বর্তমানে সারাবিশ্বে সবচাইতে যে শব্দটি বেশী উচ্চারিত হচ্ছে তার নাম “করোনা ভাইরাস”। মিডিয়া বা সংবাদ মাধ্যমের যতদিক রয়েছে সর্বত্রই চলছে এই করোনার ছড়াছড়ি। বিশে^র সকল মানুষের এক মুর্তিমান আতংক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ভাইরাস।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) পর পৃথিবীতে এত বড় বিপর্যয় আর হাহাকার-অশান্তি দ্বিতীয়টি আর আসেনি। ঘরবন্দি মানুষ।যানবাহন নেই রাস্তায়, দোকান-পাট শপিং মল, বিয়ে-সাদি, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান সবই বন্ধ। নামাজ আদায় করার জন্য মুসল্লীগণকে মসজিদে যেতেও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অনেক দেশে মসজিদে জামাত নিষিদ্ধ। স্বাভাবিক চলমান চিকিৎসাসেবা নিতেও মানুষ ভয় পাচ্ছে। সকলের অন্তরেই উৎকণ্ঠা, না জানি কী হয়!
এই লেখা তৈরীর সময় ভয়ানক করোনা ব্যধি দুই’শ দেশের বেশী অঞ্চলে তার ভয়াল থাবা বিস্তার করেছে। ইতিমধ্যে মারা গেছেন ২ লক্ষ ষাট হাজারের বেশী মানুষ। আক্রান্ত রয়েছেন প্রায় চল্লিশ লক্ষ। কিন্তু কেন এই দূরারোগ্য ব্যধির আবির্ভাব? সঠিক উত্তর দিতে পারছে না কেউ।
বস্তুবাদে বিশ্বাসী লোকেরা মনে করেন ছোঁয়াচে এই ব্যধি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমিত হয়ে বিশে^র এই বর্তমান অবস্থা দাঁড়িয়েছে। চীনের “উহান” শহরে এর উৎপত্তি। সেখান থেকেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় সারাবিশ্বে। মারাত্মক “ছোঁয়াচে” রোগের প্রতিফলন এটি। কিন্তু বস্তুবাদী মানুষের যুক্তি যদি ধরা হয় রোগটি “ছোঁয়াচে” এবং এর কারণেই বর্তমানের এই মহা বিপর্যয়, তাহলে প্রশ্ন উঠে চীনের উহান শহরে যেখানে এর উৎপত্তি সেখানে এই রোগের ছোঁয়া লেগেছে কোথথেকে? এর কোন সদুওর কেউ দিতে পারবে না। কাজেই ধর্ম-বিশ্বাসী, আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাসী মানুষের বিশ্বাস এবং ইসলামী শরীয়ত এ ব্যাপারে কী বলে আমাদের কে এ বিষয়ে সম্যক ধারনা নিতে হবে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক এ সকল মহামারী বা মহাদুর্যোগ কে মানুষের কৃতকর্মের অর্জন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি ইরাশাদ করেন “জলে ও স্থলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদের কে তাদের কর্মের শস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা (সঠিক পথে) ফিরে আসে। সূরা রূম-৪১। আল্লাহ তায়ালা সকল গোনাহের কারণেই মানুষদেরকে বিপদ, বালা মসিবত দান করেন না। বরং অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন। দুনিয়াতে প্রত্যেক গোনাহের কারণে বিপদ আসলে একটি মানুষও পৃথিবীতে বেঁচে থাকতো না। বরং যে গোনাহ গুলো মাফ করেন না, সে গুলোরও পুরোপুরি শাস্তি দুনিয়াতে দেন না। বরং সামান্য শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করানো হয় মাত্র। পার্থিব বিপদের উদ্দেশ্য হচ্ছে গাফেল-উদাসীন মানুষদের কে সাবধান করা, যাতে সে গোনাহ থেকে বিরত থাকে। পরিণামে এটা তার জন্য একটি বড় নেয়ামত নিসেবে পরিগণিত হয়। -তাফসীরে মা‘রেফুল কুরআন।
