জঙ্গি হামলা মোকাবেলায় সর্বোচ্চ সতর্ক গোয়েন্দারা: ব্যক্তি ও ফেইসবুক চিহ্নিত

  • আপডেট: ০১:৩৪:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ জুন ২০১৯
  • ৪৩

অনলাইন ডেস্ক:

জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা মাথায় রেখে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে সব ধরনের গোয়েন্দা তথ্য গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এজন্য জঙ্গি সংগঠন ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিবিশেষের তথ্যভাণ্ডার তৈরির কাজ চলছে। এরই মধ্যে জঙ্গি সম্পর্কিত ৫০০টি ফেসবুক পেজ চিহ্নিত করে একটি বিশেষ তথ্যভাণ্ডার তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া মোবাইল ফোন নম্বর ও ফোনকল বিশ্লেষণ করে প্রায় ৫০ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাদের বিশেষ নজরদারির মধ্যে আনা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এমনটি জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, উগ্র ধর্মীয় মতাদর্শের প্রচার ও জঙ্গিবাদের বৈশ্বিক ঝুঁকির ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। সম্প্রতি শ্রীলংকায় জঙ্গি হামলার পর এখানেও এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি রয়েছে- এমন আশঙ্কার কথা বিভিন্ন দায়িত্বশীল মহল থেকে বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় এ বিষয়ে প্রাপ্ত দেশি ও বিদেশি গোয়েন্দা তথ্য গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণের পাশাপাশি দেশের পুরো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তবে এ নিয়ে জনগণের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈশ্বিক নানা প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে পৃথিবীর বহু দেশ এখন সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তারাও এর বাইরে নন। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা কথিত ও সন্দেহভাজন জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের অবস্থান চিহ্নিত করার পাশাপাশি সন্ত্রাসবিরোধী সব মুভমেন্ট জারি রেখেছে। পুলিশি ভাষায় এ রকম তৎপরতাকে অনেকে রেড অ্যালার্টও বলে থাকে।

গত মাসেই সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দেশের সাম্প্রতিক জঙ্গি হুমকি সম্পর্কে বিশদ প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলংকায় জঙ্গিগোষ্ঠী কর্তৃক হামলার পর বাংলাদেশেও হুমকি বিদ্যমান আছে বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ সম্প্রতি ‘লোন উলফ’ বা একাকী মুজাহিদ নামক একটি জিহাদি বার্তা ২৪ মার্চ সিক্রেট টেলিগ্রাম চ্যানেল আল-ফেরদাউস নিউজে প্রকাশিত হয়। জঙ্গি সংক্রান্ত কয়েকটি ওয়েবসাইটে উগ্র ধর্মীয় বার্তা সম্পর্কিত একটি মুভি ট্রেলারও বের করা হয়।

লোন উলফ : প্রতিবেদনে বলা হয়, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো কথিত জিহাদে ব্যক্তিপর্যায়ে হামলার জন্য ‘লোন উলফ’ বা একাকী জিহাদের ধারণা প্রচার করছে। এ ধারণার মাধ্যমে বৈশ্বিক জঙ্গি মতাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টার্গেট নির্ধারণ ও তার ওপর একাকী হামলা চালানোর কথা বলা হচ্ছে। গোয়েন্দারা বলছেন, এমন ধারণার তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে- সিলেটে অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী লোন উলফ ধারণায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। লোন উলফ ধারণার মাধ্যমে জঙ্গিদের শারীরিক কসরত, স্থানীয় বাজার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ ও হামলা-পরবর্তী গা ঢাকা দেয়ার কৌশল, এমনকি টার্গেট নির্ধারণ থেকে হামলা সফলের প্রত্যেকটি স্তরের বিশদ দিকনির্দেশনা দেয়া হয়।

বিটকয়েনে অর্থায়ন : গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ভার্চুয়াল মুদ্রা বা বিটকয়েন অবৈধ হলেও সিক্রেট টেলিগ্রাম চ্যানেলের মাধ্যমে বিটকয়েন লেনদেনের প্রমাণ পাওয় যায়। এমনকি বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইটে বাংলায় বিটকয়েন কেনাবেচার বিজ্ঞাপনও দেয়া হচ্ছে।

