বিএনপিতে বাড়ছে অস্থিরতা, পদত্যাগ করছেন সিনিয়র নেতারা

  • আপডেট: ১১:২২:২১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৮ নভেম্বর ২০১৯
  • ২৯

অনলাইন ডেস্ক:

কারাবন্দি খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপিতে হঠাৎই অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তাতে বিদ্রোহের ‘আলামত’ও দেখা যাচ্ছে। সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান এবং মোরশেদ খানের পদত্যাগ যে একান্ত ব্যক্তিগত কারণ নয়, তা তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এবং সিনিয়র ও মধ্য সারির অনেক নেতাই রুষ্ট। দুই নেতা পদত্যাগের মাধ্যমে তা প্রকাশ করেছেন; আরও কয়েকজন সেদিকেই এগোচ্ছেন।

দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, তারেক রহমানের নানা কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্তে দলের সিনিয়র নেতারা ক্ষুব্ধ।

কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়- চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে রাজপথে দৃশ্যমান আন্দোলন কর্মসূচি না দেওয়া, খালেদা জিয়াকে ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ‘অকারণে’ মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়া ও দল পুনর্গঠনসহ দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিনিয়র নেতাদের অবজ্ঞা, সম্প্রতি অভিজ্ঞদের বাদ দিয়ে দুই নেতাকে স্থায়ী কমিটিতে নিয়োগ দেওয়া। এসব ক্ষোভের পাশাপাশি নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা ও মামলা-হামলা থেকে রক্ষা পেতেও কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, ‘দলে সব সময় সব কিছু আমার অনুকূলে থাকবে এটি ভাবা ঠিক নয়। প্রতিকূল অবস্থাও আসবে। এটি মোকাবিলা করাই রাজনীতি। যারা পদত্যাগ করছেন, তা ব্যক্তিগত স্বার্থে। এখানে আদর্শের কোনো বিষয় নয়। যেমন আমি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলাম। দল তখন আমার কথা শোনেনি, একসময় তো আমার কথা শুনতে পারে। ক্ষোভ প্রকাশ করে পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়।’

নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, বর্তমানের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রায় সবার। কিন্তু খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে দলের বিপদে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছেন না। বেইমান তকমাও লাগাতে চাইছেন না। ওই সব নেতা বলেন, অবস্থা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে পদত্যাগ করলে নেতাকর্মী ও দেশের মানুষের কাছে তাদের বেইমান হতে হবে। আবার যেভাবে দল চলছে, তাতে সম্মান নিয়ে রাজনীতি করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

নেতাদের কয়েকজন বলেন, জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রতি তারেক রহমানের অবজ্ঞা, তাদের গুরুত্ব না দেওয়া এবং নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে তারা খুবই ক্ষুব্ধ। তা ছাড়া ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তার নিজ বলয়ের বাইরে কাউকে গুরুত্ব দেন না, বরং নানাভাবে অপদস্থ করছেন।

জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির যৌথ নেতৃত্বে দলের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে তারেক রহমান এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। সেখানে কেউ যদি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওপর অহেতুক দোষ চাপান সেটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

অবশ্য সিনিয়র নেতাদের পদত্যাগে ‘অখুশি’ নন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার ঘনিষ্ঠরা জানান, তারেক রহমান মনে করেন, সিনিয়র অনেক নেতার মধ্যে রাজনৈতিক কমিটমেন্টের অভাব আছে।

জানতে চাইলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, মাহবুবুর রহমান ও মোরশেদ খান সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। মাহবুবুর রহমান সাবেক সেনাপ্রধান হওয়ায় সেনাবাহিনীতে তার মর্যাদা ও গুরুত্ব অনেক। চীনের সঙ্গে তার যোগাযোগ খুবই নিবিড়। মোরশেদ খানের সঙ্গে ভারত ও জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর যোগাযোগ বেশ ভালো। যারা দল ছেড়ে যাচ্ছেন অথবা যেতে চাচ্ছেন, দেশে ও বিদেশে তাদের গুরুত্ব পরিচিতি আছে। এভাবে তারা দল ছেড়ে গেলে তারেক রহমান ও দলের জন্য কোনো শুভ বার্তা নয়। শুধু নিজের লোক দিয়ে রাজনীতি হয় না, যোগ্য লোকেরও প্রয়োজন আছে।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলী ফালু, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, শোক রানার মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতা পদত্যাগ করেছেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বিএনপি ছাড়েন ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান, তারপর দিন দুই মাস আগে পদত্যাগপত্র দেওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানান মাহবুবুর রহমান।

চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোরশেদ খানকে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। এর পর দল পুনর্গঠনে তার অনুসারী নেতাকর্মীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এসব কারণেই তার ক্ষোভ। আমাদের সময়কে মোরশেদ খান বলেন, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দল যেভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল, এখন তা নেই। তার পরিবার ও দলের চাটুকাররা দলে বিভাজন তৈরি করছে। দলে গণতন্ত্র বলতে কিছু নেই।

