ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সাধারণ ওয়ার্ড ৫৪টি ও সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড ১৮টি। আর দক্ষিণ সিটিতে সাধারণ ওয়ার্ড ৭৫টি ও সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড ২৫টি। ঢাকা উত্তর সিটির মোট ভোটার ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৬২১ জন ও দক্ষিণে ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৮ জন।
নির্বাচন কমিশন গত ২২ ডিসেম্বর ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল ৩১ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই ২ জানুয়ারি, প্রার্থিতা প্রত্যাহার ৯ জানুয়ারি ও ভোটগ্রহণ ৩০ জানুয়ারি।
দলীয় কাউন্সিলর মনোনয়নে উত্তর সিটি করপোরেশনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বাছাই কমিটি সাক্ষাৎকার নিয়ে যাদের নাম চূড়ান্ত করেছিল তাদের ৬ জনকে বাদ দিয়ে অন্যদের নাম প্রকাশ করা হয়। বাছাইয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের পরও বাদ পড়ার পেছনে মনোনয়নবাণিজ্য একমাত্র কারণ হিসেবে কাজ করেছে বলে অভিযোগ বঞ্চিতদের।
গতকাল রাতে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৯, ৪০ ও ৫৪ এই তিনটি ওয়ার্ডে কোনো প্রার্থীর নাম না রেখেই প্রকাশ করা হয় তালিকা। ওই তালিকায় স্থান পাওয়া বিএনপি মনোনীত উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রার্থীদের মধ্যে আছেন— মোস্তাফিজুর রহমান সেগুন (ওয়ার্ড নং-১), সাজ্জাদ হোসেন (২), হাজি আবু তৈয়ব (৩), মো. সাইফুল ইসলাম (৪), আনোয়ার হোসেন (৫), মাহফুজ হোসেন খান সুমন (৬), মো. দেলোয়ার হোসেন দুলু (৭), ফেরদৌস আহমেদ মিষ্টি (৮), মো. সাইদুল ইসলাম (৯), মো. মাসুদ খান (১০), মো. শামীম পারভেজ (১১), মো. শহীদুর রহমান এনা (১২), আনোয়ার শাহাদাৎ খান রনি (১৩), মো. আক্তার হোসেন জিলু (১৪), মো. লিয়াকত আলী (১৫), মো. হাবিবুর রহমান (১৬), মো. শাহীনুল আলম (১৭), শরীফ উদ্দিন (১৮), ফারুক হোসেন ভূঁইয়া (১৯), মো. মিজানুর রহমান বাচ্চু (২০), এ জি এম শামসুল হক (২১), ফয়েজ আহমেদ ফরু (২২), মো. হেলাল কবির (২৩), হুমায়ুন কবির আহম্মেদ (২৪), সাইফুল ইসলাম কাজল (২৫), মো. আজিজুল রহমান মুছাব্বির (২৬), আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার (২৭), অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দিন জসিম (২৮), ২৯নং ওয়ার্ডে প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি, হাজি নাসির উদ্দিন (৩০), মো. সাজেদুল হক খান রনি (৩১), আতিকুল ইসলাম মতিন (৩২), এম এস আহমেদ আলী (৩৩), ওসমান গণি শাহজাহান (৩৪), শেখ আমির হোসেন (৩৫), সাজেদা আলী হোসেন (৩৬), এম এ বাশার (৩৭), মো. জাহাঙ্গীর মোলা (৩৮), মো. দেলোয়ার হোসেন (৩৯), ৪০ নং ওয়ার্ডে প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি, নবী হোসেন (৪১), তহিরুল ইসলাম তুহিন (৪২), মো. আক্তার হোসেন (৪৩), মো. আনোয়ার হোসেন আইনাল (৪৪), জাহাঙ্গীর আলম (৪৫), মো. আতিকুর রহমান (৪৬), মো. মোতালেব হোসেন রতন (৪৭), আলী আকবর আলী (৪৮), মো. শাহাবুদ্দিন (৪৯), দেওয়ান মো. নাজিম উদ্দিন (৫০), মো. আফাজ উদ্দিন (৫১), মো. আলমাস আলী (৫২), মো. মোস্তফা জামান (৫৩) এবং ৫৪নং ওয়ার্ডে কোনো প্রার্থীর ঘরে নাম ছিল না।
এদিকে বিএনপির কাউন্সিলদের মনোনয়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষরিত চূড়ান্ত মনোনয়নপ্রাপ্তদের নামের তালিকাও পাওয়া গেছে। সেই তালিকার সঙ্গে প্রকাশিত তালিকার ৬টি স্থানে হেরফের পাওয়া গেছে। ৫নং ওয়ার্ডে বাছাই কমিটি বুলবুল আহমেদ মল্লিক, ১৩নং ওয়ার্ডে মো. শাকিল মোল্লা, ২৯নং মো. এনায়েত হাফিজ, ৩৪নং ওয়ার্ডে মো. মাসুম খান রাজেশ, ৪০নং ওয়ার্ডে আজহারুল ইসলাম সেলিম এবং ৫২নং ওয়ার্ডে প্রার্থীর ঘর ফাঁকা রাখা হয়।