নবী করীম (সা.) বলেছেন পৃথিবীতে যখন আল্লাহর নাফরমানী, যিনা-ব্যভিচার, উলঙ্গপনা-বেহায়াপনা, জুলুম-অত্যাচার, সুদ-ঘুষ ইত্যাদী অপকর্মের মাত্রা বেড়ে যায় তখন মানুষের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, দূরারোগ্য ব্যধি ইত্যাদি নেমে আসে। আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাই বর্তমানে বিশে^ কী পরিমাণ উলঙ্গপনা আর অশ্লীলতার সয়লাব চলছে। পশ্চিমা বিশে^ ফ্রি-মাইন্ডের নামে, আধুনিকতার নামে যে যৌন বিকৃতি চলছে তা মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়। ক্লাব-সংঘের সদস্যরা দিন-রাত নারী আর মদ নিয়ে পড়ে থাকে। ক্লাবের ভেতর প্রবেশ করতে হয় যুবক-যুবতীদেরকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে। এরপর সেখানে যা হয় তা ভাষায় প্রকাশের যোগ্য নয়।
শুধু এখানেই সীমিত নয়, এ সকল অশ্লীলতার দৃশ্য ধারণ করে ছড়িয়ে দেয়া হয় সামাজিক মাধ্যম তথা মিডিয়ায়। ফেসবুক, ইন্টারনেট, ইউটিউব, গুগল ইত্যাদি সার্চ করা মাত্রই সবার চোখের সামনে ভেসে উঠে এ সকল অশ্লীল দৃশ্য। ফলে, উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা এ সকল মিডিয়াতে আসক্ত হয়ে তারাও এ জঘন্য পথে পা বাড়ায়। যে কারণে এদের লেখাপড়া মন-মগজ, স্বাস্থ্য, সব কিছু আজ মারাত্মক হুমকীর সম্মুখীন। একজন সমাজবীদের ভাষায় “বর্তমান নতুন প্রজন্ম যে হারে অশ্লীলতা আর বেলেল্লাপনার নীল ছোবলে দংশিত হয়ে তার স্বাস্থ্য, মেধা, মনন ও লেখাপড়ায় ভংকর সর্বনাশ ঘটাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে সারাবিশে^ আমরা একটি অকর্মন্য, অথর্ব, অসহায় পঙ্গু জাতী পেতে যাচ্ছি”।
বিনোদন, পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, নাটক-সিনেমা, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, সাহিত্য- সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে যৌন আবেদনে ভরপুর, কামোদ্দীপনার যে অশুভ প্রতিযোগীতা চলছে, তাতে একজন সুস্থ মস্তিষ্ক বিবেকবান মানুষ চরমভাবে আতংকিত না হয়ে পারেন না। সারা বিশে^র সাথে তাল মিলাতে গিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত, ওলী-আওলিয়াগণের পূণ্যস্মৃতি বিজড়িত আমাদের এই সুজলা-সুফলা সোনার বাংলাদেশের সোনার মানুষেরাও অনেক ক্ষেত্রে বেহায়াপনা আর অশ্লীলতার কদর্য পথে হাঁটছে সমান তালে।
হাদীস শরীফে রাসূলে পাক (সা.) যে জুলুম আর অত্যাচারের কথা বলেছেন তা পৃথিবীর সকল দেশেই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা যদি একটু চোখ মেলে বিশে^র দিকে তাকাই তাহলে জুলুম আর অত্যাচারের যে ভীষণ ষ্টীমরোলার দেখতে পাই তা যে কোন মানবতা সম্পন্ন মানুষকেই ব্যথিত করে তোলে।