মাস দুই আগে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে বিএনপি ছেড়েছেন দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান। কিন্তু বিষয়টি এ পর্যন্ত দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। কিন্তু গত বুধবার দৈনিক আমাদের সময়সহ গণমাধ্যমে মাহবুবুর রহমান নিজেই ফাঁস করে দেন।

দলীয় নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতারা জানান, দুই মাস আগে লন্ডনে এক সভায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের জাতির পিতা উল্লেখ করে উপস্থিত নেতাকর্মীদের কাছে প্রস্তাব করেন এবং তাদের সমর্থন চান। নেতাকর্মীরা তারেক রহমানের ওই প্রস্তাবে সমর্থনও দেন। এ বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠে এলে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে দেশের একটি গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন মাহবুবুর রহমান। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি দলের স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করেন গয়েশ্বরচন্দ্র রায়। এর সঙ্গে যুক্ত হন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান। ওই বৈঠকে মাহবুবুর রহমানকে অব্যাহতি দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার কাছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলামকে পাঠানো হয়। কিন্তু মাহবুবুর রহমান তার বক্তব্যের পক্ষে অনড় থাকার সিদ্ধান্ত দেন। এর পরই তিনি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে তার পদত্যাগপত্র দেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সূত্র জানায়, মাহবুবুর রহমান সব সময়ই তারেক রহমানের সরাসরি বিরোধিতা করতেন। গত জানুয়ারিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মাহবুবুর রহমান অভিযোগ করেন, একাদশ নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। যদি দলের নেতৃত্ব দিতে হয়, তারেক রহমানকে দেশে আসতে হবে। দেশে এসেই তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিদেশ থেকে দলের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে দলীয় ফোরামে বিভক্তি ছিল। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার বিরুদ্ধে দলীয় ফোরাম ছাড়াও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দেন গয়েশ্বরচন্দ্র রায়।

মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমি সেনাপ্রধান ছিলাম, আমি যা বলি তা তো ফেরত নিতে পারব না। তাই পদত্যাগ করেছি, সেটি অস্বীকারও করব না। দলে রাজনীতি বলতে কিছু নেই। তারেক রহমান বিদেশে বসে স্বেচ্ছাচারী করছেন। দলে গণতন্ত্র নেই। এভাবে একটি দল চলতে পারে না। তাই রাজনীতি থেকে সরে এসেছি।’

বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘একাদশ নির্বাচনের পর তারেক রহমানসহ বর্তমানে যারা দল পরিচালনার সঙ্গে জড়িত, তারা পদপদবি ধরে রাখতে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে দৃশ্যমান রাজপথে কোনো কর্মসূচি না দিয়ে গা বাঁচিয়ে চলছেন। এটি খালেদা জিয়ার প্রতি চরম অপমান।’

দীর্ঘদিন থেকে দল পরিচালনায় স্থায়ী কমিটির নেতা ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও হয় না। বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান আমাদের সময়কে বলেন, দলের কোনো সিদ্ধান্তই জানতে পারি না। প্রতিদিন শুনতে পাই নয়াপল্টনে স্কাইপে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে ডেকে ডেকে কথা বলেন। কী বলেন, কী সিদ্ধান্ত নেন তাও জানি না। দলে আছি কী নেই তাও জানি না। এ অবস্থায় চারদিকে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, বিএনপি থেকে ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার শাজাহান ওপর বীরউত্তম, মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বেশ কিছু সিনিয়র নেতা যে কোনো সময় পদত্যাগ করছেন। যদিও এসব নেতার মধ্যে বেশ কয়েকজনকে বৃহস্পতিবারের দলীয় কর্মসূচিতে দেখা গেছে।‘

আপনিসহ আরও বেশ কয়েকজন নেতা বিএনপি ছাড়ছেন এমন গুঞ্জন বিষয়ে’ আলতাফ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আরও অনেক সাংবাদিক আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। এর পর আমি নিজে থেকে অনেক নেতার সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই বলেছে এটি ভুয়া খবর।’

দলের মধ্যে যে ক্ষোভ বিরাজ করছে তা কীভাবে দূর করা সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্ষোভ দূর করা সম্ভব নয়; ক্ষোভের কারণ দূর করতে হবে।

সম্প্রতি এক মামলায় হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনি আদালত থেকে জামিনেও মুক্ত হন। এর পর এক অনুষ্ঠানে তিনি অভিযোগ করে বলেন, রিজভী (বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী) ছাড়া কেউ তার অথবা তার পরিবারের খোঁজ নেননি।

Tag :
সর্বাধিক পঠিত

‘ম্যানেজ করে’ এক সাথে দুই স্বামীর সংসার করছিলেন জান্নাতুল!

