সময়টা কারো জন্যই ভালো যাচ্ছে না! সমগ্র বিশ^ই এখন এক সংকটময় মুহুর্ত অতিক্রম করছে। করোনা নামক মহামারীতে বিশে^র প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের ন্যায় বাংলাদেশও আজ স্তম্ভিত। প্রতিদিনের মৃত্যুর পরিসংখ্যান আমাদের প্রত্যেককে এক অজানা শঙ্কায় ফেলে দিচ্ছে। মৃত্যুর কাছে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রসমূহ এবং তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার অসহায় আত্মসমর্পণ আমাদের মাঝে এই শঙ্কাকে প্রতিনিয়তই বাড়িয়ে দেয়। কে ধনী, কে গরীব এ প্রশ্ন যেন এখন গৌণ। করোনা মোকাবেলায় সবাই যেন আজ একই কাতারে। করোনা পরিস্থিতি বিশে^র প্রত্যেকটি রাষ্ট্র তাদের নিজ নিজ আঙ্গিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়। বাংলাদেশও এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথাসাধ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ মুহুর্তে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় করোনা নামক ভাইরাসের অস্তিত্ব বিরাজমান। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা, গণপরিবহন বন্ধ করা, লকডাউন ঘোষণার মত পথ বেচে নিতে হয়েছে। লোক সমাগম ঠেকাতে সারা দেশে সিভিল প্রশাসনের সাথে সেনাবাহিনীকেও মাঠে নামানো হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে সরকারকে এ মুহুর্তে দুটি আঙ্গিকে কাজ করে যেতে হচ্ছে। প্রথমত, করোনা থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে মানুষকে ব্যাপক হারে সচেতন করানো, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণের যোগান নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, দুর্যোগকালীন এ সময়ে অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে খাদ্য সমাগ্রী পৌছে দেয়া। ফলে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের জন্য পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখা কিংবা এ অবস্থা থেকে উত্তোরণ অনেকটাই কষ্টসাধ্য।
বর্তমানে বাংলাদেশ করোনা ভাইরাস সংক্রমনের মধ্যম সময়টিতে অবস্থান করছে। এই সময়টিতে সংক্রমনের পরিমান জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকায়, পরিস্থিতি অনুকূলে রাখার জন্য আগামী দিনগুলো দেশের প্রত্যেকটি মানুষের সচেতন ভুমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনা শুধু মৃত্যুই ঘটিয়ে যাচ্ছে এমনটা নয়। করোনার কারণে সারা দেশে যে অচলাবস্থা বিরাজ করছে, তাতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়েছে বিরূপ প্রভাব। খেটে খাওয়া মানুষের কাজ না থাকায় আয় রোজকারের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। লম্বা ছুটির কারণে এ দলে যুক্ত হয়েছে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও। ফলে একদিকে মৃত্যুর ভয়, অন্যদিকে খাদ্যের অভাব, সাধারণ মানুষের জন্য এ যেন উভয় সংকট। দেশের এই সংকটময় সময়ে মানুষকে সহায়তার জন্য বিশেষ করে এ ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্যাপক হারে সচেতনতা সৃষ্টির কাজে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ লক্ষ করা গেছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীই একমাত্র সংগঠন যারা সারা দেশে একযোগে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি ও ত্রান কার্যক্রম নিয়ে অভুক্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সারাদেশে ছাত্রলীগকে একটি মানবিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত করতে সক্ষম হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের এই মহামারী পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের ইতিবাচক কর্মকাণ্ড নিয়ে লেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছিলাম। কিন্তু লেখার শিরোনামটি কি হবে তা নিয়ে কিছুটা চিন্তিতও ছিলাম বটে। অবশেষে তা ও নির্ধারণ করতে পারলাম, চাঁদপুরের একজন সজ্জন মানুষ হিসেবে সকলের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ চাঁদপুর জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ও আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান চাঁদপুর জেলা শাখার দু’বারের সভাপতি জাফর ইকবাল মুন্না ভাইয়ের ফেইসবুক পোস্টের সহায়তায়। উনার একটি লেখা থেকে এই লেখার শিরোনাম নির্ধারণ করলাম ‘চাঁদপুরে গরীবের বন্ধু ছাত্রলীগ’। করোনার এ মহামারীতে, তার স্বল্প কথার এ পোস্টটি জেলা ছাত্রলীগের সবকটি ইউনিটের সামগ্রিক কার্যক্রমের প্রতিচ্ছিবি। যেখানে চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক দায়িত্বশীলদের এবং বর্তমান দায়িত্বরত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সমন্বিত নির্দেশনার কথাকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। যার ফলে জেলা ছাত্রলীগসহ চাঁদপুর সদর, কচুয়া, হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ, ফরিদগঞ্জ এবং হাইমচর উপজেলা ও অন্য সবগুলো ইউনিট এই মহামারী পরিস্থিতিতে ওয়ার্ড পর্যন্ত সচেতনা সৃষ্টির লক্ষে মাইকিং, লিফলেট/প্রচারপত্র বিতরণ করে আসছে। পাড়া মহল্লাগুলোতে মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে বাজারের দোকানগুলোর সামনে নির্দিষ্ট দূরত্বে রং দিয়ে জায়গা চিহ্নিত করে দিচ্ছে। মানুষকে সুস্থ রাখতে নিজেদের উদ্যোগে সর্বত্র জীবানুনাশক স্প্রে করছে, বিনামূল্যে মানুষের মাঝে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করছে। আবার এই ছাত্রলীগই গ্রামের কোন বাড়িতে কার ঘরে খাবার নেই তা সন্ধান করে প্রাকাশ্যে/গোপনে, এমন কি রাতের আধারে খাদ্য সামগ্রী পৌছে দিচ্ছে। অবশ্য দেশের এমন পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী ছাত্রলীগের নানান প্রশংসনীয় ভূমিকার কারণে এটা বললে বেশি হবে না যে, এই মুহুর্তে ‘বাংলাদেশে গরীবের বন্ধু ছাত্রলীগ’। দেশের প্রথম সারির প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ঘরে বসে ছাত্রলীগের মানবিক কার্যক্রমের খবর সামনে আসে তখন তখন সংগঠন নিয়ে অনেকেরই গর্ব করতে ইচ্ছে করে। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় দেখলাম, ‘করোনায় মানবতার পাশে ছাত্রলীগ,’ বেসরকারি টিভি চ্যানেল চট্রগ্রাম ছাত্রলীগের বিনামূল্যে সবজি বিতরণের কার্যক্রম তুলে ধরে শিরোনম করেছে, ‘এরাই ছাত্রলীগ’, কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে দেখলাম, ছাত্রলীগ কর্মী মায়ের গহনা বিক্রি করে গরীবদের ত্রান সহায়তা করছে, ত্রান পৌছাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পা হারালেন ছাত্রলীগ নেতা, নিজের মোটর সাইকেল বিক্রি করে গরীবদের সাহায্য করছে ছাত্রলীগ নেতা। কোথাও কোথাও এ ছাত্রলীগই করোনায় মৃত্যুবরণকারী মানুষের দাফন-কাপনের দায়িত্বও পালন করছে। এতোসব কল্যাণকর কাজের মাধ্যমে ছাত্রলীগ আজ এমন হাজারো শিরোনামে নিউজ মাধ্যম গুলোকে ভরিয়ে তুলছে। যা আম-জনতা কোয়ারেন্টিনে বসে ফেসবুকের নিউজফিডে অবলোকন করছে।
আমি আসলে সেই ছাত্রলীগের কথাই বলছিলাম যে ছাত্রলীগ, দীর্ঘ বয়সের, সুদীর্ঘ পথ চলায় একটি উত্তম সাংগঠনিক কাঠামোতে, বলিষ্ঠ নেতৃত্বে রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর কাজের মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষের মনে অনেক আগেই স্থান করে নিতে পেরেছে। এরা আসলে সেই ছাত্রলীগ কর্মী যারা প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে ঐক্যবদ্ধ ছাত্রলীগ হিসেবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে এবং পরে সকল প্রকার অন্যায়, নির্যাতন আর অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল বলিষ্ঠ কণ্ঠে। একটি বৈষম্যমূলক শাসন ব্যবস্থা হতে দেশের স্বাধীনতা আনয়নে এই ছাত্রলীগ ছিল বদ্ধপরিকর। তাইতো তারা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের আয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা বাস্তবায়ন ও ১১ দফা প্রণয়ন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অগ্রবর্তী সৈনিক হিসেবে কাজ করেছে। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এই ছাত্রলীগের মুক্তিকামী প্রায় ১৭ হাজার নেতাকর্মী নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তীতে দেশে বিভিন্ন সময় গণতন্ত্রের ক্রান্তিলগ্নে, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে ছাত্রলীগকে রক্ত ঝড়াতে হয়েছে, আজকের ছাত্রলীগ তাদেরই উত্তরসূরী। যারা দেশে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন পক্ষের নানা অপতৎপরতা রুখে দিতে অতন্ত্র প্রহরীর ন্যায় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। সেই সাথে দেশে প্রাকৃকিত ও মানবিক বিপর্যয়, কল্যাণকর সামাজিক কর্মকান্ডসহ আর্ত-মানবতার সেবায় সবার আগে সদা প্রস্তুত।
ছাত্রলীগের দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় অনেককেই কঠোর সমালোচনায় মেতে উঠতে দেখা যায়। আজ তারা কোথায়? দেশের এমন ক্রান্তিলগ্নে তাদের ভূমিকা কী? দেশে তো অনেক ছাত্র সংগঠন রয়েছে। কিন্তু আজকের খারাপ সময়ে একটি পরিবারের দায়িত্ব নিতে কি আর কোন সংগঠনকে আপনার নজরে পড়েছে? এর উত্তর আপনাদের কাছে নেই। আপনারা এখন গর্তে লুকিয়ে আছেন। সমালোচনার জন্য ঠিকই বেড়িয়ে আসবেন। ছাত্রলীগ আপনার সমালোচনায় পিচপা হওয়ার সংগঠন নয়। ছাত্রলীগ এগিয়ে যাবে তার নিজের গতিতে। তাই বলবো, শুধু করোনা পরিস্থিতি নয়, ছাত্রলীগকে দেশ ও জনগনের ক্রান্তিকালে কাজের পরিধিকে আরো বেশি বর্ধিত করবে। অসহায় সাধারণ মানুষের নানা প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে শক্তি ও সাহস যোগাবে। তবেই আল্লাহর অশেষ দয়ায় দেশবাসী করোনা ভাইরাস কিংবা অন্যসব প্রতিবন্ধকতা শক্তি ও সমর্থ্যরে সাথে মোকাবেলা করার প্রেরণা পাবে।
লেখক পরিচিতি:
মো. জাহিদ হাসান
শিক্ষক ও কলাম লেখক
ই-মেইল: jahidhasan278@yahoo.com