সূত্র বলছে, বিটকয়েন বা ভার্চুয়াল মুদ্রা সারা বিশ্বেই প্রচলিত মুদ্রা ও লেনদেন ব্যবস্থাকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে। কারণ বিটকয়েন লেনদেন কোনো দেশের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। এটি প্রচলিত মুদ্রা ব্যবস্থার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নতর এবং অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও অদৃশ্য। বিটকয়েন বিক্রির ওয়েবসাইট থেকে যে কেউ নগদ অর্থ, ক্রেডিট কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে বিটকয়েন কিনতে পারেন এবং সেটি পুনরায় প্রচলিত মুদ্রায় রূপান্তর করতে পারেন। এছাড়া সাধারণ একটি কম্পিউটার ব্যবহার করেও বিটকয়েন মাইনিং বা উপার্জন করা যায়, যা বিটকয়েন ওয়ালেট বা অনলাইন মানিব্যাগে সঞ্চিত থাকে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বিটকয়েন সংগ্রহ ও ব্যবহারের একটি উদাহরণ উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, অনলাইন মানিব্যাগে সঞ্চিত বিটকয়েন ব্যবহার করে অনায়াসেই অস্ত্র, মাদক, মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনাবেচা করা যায়। ডার্ক ওয়েবসাইট থেকে বিটকয়েনের সাহায্যে অস্ত্র-গোলাবারুদ কেনার পর তা আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস, শিপিং অথবা পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে ঘরে বসে ডেলিভারি পেতে পারে। বিটকয়েন ব্যবহার করে বর্তমান বিশ্বে অন্তত ১০ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এগুলো হল- মানি লন্ডারিং, মাদক বা অস্ত্রসহ কেনাবেচাসহ নানা অবৈধ্য ব্যবসা, প্রতারণা, জুয়া, ক্রিপ্টোজ্যাকিং, মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি, পেশাদার খুনি ভাড়া করা, রাষ্ট্রীয় অতিগোপনীয় তথ্য বিক্রি এবং সাইবার হামলা চালানোর জন্য হ্যাকার ভাড়া করা।

গোয়েন্দারা বলছেন, মূলত জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো ৪টি ধাপে বিটকয়েন ব্যবহার করছে। প্রথম ধাপে তারা অনলাইন মার্কেট প্লেস থেকে বিটকয়েন সংগ্রহ করে। এরপর বিটকয়েন দিয়ে অতিসহজেই ডার্ক ওয়েবসাইট থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ কিনে নেয়। শেষ ধাপে বিটকয়েন ভাঙিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রচলিত মুদ্রায় রূপান্তর করে হামলাকারী বা ভাড়াটে খুনিকে পারিশ্রমিক অথবা পুরস্কার হিসেবে অর্থ প্রদান করে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে নিউইয়র্কে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে একজন নারী গ্রেফতার হলে বিটকয়েনে জঙ্গি অর্থায়নের বিষয়টি সামনে আসে। জঙ্গি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ ওই নারী ৬২ হাজার ডলার সমমূল্যের বিটকয়েন ইসলামিক স্টেটকে দান করেন। এজন্য তিনি ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মোটা অঙ্কের ঋণ নেন। সেই অর্থ দিয়ে তিনি বিটকয়েন কেনেন। এরপর সেগুলো পাকিস্তান, চীন ও তুরস্ক থেকে জঙ্গি সংগঠনের কাছে পাঠান। ইসলামিক স্টেট বা আইএস তাদের ওয়েবসাইট ‘ইসদারাত’-এ বিটকয়েনের মাধ্যমে অর্থ সহায়তা পেয়ে পৃষ্ঠপোষকদের ধন্যবাদ জানায়। বাংলাদেশে ইসলামিক ফান্ড ডটকম, ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট, হালাল ব্যাংকিং নামের কয়েকটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিটকয়েন কেনাবেচা হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে বিটকয়েন বা ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন সম্পূর্ণ অবৈধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে।

