আজ পহেলা বৈশাখী

  • আপডেট: ০১:৪৯:১৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল ২০২০
  • ২১

মো. মহিউদ্দিন আল আজাদ:

আজ মঙ্গলবা (১৪ এপ্রিল) ১৪২৭ বঙ্গাব্দ বাংলা শুভ নববর্ষ ‘পহেলা বৈশাখ’। আবহমান কাল থেকেই বাঙালীর অতীত ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত বাংলা নববর্ষ । এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। জাতীয় জীবনে এ গুরুত্বও অপরিসীম । বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি আমাদের দেশে শুভ নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়ে আসছে। তবে বিশ্বব্যাপী কোডিভ-১৯ মহামারির কারণে এবারেরর বৈশাখ উযাপন ও বৈশাখের সকল অনুষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।

পহেলা বৈশাখ বাঙালী জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক হিসেবে আজও বাঙালীর হৃদয়ের মণিকোঠায় মিশে আছে। পহেলা বৈশাখে রমনীরা নানা সাজে সজ্জিত হয়ে ঘুরে বেড়ায় আপন মনে। রবীন্দ্রনাথ পহেলা বৈশাখ কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন,”এসো হে বৈশাখ,এসো এসো ” গানটির মাধ্যমে।

সম্রাট আকবরের সময় থেকেই বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখের ধারা চলে চলছে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্যে একটি ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তারা এ দিনে শুভ হালখাতা করে পুরানো হিসেব চুকিয়ে নতুনভাবে ও নতুন আঙ্গিকে পহেলা বৈশাখে যাত্রা শুরু করেন।

সম্ভবত ,তুর্কি বিজয়ের পর বঙ্গদেশে হিজরি সন চালু হয়েছিল। চন্দ্র হিসেবে হিজরি সন ধরা হয়। চন্দ্রবর্ষে দিন ও মাস প্রতি ৩৩ বছরে একবার করে আবর্তিত হয়। যেমন রমজান মাসের রোজা, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই ঘুরে আসে। চান্দ্রমাস বা হিজরি সনের দিন ও মাস নির্দিষ্ট ঋতু বা ফসল তোলার মওসুমে স্থির না থাকায় খাজনা তোলার নির্দিষ্ট তারিখের সাথে ফসল তোলার সময়ে হেরফের হয়ে যায়।

তাই ৯৬৩ হিজরি সনে (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) ভারতবর্ষে আকবরের শাসনামলে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে প্রজাদের ফসল তোলার সময়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে ফসলি সন হিসেবে বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরি করা হয়। সম্রাট আকবরের উপদেষ্টা আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীর হিজরি সনের চান্দ্রবছরের হিসেবের পরিবর্তে সৌরবর্ষের হিসাব সংযোজন করে বাংলা সনের উদ্ভাবন করেন।

১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা মুঘল সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ স¤্রাট আকবর বাংলা সন সংক্রান্ত এক ফরমান জারি করেন। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূ-স্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন।

বাংলা দিনপঞ্জীর সঙ্গে হিজরী ও খ্রিষ্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিষ্টীয় সন ঘড়ি হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে।

ইংরেজি দিন শুর হয় মধ্যরাতে। পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু না সূর্যদোয় থেকে থেকে শুরু এটা নিয়ে অনেকের মতবিরোধ রযেছে। ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যদোয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এ নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২ টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু হয়।

আমরা ছোট বেলায় গাঁয়ের মেলায় যেতাম। সেখানে মাটির হাঁড়ি, পাতিল,খেলনা ও মিষ্টি-মন্ডা কিনতাম। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই মেলায় এসে আনন্দ-ফূর্তিতে ফেটে পড়তাম। যা ধূসর স্মৃতির আয়নায় আজ অম্লান। পহেলা বৈশাখের আগের আমেজ এখন আর নেই বললেই চলে। আমরা নিজস্ব সংস্কৃতিকে তেমন একটা প্রাধান্য দিচ্ছি না নানা অযুহাতে।

ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে দু’বছর ধরে বাংলা শুভ নববর্ষ পহেলা বৈশাখ পালিত হয়ে আসছে। এতে বিভিন্ন কর্মসূচিও রয়েছে। সরকার সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ২০% বেশাখি ভাতা প্রদান করেছেন। দেশের সকল সরকারি,বেসরকারি স্কুল,কলেজ ও মাদ্রাসায় মঙ্গল যাত্রা ও বৈশাখের নানা কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।

বিশ্বের সকল বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেন। ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীত বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখ হয়। কিন্তু এবার ভিন্ন বাস্তবতা। প্রকৃতি বড় রুষ্ঠ। করোনার প্রাদুর্ভাবে পর্যুদস্ত পৃথিবী। সদা দাপিয়ে বেড়ানো মানুষ ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছে। পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ নেই। একে অন্যের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছে শুধু। এ অবস্থায় আজ বর্ষ শুরুর দিনে সামাজিক দূরত্ব মেনে নিয়েও, মানসিকভাবে পরস্পরের কাছে থাকার শপথ নেবে বাঙালী।