সারা দুনিয়ায় আজ মানুষ মানুষের উপর যে অত্যাচার আর অবিচার চালাচ্ছে তাতে আল্লাহর গজব নেমে আসাই স্বাভাবিক। দু:খজনক হলেও সত্য, এ সকল অত্যাচার আর নিপীড়নের ক্রীড়নক হচ্ছে শুধু মাত্র মুসলিম জাতী। ইহুদী-খৃষ্টান, বৌদ্ধ, পৌওলিকরা সম্মিলিতভাবে সারা দুনিয়ায় মুসলমানদের ওপরেই কেবল মাত্র অবর্ণনীয় জুলুম-অত্যাচার করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। চীনের উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীনা কর্তৃপক্ষ কয়েক বছর যাবৎ কী লোমহর্ষক নির্যাতন চালাচ্ছে তা সকলেরই জানা। ফিলিস্তিনে ইহুদী এবং তাদের সহযোগীরা বিগত ৭০ বছর ধরে কী যন্ত্রণাদায়ক নির্যাতন মুসলমানদের কে করছে তাও আমরা জানি।
বার্মা বা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বর্বর-অসভ্য মগদের নিদারুণ নির্যাতন চলছে। ওদের ভয়ে প্রাণ রক্ষার্থে নিজ দেশ থেকে নিজের শত বছরের ভিটে-মাটি ছেড়ে দশ লক্ষাধিক মজলুম মুসলমান বাংলাদেশে এসে শরণার্থী হিসেবে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ওদের কান্না আর হাহাকার এদেশের আকাশ-বাতাশকে বেদনাবিধুর করে তুলেছে। সিরিয়ায় গত দশ বছরে নির্যাতন করে ৫ লক্ষ নিরপরাধ মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। আফগানিস্তানে ১০ লক্ষাধিক মুসলমানকে শহীদ করা হয়েছে। ইরাকে সম্মিলিত সামরিক জান্তাদের হাতে মারা গেছেন অগণিত-অসংখ্য মানুষ। কাশ্মীর ও দিল্লীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কসাই মোদী সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে দু’লাখের বেশী মুসলমান প্রাণ হারিয়েছেন। এ হলো বর্তমান বিশ্বের তথাকথিত সভ্য দেশের কর্ণধারদের অহিংস কর্মকান্ডের সংক্ষিপ্ত চিত্র।
এই সকল জুলুম-অত্যাচারে খোদার আরশ কি কেঁপে উঠবেনা? আল্লাহ কী তার অসহায় নিরপরাধ বান্দাদের ওপর চালানো এ সকল অন্যায়-অবিচার শুধু সহ্য-ই করে যাবেন? হাদিসের ভাষা থেকে আমরা বুঝতে পারি বর্তমান বিশে^র করোনা ভাইরাস সহ যাবতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো নীরব প্রতিশোধ ছাড়া আর কিছু-ই নয়।
কাজেই, এই সর্বগ্রাসী মহামারী করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদেরকে মহান রবের আনুগত্যের দিকে ফিরে যেতে হবে। ইসলাম এ ক্ষেত্রে যে বিধি নিষেধ আরোপ করেছে তার যথাযথ অনুশীলন করতে হবে। আশা করা যায়, মহান দয়ার সাগর গাফুরুর রাহীম আল্লাহ আমাদেরকে এই মহা মুসিবত হতে পরিত্রাণ দান করবেন। ইসলাম আমাদেরকে আরো শিক্ষা দিয়েছে যে, যে সকল পাপের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে বালা-মুসিবত আবর্তিত হয়, সে ক্ষেত্রে প্রথমত: ঐ সকল কৃত পাপাচার ছেড়ে দিতে হবে। অতীতের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে বেশী বেশী তাওবা-ইস্তিগফার করতে হবে। বিপদের সম্মুখীন হলে আল্লাহর রহমত ও দয়া হতে নিরাশ হওয়া যাবে না। আল্লাহ পাক কালামে মাজীদে ইরশাদ করেন “লা-তাক্বনাতু মির রাহমাতিল্লাহ”। তোমরা আল্লাহর রহমত বা দয়া হতে নৈরাশ হইও না।
