশ্যই দেশদ্রোহিতা। আমি তার বিচার দাবি করি।
অপু উকিল আরও বলেন, মাঝে মাঝে আমরা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা করতে যাই। তখন ওই মহিলাকে দেখি। নিজের দেশ নিয়ে অন্যদেশের বিশেষ করে একটি পরাশক্তি দেশের প্রেসিডেন্টের কাছে সে যে বক্তব্য বা নালিশ করেছে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ঘৃণ্য মিথ্যাচার। তার সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক কোনো যোগাযোগ নেই। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সঙ্গেও আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আপনারা পূজা কমিটির নেতা বা লোকজনকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করুন।
রাজনৈতিক বিট (আওয়ামী লীগ ও পিএমও) কাজ করেন এশিয়ান টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার লাবন্য ভুইয়া। তিনি প্রিয়া সাহার দেশবিরোধী এ কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে রাজার হালে থেকেও ট্রাম্পের কাছে নালিশ করতে গেছে এই মহিলা.. বাংলাদেশে ৮% হিন্দু ৩৩% সরকারি চাকুরী করছে..অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে ৩০% মুসলিম ২% সরকারি চাকুরী করছে..
বাংলাদেশে নাকি ৩৭ মিলিয়ন অর্থাৎ ৩ কোটি ৭০ লক্ষ হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান গুম হয়ে গেছে..?
বাংলাদেশের মুসলিম মৌলবাদীরা নাকি তার জায়গাজমি দখল ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে…?
বিচার দিয়ে এসেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে এবং ট্রাম্পের সাহার্য্য কামনা করছে… যে অপশক্তি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করার জন্য তাদের দোসররা আবার সক্রিয়। এদেশে সংখ্যালঘুরা হাজার গুণে ভালো আছে। ভালো ভালো পজিশনে থেকে, রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা উপভোগ করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বদনাম করার সাহস পায় কীভাবে?
জিনান হোসেন নামের একজন তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘ভয়ংকর ষড়যন্ত্র চলছে। দেশদ্রোহীদের প্রতিহত করুন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে হিন্দু গুমের মিথ্যা তথ্য দেয়া মহিলার নাম প্রিয়া সাহা। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
তরুণ সংবাদকর্মী সুশান্ত সাহা প্রিয়া সাহার অভিযোগের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তার এ ধরনের বক্তব্য ও পদক্ষেপ আমাদের দেশের বিরুদ্ধে নিছক অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলাদেশ শান্তির দেশ। এখানে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। আমি ওই মহিলার দেশ বিরোধী অপপ্রচারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
প্রিয়া সাহার দেশবিরোধী এ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে নারী নেত্রী সুলতানা কামাল বলেন, আমার স্বামী অসুস্থ। আমি তাকে নিয়ে হাসপাতালে আছি। এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কথা বলতে পারছি না। পরে বলব।
ফ্রান্স প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ফারুক নেওয়াজ খান তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে এ মহিলা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলছে বাংলাদেশ থেকে নাকি ৩৭ মিলিয়ন অর্থাৎ ৩ কোটি ৭০ লাখ বাংলা নামধারীদের (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান) গুম করা হয়েছে ! নিজের পরিবার ও নিজেকে একজন ভুক্তভোগী দাবি করা এ মহিলা বলছে এখনো নাকি বাংলাদেশে ১৮ মিলিয়ন বা এক কোটি ৮০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যা লঘু মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে।’ প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে কি সব মিলিয়ে সাড়ে পাচ কোটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু রয়েছে বা ছিল? এ মহিলার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে তাকে বিচারের সম্মুখীন করা দরকার।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক দৈনিক জাগরণকে প্রিয়া সাহার বক্তব্যের বিষয়ে বলেন, ঐক্য পরিষদ গঠনের শুরু থেকেই আমরা চেয়েছি দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার আসুক। যেখানে সমস্যা সেখানেই মীমাংসা ঘটুক। সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা কমিটিতে নেয়া হোক।
প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে দেশবিরোধী প্রপাগান্ডা হিসেবে সবার সমালোচনাকে কীভাবে দেখছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনি সবার কথা বলছেন। আমি আমার কথা বলেছি। আপনি কী লিখবেন তা তো আপনার বিষয়। এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায়। আমরা চাই যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকুক। কাজেই প্রশাসন, সমাজ ও রাজনীতিতে যে সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে, তা আমরা সবাই মিলে মোকাবিলা করব।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী এক প্রশ্নের শুরুতে পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, প্রিয়া সাহা আমেরিকাতে গেল কেমনে? ট্রাম্প পর্যন্ত গেল কেমনে? ট্রাম্প পর্যন্ত পৌঁছতে পারা তো বিশাল ব্যাপার। জেনে রাখুন, সে (প্রিয়া সাহা) আওয়ামী লীগ ঘরানার লোক। সে সরকারের কাছের মানুষ। ইচ্ছা করলেই এ ধরনের সফরে যে কেউ যেতে পারে না। প্রতি বছরই বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে আমেরিকার বাংলাদেশ ককাসে এ ধরনের প্রোগ্রাম হয়। জুরিখেও হয়। সেসব প্রোগ্রামে সবসময় সরকারের কাছের লোকজনকেই সরকার পাঠায়। এর বাইরে বিভিন্ন এনজিও থেকেও কেউ কেউ যায়।
ঐক্য পরিষদের অন্যতম নেতা সুব্রত চৌধুরী আরও বলেন, বাংলাদেশের সরকারি দল সবসময় তাদের নিজস্ব লোকজনকে এসব কর্মসূচিতে নিয়ে যায়। কখনও হিন্দু, কখনও বৌদ্ধ, কখনও খ্রিস্টান। গিয়ে তাদের দিয়ে সরকার বলায় যে ‘আমরা খুব ভালো আছি।’
তিনি বলেন, আমি যতদূর জানি এবারও সরকারি দলে গেছে নির্মল চ্যাটার্জি, ঐক্য পরিষদের নির্মল রোজারীও ও অশোক বড়ুয়া। এই ৩ জন সরকারি দলে গেছে। সরকারি দলের বাইরে বেসরকারি দলের লোকজনও থাকে। প্রিয়া একটি সংগঠন করে, যার নাম শাড়ি। সে মাইনরিটি গ্রুপের একটি পত্রিকাও প্রকাশ করে। সে বিভিন্ন কাজ-কর্ম করে থাকে। এর আগে রানা দাশগুপ্ত জেনেভায় গিয়েছিলেন সরকারি দলে। সেখানে বেসরকারি দলেরও একটি গ্রুপ গিয়েছিল। তারা গিয়ে একটু কথা বলে। আর সরকারি দলের লোকেরা ‘হ্যাঁ-হু’ করে। তাদের মুখ বন্ধ থাকে।
অ্যাডভোকেট সুব্রত আরও বলেন, প্রিয়ার পরিসংখ্যানগত তথ্য আমি হয়ত সমর্থন করব না। তবে এটা সত্যি প্রিয়ার বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে গত বছর। তার কিছু জায়গা-জমি দখল করেছে, তা আমিও জানি। ঢাকা থেকে অনেকেই গেছে এটা দেখতে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে নিউজও এসেছে। ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলনও করেছে। তার পরিসংখ্যান বাদ দিলে তার উপর যে আক্রমণ- তা ঠিক আছে। এখন কী বলবেন? ওই পর্যন্ত যখন যেতে পেরেছে, তখন সে একেবারে খেলনা নয় ! এখানে অনেক লড়াই সংগ্রামে সে আছে। তবে সে যে আওয়ামী ঘরানার তা আমি নিশ্চিত করছি।