রমনার বটমূলে যাওয়া হবে না। ছায়ানটের শিল্পীদের সঙ্গে গান গাওয়া হবে না। আয়োজন করা হবে না মঙ্গল শোভাযাত্রার। তবে বাঙালী তার মনের রংটুকু ধরে রাখবে। হতাশায় না ডুবে সবাই মিলে একসঙ্গে বাঁচার স্বপ্ন দেখবে। ভবিষ্যতে আরও সুন্দর আরও বর্ণাঢ্য নববর্ষ উদ্যাপনের স্বার্থেই এবার ঘরে বসে নিজেদের মতো করে উদ্যাপন করবে বাঙালী।

বর্ষ শুরুর দিনে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতির বাণী॥ নববর্ষ উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ দেশবাসীকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বৈশাখ শুধু ঋতুচক্রমনের ধারাবাহিকতা নয় বরং আমাদের ঐতিহ্য চেতনারই নাম। শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বাংলা নববর্ষ উৎসবের কোন তুলনা হয় না। অতীতের সব গ্লানি ও বিভেদ ভুলে বাংলা নববর্ষ জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ঐক্য ও সংহতি আরও সুদৃঢ় করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি।

প্রধানমন্ত্রীর বাণী॥ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পহেলা বৈশাখে বাঙালী সংস্কৃতির যে চর্চা হয় তা আমাদের জাতিসত্তাকে আরও বিকশিত করে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি জোগায়। করোনাভাইরাসের ভয়কে জয় করে বাঙালী আবারও জীবনের জয়গান করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

ইতিহাসটি সবার জানা, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক কৃষির। এ সম্পর্কের সূত্রেই বাংলা সাল প্রবর্তন করেন সম্রাট আকবর। তাঁর আমলেই প্রবর্তন হয় বাংলা সাল। এখন তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত। বঙ্গাব্দের মাস হিসেবে বৈশাখের প্রথম স্থান অধিকার করার ইতিহাসটি বেশি দিনের না হলেও, আদি সাহিত্যে বৈশাখের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। দক্ষের ২৭ কন্যার মধ্যে অনন্য সুন্দরী অথচ খরতাপময় মেজাজসম্পন্ন একজনের নাম বিশাখা। এই বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারেই বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখের নামকরণ। বৈদিক যুগে সৌরমতে বৎসর গণনার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সেখানেও সন্ধান মেলে বৈশাখের।

আবহমান কাল ধরেই চলছে বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। প্রকৃত রূপটি দৃশ্যমান হয় গ্রামে। এক সময় গ্রামবাংলায় চৈত্রসংক্রান্তি ছিল প্রধান উৎসব। বছরের শেষ দিনে তেতো খাবার খেয়ে শরীর শুদ্ধ করতেন কৃষাণ-কৃষাণীরা। নির্মল চিত্তে প্রস্তুত হতেন নতুন বছরে প্রবেশ করার জন্য। এখনও বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে বাড়িঘর ধুয়েমুছে পরিষ্কার করেন গৃহিণীরা। অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় আল্পনা আঁকেন মাটির মেঝেতে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠবেন সবাই। স্নান সারেন। নতুন পোশাক পরেন। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যান। ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। থাকে পিঠা-পুলির আয়োজন। নববর্ষ উপলক্ষে হাটে-মাঠে-ঘাটে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। নানা রকম কুটির শিল্প, খেলনা, মিষ্টিসহ বাহারি পণ্যে সাজানো হয় স্টল। থাকে নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা কিংবা কুস্তির মতো ঐতিহ্যবাহী আয়োজনও।

নাগরিক জীবনেও বিপুল আনন্দ যোগ করে পহেলা বৈশাখ। বর্ষবরণের দিন সব শহরেই আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য উৎসব অনুষ্ঠানের। ধর্ম বর্ণ ভেদ ভুলে অসাম্প্রদায়িক উৎসবে মাতে বাংলা। ষাটের দশকে বাঙালী চেতনাবিরোধী অবস্থানের প্রতিবাদে রাজধানী শহর ঢাকার রমনা বটমূলে শুরু হয় বৈশাখ উদ্যাপন। এর মাধ্যমে বাঙালী আপন পরিচয়ে সামনে আসার সুযোগ পায়। পরবর্তী সময়ে বাঙালীর রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে পহেলা বৈশাখের। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিবসটি বর্তমানে বাঙালীর জাতিসত্তায়, চেতনায় ও অনুভবের জগতে গভীরভাবে বিরাজ করছে।