৯ সংগঠনের ওপর নজরদারি : গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত থাকার অভিযোগে ৯টি সংগঠনের ওপর ব্যাপক নজরদারি করা হচ্ছে। এগুলো হল আল্লাহর দল, হিজবুত তাওহিদ, ইসলামী সমাজ, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (আইডিপি), তাওহিদ ট্রাস্ট বা তৌহিদ ট্রাস্ট, তামির-উদ-দ্বীন, উলেমা আঞ্জুমান আল বাইয়্যিনাত বাংলাদেশ। এছাড়া ইসলামিক স্টেট ও আল কায়দা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট নামে দুটি সংগঠনের বাংলাদেশ সক্রিয় থাকার বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এদের মধ্যে ৭টি সংগঠনকে ২০০৯ সালেই কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এর বাইরে আরও কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছে কি না, তার খোঁজে অনুসন্ধান চলছে।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, জঙ্গিবাদ প্রচারণায় অনলাইন প্লাটফর্ম বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। সহজেই অনলাইনে জঙ্গি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধকরণ, বৈশ্বিক জিহাদের খবরাখবর প্রচার, ট্রেনিং ও অস্ত্র সংগ্রহের কাজ হচ্ছে। কিন্তু এসব অনলাইন চিহ্নিত করে বন্ধ করলেও তেমন একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশে জঙ্গি সাইটগুলোর আইপি ব্লক করা হলেও স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যায় না। কম্পিউটার প্রযুক্তিতে দক্ষতাসম্পন্ন যে কেউ ভিপিএন ও প্রক্সি ব্যবহার করে বন্ধ করে দেয়া ওয়েবসাইটগুলো সহজেই পুনরায় খুলতে পারে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ  বলেন, জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি এখন গোটা বিশ্বের সমস্যা। তাই বিশেষায়িত কৌশল প্রণয়ন করে আমাদেরে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে হবে। কারণ জঙ্গি হামলার পেছনে কোনো না কোনো দেশের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। জঙ্গিবাদকে সস্তা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিনি আরও বলেন, হেট কালচার বা ঘৃণা ও সহিংসতা ছড়িয়ে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়। এজন্য সম্প্রীতির মেলবন্ধন প্রয়োজন। এছাড়া জঙ্গিবাদের চাষ হয় মূলত মানুষের ধর্মান্ধ মস্তিষ্কে। যার বীজ রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মধ্যে। তাই জঙ্গিবাদ দমন করতে হলে রাজনীতি থেকে ধর্মান্ধতা মুক্ত করতে হবে।

Tag :
সর্বাধিক পঠিত

হাজীগঞ্জ বাজারে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় রণক্ষেত্র, আহত অর্ধশতাধীক

জঙ্গি হামলা মোকাবেলায় সর্বোচ্চ সতর্ক গোয়েন্দারা: ব্যক্তি ও ফেইসবুক চিহ্নিত

আপডেট: ০১:৩৪:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ জুন ২০১৯

অনলাইন ডেস্ক:

জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা মাথায় রেখে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে সব ধরনের গোয়েন্দা তথ্য গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এজন্য জঙ্গি সংগঠন ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিবিশেষের তথ্যভাণ্ডার তৈরির কাজ চলছে। এরই মধ্যে জঙ্গি সম্পর্কিত ৫০০টি ফেসবুক পেজ চিহ্নিত করে একটি বিশেষ তথ্যভাণ্ডার তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া মোবাইল ফোন নম্বর ও ফোনকল বিশ্লেষণ করে প্রায় ৫০ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাদের বিশেষ নজরদারির মধ্যে আনা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এমনটি জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, উগ্র ধর্মীয় মতাদর্শের প্রচার ও জঙ্গিবাদের বৈশ্বিক ঝুঁকির ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। সম্প্রতি শ্রীলংকায় জঙ্গি হামলার পর এখানেও এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি রয়েছে- এমন আশঙ্কার কথা বিভিন্ন দায়িত্বশীল মহল থেকে বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় এ বিষয়ে প্রাপ্ত দেশি ও বিদেশি গোয়েন্দা তথ্য গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণের পাশাপাশি দেশের পুরো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তবে এ নিয়ে জনগণের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৈশ্বিক নানা প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে পৃথিবীর বহু দেশ এখন সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তারাও এর বাইরে নন। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা কথিত ও সন্দেহভাজন জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের অবস্থান চিহ্নিত করার পাশাপাশি সন্ত্রাসবিরোধী সব মুভমেন্ট জারি রেখেছে। পুলিশি ভাষায় এ রকম তৎপরতাকে অনেকে রেড অ্যালার্টও বলে থাকে।