বিপদের সম্মুখীন হয়ে হযরত ইউনুস (আ:) আল্লাহর দরবারে যে দোয়া করেছিলেন আমাদেরকেও সেই দোয়া পাঠ করতে হবে “লা ইলাহা ইল্লা আনতা-সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ্জুয়ালিমীন” অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনাকে ছাড়া আর কোন মা‘বুদ বা ইলাহ নেই, আপনি সকল প্রকার আবিলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, আর আমি হচ্ছি সকল দোষে দোষী, সকল অপরাধে অপরাধী। বান্দা এখানে সর্ব প্রথম আল্লাহর তাওহীদ বা একাত্ববাদের স্বাক্ষী দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত: আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছে। তৃতীয়ত: নিজের কৃত ভুল-ত্রুটি, অন্যায়-অপরাধের কথা অকপটে আল্লাহর কাছে স্বীকার করে নিচ্ছে। আর এটাই হচ্ছে আল্লাহর অনুকম্পা লাভ করার উপায়। নিজের দোষ-ত্রুটি মেনে নিতে হবে। অনেক সময় মানুষ নিজের ত্রুটির কথা স্বীকার করতে চায়না। কোন বিপদে পড়লে অবলীলায় বলে ফেলে “আমি কী দোষ করলাম, আমি কী অন্যায় করলাম, আল্লাহ আমাকেই শুধু এই বিপদে ফেললেন।” এমন উক্তি করা কখনই শোভনীয় নয়। মনে করতে হবে আমার অন্যায়-অপরাধের জন্যই আল্লাহ এই বিপদ দান করেছেন।
একজন বড় মাপের আল্লাহর ওলী ছিলেন হযরত জুন্নুন মিশরী (রহ:)। একবারের ঘটনা, মিশরে একাধারে অনাবৃষ্টি চলছে। খাঁ-খাঁ করছে সারাদেশ। অনাবৃষ্টিতে দেশের ফল-ফসল সব পোড়ে ছাই হয়ে গেছে। লোকজন এসে আল্লাহর ওলী জুন্নুন মিশরীকে ধরলেন বৃষ্টির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করার জন্য। তিনি বললেন, আজ নয়, আগামীকাল দোয়া করবো। এই বলে লোকদেরকে বিদায় করে দিয়ে রাতের বেলায় তিনি মিশরের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাশর্^বর্তী দেশে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে আল্লাহর দরবারে হাত তুললেন। ওগো দয়াময় প্রভূ! আমি মিশরের সব চাইতে বড় গোনাহগার। আমার চাইতে বড় গোনাহগার মিশরের জমিনে আর একজনও নেই। আমার গোনাহের কারণে আপনি মিশরে বৃষ্টি বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই, আমি মিশর ছেড়ে চলে এসেছি। এখন আপনি মিশরে বৃষ্টি বর্ষণ করুন। মুনাজাত শেষ হতে না হতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।
কাজেই, নিজের গোনাহ-অপরাধ অন্যায় স্বীকার করে আল্লাহর দরবারে অনুতপ্ত হৃদয় নিয়ে কান্নাকাটি করতে হবে।
হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) কে মহামারী বা প্লেগ রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। মহানবী (সা:) জবাবে বললেন, এটা হচ্ছে আল্লাহর আযাব। আল্লাহ তা‘য়ালা যাকে ইচ্ছা তার ওপর প্রেরণ করেন। তিনি এটা তাঁর প্রতি বিশ^াসী মুসলমানের জন্য রহমতে পরিণত করে দেন। প্লেগাক্রান্ত শহরে কোন বান্দা যদি এ বিশ্বাস নিয়ে ধৈর্যধারন করে সেখানেই অবস্থান করে, সেখান থেকে বের না হয় যে, “আল্লাহ তার জন্য যা ভাগ্যে লিখেছেন, তা ব্যতিত কিছুই তাকে স্পর্শ করবে না,” তাহলে সে একজন শহীদের সাওয়াব লাভ করবে। সহীহ বোখারী।
উপরোক্ত হাদিসের আলোকে বর্তমানে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত এলাকা থেকে বের না হয়ে আমাদেরকে নিজ নিজ অবস্থানে থাকাই হবে বুদ্ধিমত্বার কাজ। আর সকল ক্ষেত্রে আমাদের কে পরিচ্ছন্ন-পবিত্র জীবন কাটাতে হবে।
