পৃথিবীর এখন ভয়ানক দুঃসময়, দুঃসময় এখন দেশেরও। জীবাণুর বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে, তখন আমাদের দেশ নিয়ে শঙ্কা স্বাভাবিকভাবেই পর্বতসম। একদিকে যেমন ব্যাপক ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র, তেমনি তার স্বাস্থ্য সুবিধা ও স্বাস্থ্য সচেতনা দুই-ই নাজুক। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অদক্ষতাও সুবিদিত। আর প্রশাসন নিয়ে নাগরিক অসন্তোষের একটি বড় উপলক্ষ পুলিশ বাহিনী। প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে পুলিশই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সমালোচিত। সেসব সমালোচনা বহুলাংশে সঙ্গতও। কিন্তু করোনাকালে আমরা দেখতে পেলাম এক মানবিক পুলিশ বাহিনী।
স্বীকার করতে হবে, চিকিৎসক, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, গণমাধ্যমকর্মী, স্বেচ্ছসেবী যে যার মতো করেই জীবন বাজি রেখে জীবাণুর বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে আছেন। সবার অবদানই শ্রদ্ধার দাবি রাখে। তবে পুলিশ বাহিনী নজর কেড়েছে ভিন্নভাবে। সবাই একসময় গৃহমুখী হয় বা হতে হয়, কিন্তু পুলিশ থাকে রাস্তায়। কোনো আশ্রয় থাকুক বা না থাকুক, যত দুর্যোগই হোক বা সংকট আসুক- পুলিশ থাকে রাস্তায়। আমরা ঘুমাই, তারা পাহারায় থাকে বলেই।
রাস্তায় মৃত্যুর সঙ্গে অনবরত দ্বৈরথ সহজ নয়। কিন্তু পুলিশ রাস্তায় থেকেছে বা থাকছে তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা অগ্রগণ্য না করেই। পুলিশ রাস্তায় থাকছে প্রিয়জনের ছলছল চোখের অপেক্ষা উপেক্ষা করেই। পুলিশ রাস্তায় থাকছে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ভাবনা উপেক্ষা করেই। রাস্তায় হাজার হাজার, লাখ কিংবা কোটি মানুষের স্রোত- যার মধ্যে যে কেউ বইতে পারে এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিত্যকায় সম্মুখে থাকা সাধারণ কথা নয়। এত সীমাবদ্ধতা তারপরও পুলিশ যেভাবে অবিচল থাকছে, তাতে আমরা এই অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে ভরসা পাচ্ছি।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন, হুজুগে ও গুজবপ্রিয় জনগণকে সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি শুধু বিজ্ঞাপন ও বার্তার মাধ্যমে বোঝানো সম্ভবপর নয় এবং এটি সম্ভবও হয়নি। যতটুকু সাফল্য এসেছে তাতে পুলিশ বাহিনীর উদাহরণ সৃষ্টির মতো ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। শুরুতেই সরকারের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সঙ্গে সচেতনতা সৃষ্টি, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণের মতো কার্যক্রমে যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকায় দেখেছি। পরবর্তী সময়ে পুলিশ ছিল অগ্রণী ভূমিকায়। কারণ, অতি প্রয়োজনীয় সামাজিক যোগাযোগ রক্ষায় স্বাস্থ্যবিধি মানানোর এবং অযথা জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের মূল ভার নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে পুলিশকেই। ততক্ষণে গণসংক্রমণ শুরু হয়েছে। গ্রামে বা শহরে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশের যে তৎপরতা সেটি জনগণ স্মরণ রাখবে।
পুলিশ কী না করেছে? মানবিক বিপর্যয় যখন তুঙ্গে তখন লাশ কাঁধে নিয়েছে। দাফন করেছে, রোগী হাসপাতালে নিয়েছে, অসহায় মানুষকে গৃহে পৌঁছে দিয়েছে। ক্ষুধার্তকে রাতের আঁধারে খাবার পৌঁছে দিয়েছে। এত সব কাজের মাঝে তাদের নিত্যকার রুটিন দায়িত্ব তো আছেই।
এমনিতেই পুলিশকে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ সবই করতে হয়। এই মহাদুর্যোগে মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগ বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। তাও সামলাতে হচ্ছে পুলিশকে। সরকারের ত্রাণসামগ্রী কিছু দুর্বৃত্ত লুটছে, স্বাভাবিকভাবেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশকে নিতে হয়েছে গুরুদায়িত্ব। রমজানে এমনিতেই অসাধু ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো থাকে। তার ওপরে করোনা যোগ করেছে নতুনমাত্রা। প্রশাসনের সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
বরগুনার এক পুলিশ কর্মকর্তা দেখলাম ছুটে গেছেন তরমুজ চাষিদের অবৈধ সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা করতে। সাতক্ষীরার পুলিশ সুপারকে দেখেছি প্রান্তিক কৃষকের কাছে ছুটে যেতে। এ রকম বহু চিত্রের সাক্ষী হয়েছি আমরা। বেশিরভাগই চোখের সামনে আসেনি। এ রকম নিরলস ও আন্তরিকতার বহু উদাহরণ ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমরা সবাই সচেতন আর সৎ হলে হয়তো পুলিশ বা প্রশাসনের ঘাড়ে এসব বাড়তি দায়িত্ব কম আসত। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। আমাদের নির্বুদ্ধিতা, নির্লিপ্ততা এবং বহুক্ষেত্রে হঠকারিতা আমাদের সম্মুখযোদ্ধাদের কাজের পাশাপাশি ঝুঁকি ও বিপদ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
পুলিশ বাহিনীর সীমাবদ্ধতা, অপ্রতুলতা ও সুযোগ-সুবিধার অভাব তো আছেই। তাদের সবাই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, কিন্তু জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে পুলিশ যেভাবে জীবনের পরোয়া না করে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, পেশাদারিত্বের ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে। এই পুলিশ বাহিনী নতুন করে আশা জুগিয়েছে। এই সম্মুখযোদ্ধাদের জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজনে আরও বলিষ্ঠ ও ইতিবাচক ভূমিকায় দেখতে চাই।
যখন লিখছি ততক্ষণে ছয় পুলিশ সদস্য এই করোনা যুদ্ধে দেশের সেবায় আত্মোৎসর্গ করেছে, আর সংক্রমিত কয়েকশ’। তাদের পরিবারও বিসর্জন দিচ্ছে অনেক কিছু। তবু অবিচল এই সম্মুখযোদ্ধারা লড়াইয়ে বিন্দু মাত্র ক্ষান্ত হয়নি। তাই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি আমাদেরও আছে দায়িত্ব। আমাদের অসচেতনতা ও হঠকারিতার বলি যেন না হয় দিনরাত লড়তে থাকা এই সেনানীরা। স্যালুট আপনাদের।
এই ক্রান্তিকাল হয়তো শেষ হবে কোনো একদিন। সবাই ফিরে যাবে চেনা জীবনে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, আতঙ্ক আর বিয়োগের এই করোনাকাল দুঃসহ সব স্মৃতির সাক্ষী হয়ে থাকবে। তার মধ্যেও গর্ব করার মতো স্মৃতি হয়ে থাকবে আমাদের সম্মুখ যোদ্ধাদের ত্যাগ, শ্রম ও দেশশ্রেম। আরও অনেকের ত্যাগ পরিশ্রম নিয়ে সুযোগ হলে লিখব অন্য কোনো সময়।
শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়