গত মাসেই সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দেশের সাম্প্রতিক জঙ্গি হুমকি সম্পর্কে বিশদ প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলংকায় জঙ্গিগোষ্ঠী কর্তৃক হামলার পর বাংলাদেশেও হুমকি বিদ্যমান আছে বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ সম্প্রতি ‘লোন উলফ’ বা একাকী মুজাহিদ নামক একটি জিহাদি বার্তা ২৪ মার্চ সিক্রেট টেলিগ্রাম চ্যানেল আল-ফেরদাউস নিউজে প্রকাশিত হয়। জঙ্গি সংক্রান্ত কয়েকটি ওয়েবসাইটে উগ্র ধর্মীয় বার্তা সম্পর্কিত একটি মুভি ট্রেলারও বের করা হয়।

লোন উলফ : প্রতিবেদনে বলা হয়, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো কথিত জিহাদে ব্যক্তিপর্যায়ে হামলার জন্য ‘লোন উলফ’ বা একাকী জিহাদের ধারণা প্রচার করছে। এ ধারণার মাধ্যমে বৈশ্বিক জঙ্গি মতাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টার্গেট নির্ধারণ ও তার ওপর একাকী হামলা চালানোর কথা বলা হচ্ছে। গোয়েন্দারা বলছেন, এমন ধারণার তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে- সিলেটে অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী লোন উলফ ধারণায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। লোন উলফ ধারণার মাধ্যমে জঙ্গিদের শারীরিক কসরত, স্থানীয় বাজার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ ও হামলা-পরবর্তী গা ঢাকা দেয়ার কৌশল, এমনকি টার্গেট নির্ধারণ থেকে হামলা সফলের প্রত্যেকটি স্তরের বিশদ দিকনির্দেশনা দেয়া হয়।

বিটকয়েনে অর্থায়ন : গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ভার্চুয়াল মুদ্রা বা বিটকয়েন অবৈধ হলেও সিক্রেট টেলিগ্রাম চ্যানেলের মাধ্যমে বিটকয়েন লেনদেনের প্রমাণ পাওয় যায়। এমনকি বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইটে বাংলায় বিটকয়েন কেনাবেচার বিজ্ঞাপনও দেয়া হচ্ছে।

সূত্র বলছে, বিটকয়েন বা ভার্চুয়াল মুদ্রা সারা বিশ্বেই প্রচলিত মুদ্রা ও লেনদেন ব্যবস্থাকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে। কারণ বিটকয়েন লেনদেন কোনো দেশের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। এটি প্রচলিত মুদ্রা ব্যবস্থার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নতর এবং অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও অদৃশ্য। বিটকয়েন বিক্রির ওয়েবসাইট থেকে যে কেউ নগদ অর্থ, ক্রেডিট কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে বিটকয়েন কিনতে পারেন এবং সেটি পুনরায় প্রচলিত মুদ্রায় রূপান্তর করতে পারেন। এছাড়া সাধারণ একটি কম্পিউটার ব্যবহার করেও বিটকয়েন মাইনিং বা উপার্জন করা যায়, যা বিটকয়েন ওয়ালেট বা অনলাইন মানিব্যাগে সঞ্চিত থাকে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বিটকয়েন সংগ্রহ ও ব্যবহারের একটি উদাহরণ উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, অনলাইন মানিব্যাগে সঞ্চিত বিটকয়েন ব্যবহার করে অনায়াসেই অস্ত্র, মাদক, মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনাবেচা করা যায়। ডার্ক ওয়েবসাইট থেকে বিটকয়েনের সাহায্যে অস্ত্র-গোলাবারুদ কেনার পর তা আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস, শিপিং অথবা পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে ঘরে বসে ডেলিভারি পেতে পারে। বিটকয়েন ব্যবহার করে বর্তমান বিশ্বে অন্তত ১০ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এগুলো হল- মানি লন্ডারিং, মাদক বা অস্ত্রসহ কেনাবেচাসহ নানা অবৈধ্য ব্যবসা, প্রতারণা, জুয়া, ক্রিপ্টোজ্যাকিং, মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি, পেশাদার খুনি ভাড়া করা, রাষ্ট্রীয় অতিগোপনীয় তথ্য বিক্রি এবং সাইবার হামলা চালানোর জন্য হ্যাকার ভাড়া করা।