Tag :
সর্বাধিক পঠিত

যেভাবে হ ত্যা করা হয় তরুণ আইনজীবী সাইফলকে

আজ পহেলা বৈশাখী

আপডেট: ০১:৪৯:১৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল ২০২০

মো. মহিউদ্দিন আল আজাদ:

আজ মঙ্গলবা (১৪ এপ্রিল) ১৪২৭ বঙ্গাব্দ বাংলা শুভ নববর্ষ ‘পহেলা বৈশাখ’। আবহমান কাল থেকেই বাঙালীর অতীত ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত বাংলা নববর্ষ । এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। জাতীয় জীবনে এ গুরুত্বও অপরিসীম । বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি আমাদের দেশে শুভ নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়ে আসছে। তবে বিশ্বব্যাপী কোডিভ-১৯ মহামারির কারণে এবারেরর বৈশাখ উযাপন ও বৈশাখের সকল অনুষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।

পহেলা বৈশাখ বাঙালী জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক হিসেবে আজও বাঙালীর হৃদয়ের মণিকোঠায় মিশে আছে। পহেলা বৈশাখে রমনীরা নানা সাজে সজ্জিত হয়ে ঘুরে বেড়ায় আপন মনে। রবীন্দ্রনাথ পহেলা বৈশাখ কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন,”এসো হে বৈশাখ,এসো এসো ” গানটির মাধ্যমে।

সম্রাট আকবরের সময় থেকেই বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখের ধারা চলে চলছে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্যে একটি ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তারা এ দিনে শুভ হালখাতা করে পুরানো হিসেব চুকিয়ে নতুনভাবে ও নতুন আঙ্গিকে পহেলা বৈশাখে যাত্রা শুরু করেন।

সম্ভবত ,তুর্কি বিজয়ের পর বঙ্গদেশে হিজরি সন চালু হয়েছিল। চন্দ্র হিসেবে হিজরি সন ধরা হয়। চন্দ্রবর্ষে দিন ও মাস প্রতি ৩৩ বছরে একবার করে আবর্তিত হয়। যেমন রমজান মাসের রোজা, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই ঘুরে আসে। চান্দ্রমাস বা হিজরি সনের দিন ও মাস নির্দিষ্ট ঋতু বা ফসল তোলার মওসুমে স্থির না থাকায় খাজনা তোলার নির্দিষ্ট তারিখের সাথে ফসল তোলার সময়ে হেরফের হয়ে যায়।

তাই ৯৬৩ হিজরি সনে (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) ভারতবর্ষে আকবরের শাসনামলে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে প্রজাদের ফসল তোলার সময়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে ফসলি সন হিসেবে বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরি করা হয়। সম্রাট আকবরের উপদেষ্টা আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীর হিজরি সনের চান্দ্রবছরের হিসেবের পরিবর্তে সৌরবর্ষের হিসাব সংযোজন করে বাংলা সনের উদ্ভাবন করেন।

১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা মুঘল সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ স¤্রাট আকবর বাংলা সন সংক্রান্ত এক ফরমান জারি করেন। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূ-স্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন।

বাংলা দিনপঞ্জীর সঙ্গে হিজরী ও খ্রিষ্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিষ্টীয় সন ঘড়ি হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে।

ইংরেজি দিন শুর হয় মধ্যরাতে। পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু না সূর্যদোয় থেকে থেকে শুরু এটা নিয়ে অনেকের মতবিরোধ রযেছে। ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যদোয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এ নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২ টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু হয়।

আমরা ছোট বেলায় গাঁয়ের মেলায় যেতাম। সেখানে মাটির হাঁড়ি, পাতিল,খেলনা ও মিষ্টি-মন্ডা কিনতাম। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই মেলায় এসে আনন্দ-ফূর্তিতে ফেটে পড়তাম। যা ধূসর স্মৃতির আয়নায় আজ অম্লান। পহেলা বৈশাখের আগের আমেজ এখন আর নেই বললেই চলে। আমরা নিজস্ব সংস্কৃতিকে তেমন একটা প্রাধান্য দিচ্ছি না নানা অযুহাতে।

ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে দু’বছর ধরে বাংলা শুভ নববর্ষ পহেলা বৈশাখ পালিত হয়ে আসছে। এতে বিভিন্ন কর্মসূচিও রয়েছে। সরকার সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ২০% বেশাখি ভাতা প্রদান করেছেন। দেশের সকল সরকারি,বেসরকারি স্কুল,কলেজ ও মাদ্রাসায় মঙ্গল যাত্রা ও বৈশাখের নানা কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।