তিরমীজী শরীফের এক হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন “নিশ্চই আল্লাহ পাক নিজে পবিত্র তিনি পবিত্রদের কে ভালোবাসেন, তিনি নিজে পরিচ্ছন্ন, পরিচ্ছন্নতাকে তিনি ভালোবাসেন। তিনি নিজে মেহেরবান, মেহেরবানী কে তিনি ভালোবাসেন। তিনি নিজে দানশীল দানশীলতাকে তিনি ভালোবাসেন। কাজেই, তোমরা নিজেদের বাড়ি-ঘরের আঙ্গীনাকে ভালোভাবে পরিচ্ছন্ন রাখো”। এ হাদীসে রাসূল (সা:) কয়েকটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করেছেন। বিশেষভাবে আমাদেরকে দানের কথা বলেছেন। বাড়ির আঙ্গীনা বা উঠান পরিচ্ছন্ন রাখার কথা বলেছেন।
হাদীসের তাফসীর কারকগণ বলেছেন, যার বাড়ির উঠান পরিচ্ছন্ন থাকবে তার বাড়ির ভেতরটা তো আরও পরিচ্ছন্ন থাকার কথা। যার বাড়ির ভেতর পরিচ্ছন্ন থাকবে তার ঘরটা তো আরও পরিচ্ছন্ন থাকবে। যার ঘর পরিচ্ছন্ন তার শরীর হাত-পা ইত্যাদি তো আরও পরিস্কার থাকবে। যার শরীর পরিচ্ছন্ন থাকবে তার মুখের দাঁত তো আরও বেশী পরিচ্ছন্ন থাকার কথা। এক কথায় নবীজী আমাদের এই হাদীসে জীবনের সকল স্তরে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার কথা বলেছেন।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে আরেক খানা হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন “পরিচ্ছন্নতাই হচ্ছে ইসলাম। কাজেই তোমরা পরিচ্ছন্নতা অর্জন কর। কেননা, পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি-ই জান্নাতে প্রবেশ করবে”। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজী বলেন “আল্লাহর কাছে মুমিনের সৌন্দর্য্য হচ্ছে তার পরিচ্চন্ন পরিচ্ছদ এবং স্বল্পে-তুষ্টি”। মাজমাউল জাওয়াইদ, ৫ম খন্ড।
বর্তমানে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ মহামারী করোনার ছোবল থেকে বেঁচে থাকতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব রোপ করেছেন। বিশেষ করে বার বার হাত ধোয়ার কথা বলেছেন। অথচ; পবিত্র কুরআন ও হাদীসের নববীতে সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বেই এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মুসলমানগণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ওজুতে পাঁচবার হাত-মুখ, পা ইত্যাদি ধৌত করে থাকেন। প্রত্যেক ওজুতে প্রতিটি অঙ্গ তিনবার করে ধৌত করতে হয়। সে হিসেবে পনেরোবার হাত-পা ধোয়া হয়। তা ছাড়া তাহাজ্জুদ, এরশাক, আওয়্যাবীন, চাশ্ত ইত্যাদী নামাজে অভ্যস্থ ব্যক্তিগণ দৈনিক আরও বহুবার ওজুতে হাত-মুখ ধৌত করে থাকেন। তাই পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে মহামারী হয়ে থাকলে মুসলমানগণ এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। তা ছাড়াও মুসলমান সমাজ হালাল খাদ্য নীতিতে অভ্যস্থ। এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) উম্মতগণকে লক্ষ্য করে বলেছেন “তোমরা ঘুমানোর পূর্বে এবং ঘুম থেকে উঠে ভালভাবে নিজের হাত ধৌত করে নিবে। কারণ, রাতের বেলায় হাত কী অবস্থায় ছিল, তা তোমার জানা নেই”। ইসলাম মানুষকে পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতার যে জোর তাকিদ প্রদান করেছে এবং ইসলাম অনুসারীগণ যেভাবে তা পালন করেন তা অন্য কোন ধর্ম-গোষ্ঠীর মধ্যে পালন করা হয় না।