গোয়েন্দারা বলছেন, মূলত জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো ৪টি ধাপে বিটকয়েন ব্যবহার করছে। প্রথম ধাপে তারা অনলাইন মার্কেট প্লেস থেকে বিটকয়েন সংগ্রহ করে। এরপর বিটকয়েন দিয়ে অতিসহজেই ডার্ক ওয়েবসাইট থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ কিনে নেয়। শেষ ধাপে বিটকয়েন ভাঙিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রচলিত মুদ্রায় রূপান্তর করে হামলাকারী বা ভাড়াটে খুনিকে পারিশ্রমিক অথবা পুরস্কার হিসেবে অর্থ প্রদান করে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে নিউইয়র্কে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে একজন নারী গ্রেফতার হলে বিটকয়েনে জঙ্গি অর্থায়নের বিষয়টি সামনে আসে। জঙ্গি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ ওই নারী ৬২ হাজার ডলার সমমূল্যের বিটকয়েন ইসলামিক স্টেটকে দান করেন। এজন্য তিনি ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মোটা অঙ্কের ঋণ নেন। সেই অর্থ দিয়ে তিনি বিটকয়েন কেনেন। এরপর সেগুলো পাকিস্তান, চীন ও তুরস্ক থেকে জঙ্গি সংগঠনের কাছে পাঠান। ইসলামিক স্টেট বা আইএস তাদের ওয়েবসাইট ‘ইসদারাত’-এ বিটকয়েনের মাধ্যমে অর্থ সহায়তা পেয়ে পৃষ্ঠপোষকদের ধন্যবাদ জানায়। বাংলাদেশে ইসলামিক ফান্ড ডটকম, ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট, হালাল ব্যাংকিং নামের কয়েকটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিটকয়েন কেনাবেচা হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে বিটকয়েন বা ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন সম্পূর্ণ অবৈধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে।

৯ সংগঠনের ওপর নজরদারি : গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত থাকার অভিযোগে ৯টি সংগঠনের ওপর ব্যাপক নজরদারি করা হচ্ছে। এগুলো হল আল্লাহর দল, হিজবুত তাওহিদ, ইসলামী সমাজ, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (আইডিপি), তাওহিদ ট্রাস্ট বা তৌহিদ ট্রাস্ট, তামির-উদ-দ্বীন, উলেমা আঞ্জুমান আল বাইয়্যিনাত বাংলাদেশ। এছাড়া ইসলামিক স্টেট ও আল কায়দা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট নামে দুটি সংগঠনের বাংলাদেশ সক্রিয় থাকার বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এদের মধ্যে ৭টি সংগঠনকে ২০০৯ সালেই কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এর বাইরে আরও কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছে কি না, তার খোঁজে অনুসন্ধান চলছে।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, জঙ্গিবাদ প্রচারণায় অনলাইন প্লাটফর্ম বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। সহজেই অনলাইনে জঙ্গি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধকরণ, বৈশ্বিক জিহাদের খবরাখবর প্রচার, ট্রেনিং ও অস্ত্র সংগ্রহের কাজ হচ্ছে। কিন্তু এসব অনলাইন চিহ্নিত করে বন্ধ করলেও তেমন একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশে জঙ্গি সাইটগুলোর আইপি ব্লক করা হলেও স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যায় না। কম্পিউটার প্রযুক্তিতে দক্ষতাসম্পন্ন যে কেউ ভিপিএন ও প্রক্সি ব্যবহার করে বন্ধ করে দেয়া ওয়েবসাইটগুলো সহজেই পুনরায় খুলতে পারে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ  বলেন, জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি এখন গোটা বিশ্বের সমস্যা। তাই বিশেষায়িত কৌশল প্রণয়ন করে আমাদেরে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে হবে। কারণ জঙ্গি হামলার পেছনে কোনো না কোনো দেশের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। জঙ্গিবাদকে সস্তা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিনি আরও বলেন, হেট কালচার বা ঘৃণা ও সহিংসতা ছড়িয়ে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়। এজন্য সম্প্রীতির মেলবন্ধন প্রয়োজন। এছাড়া জঙ্গিবাদের চাষ হয় মূলত মানুষের ধর্মান্ধ মস্তিষ্কে। যার বীজ রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মধ্যে। তাই জঙ্গিবাদ দমন করতে হলে রাজনীতি থেকে ধর্মান্ধতা মুক্ত করতে হবে।