বিশ্বের সকল বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেন। ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীত বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখ হয়। কিন্তু এবার ভিন্ন বাস্তবতা। প্রকৃতি বড় রুষ্ঠ। করোনার প্রাদুর্ভাবে পর্যুদস্ত পৃথিবী। সদা দাপিয়ে বেড়ানো মানুষ ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছে। পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ নেই। একে অন্যের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছে শুধু। এ অবস্থায় আজ বর্ষ শুরুর দিনে সামাজিক দূরত্ব মেনে নিয়েও, মানসিকভাবে পরস্পরের কাছে থাকার শপথ নেবে বাঙালী।

রমনার বটমূলে যাওয়া হবে না। ছায়ানটের শিল্পীদের সঙ্গে গান গাওয়া হবে না। আয়োজন করা হবে না মঙ্গল শোভাযাত্রার। তবে বাঙালী তার মনের রংটুকু ধরে রাখবে। হতাশায় না ডুবে সবাই মিলে একসঙ্গে বাঁচার স্বপ্ন দেখবে। ভবিষ্যতে আরও সুন্দর আরও বর্ণাঢ্য নববর্ষ উদ্যাপনের স্বার্থেই এবার ঘরে বসে নিজেদের মতো করে উদ্যাপন করবে বাঙালী।

বর্ষ শুরুর দিনে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতির বাণী॥ নববর্ষ উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ দেশবাসীকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বৈশাখ শুধু ঋতুচক্রমনের ধারাবাহিকতা নয় বরং আমাদের ঐতিহ্য চেতনারই নাম। শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বাংলা নববর্ষ উৎসবের কোন তুলনা হয় না। অতীতের সব গ্লানি ও বিভেদ ভুলে বাংলা নববর্ষ জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ঐক্য ও সংহতি আরও সুদৃঢ় করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি।

প্রধানমন্ত্রীর বাণী॥ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পহেলা বৈশাখে বাঙালী সংস্কৃতির যে চর্চা হয় তা আমাদের জাতিসত্তাকে আরও বিকশিত করে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি জোগায়। করোনাভাইরাসের ভয়কে জয় করে বাঙালী আবারও জীবনের জয়গান করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

ইতিহাসটি সবার জানা, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক কৃষির। এ সম্পর্কের সূত্রেই বাংলা সাল প্রবর্তন করেন সম্রাট আকবর। তাঁর আমলেই প্রবর্তন হয় বাংলা সাল। এখন তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত। বঙ্গাব্দের মাস হিসেবে বৈশাখের প্রথম স্থান অধিকার করার ইতিহাসটি বেশি দিনের না হলেও, আদি সাহিত্যে বৈশাখের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। দক্ষের ২৭ কন্যার মধ্যে অনন্য সুন্দরী অথচ খরতাপময় মেজাজসম্পন্ন একজনের নাম বিশাখা। এই বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারেই বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখের নামকরণ। বৈদিক যুগে সৌরমতে বৎসর গণনার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সেখানেও সন্ধান মেলে বৈশাখের।

আবহমান কাল ধরেই চলছে বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। প্রকৃত রূপটি দৃশ্যমান হয় গ্রামে। এক সময় গ্রামবাংলায় চৈত্রসংক্রান্তি ছিল প্রধান উৎসব। বছরের শেষ দিনে তেতো খাবার খেয়ে শরীর শুদ্ধ করতেন কৃষাণ-কৃষাণীরা। নির্মল চিত্তে প্রস্তুত হতেন নতুন বছরে প্রবেশ করার জন্য। এখনও বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে বাড়িঘর ধুয়েমুছে পরিষ্কার করেন গৃহিণীরা। অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় আল্পনা আঁকেন মাটির মেঝেতে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠবেন সবাই। স্নান সারেন। নতুন পোশাক পরেন। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যান। ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। থাকে পিঠা-পুলির আয়োজন। নববর্ষ উপলক্ষে হাটে-মাঠে-ঘাটে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। নানা রকম কুটির শিল্প, খেলনা, মিষ্টিসহ বাহারি পণ্যে সাজানো হয় স্টল। থাকে নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা কিংবা কুস্তির মতো ঐতিহ্যবাহী আয়োজনও।

নাগরিক জীবনেও বিপুল আনন্দ যোগ করে পহেলা বৈশাখ। বর্ষবরণের দিন সব শহরেই আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য উৎসব অনুষ্ঠানের। ধর্ম বর্ণ ভেদ ভুলে অসাম্প্রদায়িক উৎসবে মাতে বাংলা। ষাটের দশকে বাঙালী চেতনাবিরোধী অবস্থানের প্রতিবাদে রাজধানী শহর ঢাকার রমনা বটমূলে শুরু হয় বৈশাখ উদ্যাপন। এর মাধ্যমে বাঙালী আপন পরিচয়ে সামনে আসার সুযোগ পায়। পরবর্তী সময়ে বাঙালীর রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে পহেলা বৈশাখের। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিবসটি বর্তমানে বাঙালীর জাতিসত্তায়, চেতনায় ও অনুভবের জগতে গভীরভাবে বিরাজ করছে।