গুলশান কার্যালয় থেকে বাছাই কমিটির তালিকা কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে গায়েবের অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, গুলশান কার্যালয়ে দায়িতপ্রাপ্ত নেতারা ৫৪নং ওয়ার্ড ছাড়া বাকি সব ওয়ার্ডের প্রার্থী গত সোমবার রাত ১০টার আগেই চূড়ান্ত করে। কিন্তু এরপরেই তালিকায় বেশ কয়েকটি নাম পরিবর্তনের জন্য নেতাদের চাপ দেন ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম। এ সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা তাকে দক্ষিণের দায়িত্ব পালনের কথা বললে বািবতণ্ডা শুরু হয়। উত্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা যে তালিকা চূড়ান্ত করেছে তা পরিবর্তন হবে না বললে সালাম বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে এই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেন। মহাসচিব সালামের পক্ষে কথা বললেও উত্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা মহাসচিবকে বোঝাতে সক্ষম হন সবচেয়ে যোগ্যদেরই প্রার্থী করা হয়েছে। পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা চূড়ান্ত তালিকায় স্বাক্ষর করে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমে পাঠানোর জন্য। এখানেও সালামের তৎপরতা থেমে থাকেনি। এর প্রতিফলন ঘটে বিএনপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। সালাম যেসব প্রার্থীকে নিয়ে দেনদরবার করেছিলেন তাদের সবার নাম স্থান পায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আর সেই স্থানে বাদ পড়েন বাছাই কমিটির প্রার্থীরা।
এর কারণ জানতে তালিকায় নাম থাকার পরেও বাদপড়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে আবদুস সালাম ‘মনোনয়নবাণিজ্য’ করেছেন। দক্ষিণে প্রার্থী বাছাইয়ে সমন্বয় করেছেন আর উত্তরে মনোনয়নবাণিজ্যে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছেন। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কয়েকজন প্রার্থীর নাম সুকৌশলে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। জালিয়াতির এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান মনোনয়নবঞ্চিতরা।
তালিকায় নাম হেরফের বিষয়ে বাছাই কমিটির সদস্য উত্তর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান এ প্রতিবেদককে জানান, বাছাই কমিটির নেতা যে তালিকায় স্বাক্ষর করেছেন তা চূড়ান্ত। যদি পরে কোনো পরির্বতন করে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই সংশোধনী আসবে। এনিয়ে কোনো অনিয়ম হওয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে উত্তরের পাশাপাশি দক্ষিণের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্তকরণেও সালামের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বাছাই কমিটির সদস্যদের আপত্তির পরেও সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকার কারণে জোর করে অযোগ্যদের প্রার্থী করেছেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে সূত্রমতে, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফের বেয়াই ৫৯নং ওয়ার্ডে মো. আসলাম মোল্লা ছাড়াও ৫৩নং ওয়ার্ডে মীর হোসেন মিরু, ৫৪নং ওয়ার্ডে মো. মোজাম্মেল হোসেন ও ৬১নং ওয়ার্ডে মো. জুম্মন মিয়াকে প্রার্থী না করার জন্য বাছাই কমিটির সদস্যরা একমত হন। ওয়ার্ডগুলোতে যারা এমপি নির্বাচন করেছিলেন তাদের মতামত নেওয়া উচিত বলে সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় সদস্য আফরোজা আব্বাস মত দেন। কিন্তু তার কথা রাখেননি সালাম। এ নিয়ে কথা-কাটাকাটিও হয়। শেষ পর্যন্ত ড. মোশাররফের সুপারিশ অনুযায়ী তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে।