ক্রীড়া ডেস্ক:
সশব্দ উল্লাসের প্রস্তুতি ঝিমিয়ে পড়ল হঠাৎ। বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতায় সেটি আর জাগলও না। বরং শোনা গেল হৃদয় ভাঙার নীরব শব্দই।
আল আমরাত স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন ভাগ্যান্বেষণে ওমানে এসে খেটে খাওয়া বাংলাদেশিরাই। সস্তার টিকিট না পেয়ে যাঁদের অনেকেই চড়া মূল্যে ভিআইপি টিকিট কেটেও মাঠে ঢুকতে দ্বিধা করেননি। তাঁদের হাতের লাল-সবুজের পতাকাও রাতের মাসকাটে রীতিমতো অবনমিত। স্কটল্যান্ডের কাছে বাংলাদেশ ৬ রানে হারার পর তা নিশ্চয়ই আর উঁচিয়ে ধরার মুখ থাকে না!
বাংলাদেশের এমন হাল করার হুঙ্কার অবশ্য আগের দিনই দিয়ে রেখেছিলেন স্কটল্যান্ডের কোচ শেন বার্জার। শুনে তা নিয়ে কথা বলায় অনাগ্রহী বিনয়ী অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহ শুধু বলে রেখেছিলেন যে নিজেদের সামর্থ্যটা তাঁরা জানেন। কিন্তু এর প্রতিফলন দেখাতে পারলেন না। বোলিংয়ে স্কটিশদের চেপে ধরার পরেও চাপ এক পর্যায়ে হালকা হয়ে গেল। তাই আরো অনেক কম হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ পায় ১৪১ রানের লক্ষ্য। যে রান তাড়ার শুরুতেই হোঁচট খাওয়া বাংলাদেশের সহায় হতে পারেননি আর কেউই। না সাকিব আল হাসান, না মুশফিকুর রহিম, না মাহমুদ উল্লাহ নিজে।
স্ট্রাইক রেট নিয়ে সমালোচিত নাঈম শেখকে বসিয়ে সৌম্য সরকারকে নামিয়েও ওপেনিং সমস্যার সমাধান নেই। সৌম্য (৫) ফিরলেন সবার আগে। খুব দেরি করলেন না অন্য ওপেনার লিটন কুমার দাসও (৫)। এমন অবশ্য নিয়মিতই হয়ে আসছে। কিন্তু সমস্যা বাধল তখন, যখন দেখা গেল ১৮ রানে ২ উইকেট হারানো দলকে ঠিক স্বস্তি দিতে পারছেন না সাকিব-মুশফিকও।
সাকিব ধুঁকলেন, মুশফিকও ভুগলেন। ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক হচ্ছিল না দুজনের কারোরই। রান করার সংগ্রামে তাঁদের ৪৭ রানের পার্টনারশিপে তবু আশার ঝিলিক ছিল। কিন্তু ১২ বলের মধ্যে মিলিয়ে গেল সেটিও। যেদিন কিছুই ঠিকঠাক হয় না, সেদিন বোধহয় এ রকমই হয়। আল আমরাত স্টেডিয়ামের উইকেটের দুই পাশের বিশাল সীমানায় ক্যাচ হয়েছেন স্কটিশ ব্যাটসম্যানরাও। সাকিব (২৮ বলে ২০) হলেন লেগস্পিনার ক্রিস গ্রিভসের এমন এক লোপ্পা বলে, যেটি অবলীলায় সীমানা পার করার মতো।
এর আগে পাপুয়া নিউ গিনির বিপক্ষে একটিই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলা গ্রিভস বড় মঞ্চে আরেকটি বড় শিকারও ধরেন। সেটি তাঁর গুগলি বুঝেও স্কুপ করে বের করতে না পারা মুশফিকুর রহিমের (৩৬ বলে ৩৮)। রান করার সংগ্রামের মধ্যেও অফস্পিনার মাইকেল লিস্ককে দুটো ছক্কা হাঁকানো মুশফিকের বিদায়ের পর সহায় হতে পারেননি মাহমুদ (২২ বলে ২৩) কিংবা আফিফ হোসেনরাও (১২ বলে ১৮)।
সমীকরণ কঠিন হতে হতে ১৮ ওভার শেষেই ম্যাচ থেকে একরকম ছিটকে পড়ে বাংলাদেশ। ১২ বলে ৩২ লাগত ৩২ রান, ৬ বলে ২৪! ওই মুহূর্তে বল হাতে এক আঙুলের টোকায় প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলা মেহেদী হাসানের দুই হাতের জোরও খুব দরকারি হয়ে পড়ে তখন। ততক্ষণে অবশ্য বড্ড দেরি হয়ে গেছে। শেষ ওভারে সাইফ উদ্দিন মারলেন একটি চার, মেহেদী একটি করে চার আর ছক্কা। তাতে ব্যবধান কমলেও এড়ানো গেল না হার।
অথচ বল হাতে এক আঙুলের জাদুই দেখিয়েছিলেন মেহেদী হাসান। এই অফস্পিনার বল ছাড়লেন এক আঙুলের টোকায়। টার্ন করবে ভেবে দুই ব্যাটসম্যানই সুইপ করতে গেলেন কিন্তু বল গেল সোজা। তাতে একই ওভারে ফিরলেন দুজনই। এঁদের একজন আবার কেবলই মারদাঙ্গা ব্যাটিং শুরু করা জর্জ মানসি। গত কিছুদিন ধরেই প্রথম ওভার করে অভ্যস্ত মেহেদীকে এবার মাহমুদ উল্লাহ বোলিংয়ে আনলেন পাওয়ার প্লের পর। অষ্টম ওভারে বোলিংয়ে এসেই জোড়া আঘাত মেহেদীর।
আরেকটি জোড়া আঘাতও অপেক্ষায় ছিল স্কটল্যান্ডের জন্য। দুই ওভার পর সেটিই হানেন সাকিব। সেই সূত্রে উঠে যান অনন্য আরেক উচ্চতায়ও। এই ম্যাচ শুরুর আগে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হিসেবে লাসিথ মালিঙ্গাকে (১০৭) ছাড়িয়ে যেতে তাঁর দরকার ছিল ওই দুটো উইকেটই। একই ওভারে সেই প্রয়োজন মিটিয়ে সাকিব নতুন ইতিহাসে নাম লেখালেন যেমন, তেমনি চার ওভারের মধ্যে ‘ডাবল’ জোড়া আঘাতে স্কটল্যান্ডও হলো লণ্ডভণ্ড। তখন মনে হচ্ছিল ওই দুই ওভারের গল্পেই বোধহয় ছড়াতে চলেছে বাংলাদেশের জয়ের সৌরভ।
কিন্তু অনিশ্চয়তার ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টি বেশি অনিশ্চিত চরিত্রের বলেই উত্থান-পতনের আরো কিছু গল্প পর পর সাজল। পতনের পর স্কটিশদের সেই উত্থানের নায়ক গ্রিভসই। ২৮ বলে চারটি চার আর দুই ছক্কায় তাঁর ৪৫ রানের ইনিংসের পর বল হাতে সাকিব-মুশফিককে ফেরানো পারফরম্যান্সে দিনটি শুধু নিজের করে নেন এই লেগস্পিনার। সেখানে ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ের দিনও তরুণ মেহেদীর (৩/১৯) মুখ অন্ধকার, অনন্য কীর্তির দিনেও মলিন সাকিব।