সারকথা হচ্ছে, আল্লাহর পক্ষ হতে বিশ^ব্যাপী যে মরণঘাতি করোনা ভাইরাসের আবির্ভাব হয়েছে তা থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই আল্লাহর নাফরমানী তথা, যিনা-ব্যভিচার, অশ্লীলতা, জুলুম-অন্যায়, সুদ-ঘুষ সহ যাবতীয় পাপচার-অনাচার হতে মুক্ত হয়ে পুত:পবিত্র জীবনাচারে অভ্যস্থ হয়ে উঠতে হবে। সাথে সাথে নিজের ইমান-আমলকে সংশোধন করতে হবে। বেশী বেশী তাওবা-ইস্তিগফার করতে হবে। নিজের বিগত জীবনের কৃত গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। রীতিমত কোরআনে পাক তিলাওয়াত ও দান সদকা করতে হবে। কারণ, দান সকল বালা-মুসিবত দূর করে থাকে। বিশেষ করে চলমান সংকটে খেটে খাওয়া মানুষজন মানবেতর জীবন অতিবাহিত করছে।, তাদের প্রতি সহানুভুতির হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। একান্তই বের হতে হলে মুখে মাস্ক এবং হাতে “হ্যান্ড গ্লাভ্স” ব্যবহার করতে হবে। হাঁচি-কাশি, হাই তোলার ক্ষেত্রে টিস্যু বা রুমাল দ্বারা মুখ ঢেকে রাখতে হবে। মুখের লালা দিয়ে টাকা গোনা বা বইয়ের পাতা উল্টানো যাবে না। সকল ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বা কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে হাট-বাজার বা জনসমাগম হতে দূরে থাকতে হবে। আতংকিত না হয়ে মানসিকভাবে দৃঢ়-মনোবল সম্পন্ন হতে হবে।
করোনা ভাইরাসসহ সকল বিপদ-আপদ মহামারী হতে রক্ষা পেতে সকাল-সন্ধ্যা নিম্ন বর্ণিত দোয়াটি তিনবার পাঠ করুন “বিস্মিল্লাহিল্লাজী লা-ইয়ার্দুরু মা‘সমিহী শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস্ সামায়ী ওয়াহুয়াস্ সামিউল আলীম”। নি¤েœাক্ত দোয়া বেশী বেশী পড়–ন, “আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিনাল বারাছি, ওয়াল জুনুনী, ওয়াল জুজামী, ওয়ামিন সায়্যিয়িল আসক্বাম”। দিনে-রাতে কমপক্ষে ৫০০ বার পড়ুন, “ইয়া-হাইয়্যু, ইয়া ক্বাইয়্যুম”। দিনে-রাতে যে কোন সময় সূরা ফাতিহা তিনবার, সূরা ইখলাস তিনবার এবং হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি‘মাল ওয়াকিল ৩১৩ বার পড়ুন। “লা-ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুন্তু মিনাজ্ জোয়ালিমীন” এই দোয়াটি বেশী বেশী পাঠ করুন। সকল কাজে, সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। এটাই মুমিনের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য।
আসুন, আমরা সকলে মহান মালিক, মহান মনিবের কাছে সর্বান্ত:করণে নিজেকে সমর্পণ করি। তাঁর অফুরন্ত-অসীম রহমত বারিধারার অঝর বর্ষণ আর আমাদের অনুতপ্ত হৃদয়ের আবেগ মথিত তপ্তাশ্রু বিসর্জন-ই আমাদের কে করোনা ভাইরাস সহ সকল বিপর্যয় থেকে মুক্তি দিতে পারে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।।
: লেখক পরিচিতি :
মুফতি শেখ মো. এনামুল হক
পরিচালক
আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রাহ:) ফাউন্ডেশন
হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ কমপ্লেক্স
হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।
০১৭১২-৬৫১০৮২