বিএনপিতে বাড়ছে অস্থিরতা, পদত্যাগ করছেন সিনিয়র নেতারা

আপডেট: ১১:২২:২১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৮ নভেম্বর ২০১৯

অনলাইন ডেস্ক:

কারাবন্দি খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপিতে হঠাৎই অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তাতে বিদ্রোহের ‘আলামত’ও দেখা যাচ্ছে। সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান এবং মোরশেদ খানের পদত্যাগ যে একান্ত ব্যক্তিগত কারণ নয়, তা তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এবং সিনিয়র ও মধ্য সারির অনেক নেতাই রুষ্ট। দুই নেতা পদত্যাগের মাধ্যমে তা প্রকাশ করেছেন; আরও কয়েকজন সেদিকেই এগোচ্ছেন।

দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, তারেক রহমানের নানা কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্তে দলের সিনিয়র নেতারা ক্ষুব্ধ।

কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়- চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে রাজপথে দৃশ্যমান আন্দোলন কর্মসূচি না দেওয়া, খালেদা জিয়াকে ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ‘অকারণে’ মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়া ও দল পুনর্গঠনসহ দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিনিয়র নেতাদের অবজ্ঞা, সম্প্রতি অভিজ্ঞদের বাদ দিয়ে দুই নেতাকে স্থায়ী কমিটিতে নিয়োগ দেওয়া। এসব ক্ষোভের পাশাপাশি নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা ও মামলা-হামলা থেকে রক্ষা পেতেও কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, ‘দলে সব সময় সব কিছু আমার অনুকূলে থাকবে এটি ভাবা ঠিক নয়। প্রতিকূল অবস্থাও আসবে। এটি মোকাবিলা করাই রাজনীতি। যারা পদত্যাগ করছেন, তা ব্যক্তিগত স্বার্থে। এখানে আদর্শের কোনো বিষয় নয়। যেমন আমি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলাম। দল তখন আমার কথা শোনেনি, একসময় তো আমার কথা শুনতে পারে। ক্ষোভ প্রকাশ করে পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়।’

নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, বর্তমানের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রায় সবার। কিন্তু খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে দলের বিপদে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছেন না। বেইমান তকমাও লাগাতে চাইছেন না। ওই সব নেতা বলেন, অবস্থা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে পদত্যাগ করলে নেতাকর্মী ও দেশের মানুষের কাছে তাদের বেইমান হতে হবে। আবার যেভাবে দল চলছে, তাতে সম্মান নিয়ে রাজনীতি করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

নেতাদের কয়েকজন বলেন, জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রতি তারেক রহমানের অবজ্ঞা, তাদের গুরুত্ব না দেওয়া এবং নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে তারা খুবই ক্ষুব্ধ। তা ছাড়া ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তার নিজ বলয়ের বাইরে কাউকে গুরুত্ব দেন না, বরং নানাভাবে অপদস্থ করছেন।

জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির যৌথ নেতৃত্বে দলের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে তারেক রহমান এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। সেখানে কেউ যদি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওপর অহেতুক দোষ চাপান সেটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

অবশ্য সিনিয়র নেতাদের পদত্যাগে ‘অখুশি’ নন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার ঘনিষ্ঠরা জানান, তারেক রহমান মনে করেন, সিনিয়র অনেক নেতার মধ্যে রাজনৈতিক কমিটমেন্টের অভাব আছে।

জানতে চাইলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, মাহবুবুর রহমান ও মোরশেদ খান সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। মাহবুবুর রহমান সাবেক সেনাপ্রধান হওয়ায় সেনাবাহিনীতে তার মর্যাদা ও গুরুত্ব অনেক। চীনের সঙ্গে তার যোগাযোগ খুবই নিবিড়। মোরশেদ খানের সঙ্গে ভারত ও জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর যোগাযোগ বেশ ভালো। যারা দল ছেড়ে যাচ্ছেন অথবা যেতে চাচ্ছেন, দেশে ও বিদেশে তাদের গুরুত্ব পরিচিতি আছে। এভাবে তারা দল ছেড়ে গেলে তারেক রহমান ও দলের জন্য কোনো শুভ বার্তা নয়। শুধু নিজের লোক দিয়ে রাজনীতি হয় না, যোগ্য লোকেরও প্রয়োজন আছে।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলী ফালু, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, শোক রানার মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতা পদত্যাগ করেছেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বিএনপি ছাড়েন ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান, তারপর দিন দুই মাস আগে পদত্যাগপত্র দেওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানান মাহবুবুর রহমান।

চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোরশেদ খানকে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। এর পর দল পুনর্গঠনে তার অনুসারী নেতাকর্মীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এসব কারণেই তার ক্ষোভ। আমাদের সময়কে মোরশেদ খান বলেন, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দল যেভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল, এখন তা নেই। তার পরিবার ও দলের চাটুকাররা দলে বিভাজন তৈরি করছে। দলে গণতন্ত্র বলতে কিছু নেই।

মাস দুই আগে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে বিএনপি ছেড়েছেন দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান। কিন্তু বিষয়টি এ পর্যন্ত দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। কিন্তু গত বুধবার দৈনিক আমাদের সময়সহ গণমাধ্যমে মাহবুবুর রহমান নিজেই ফাঁস করে দেন।

দলীয় নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতারা জানান, দুই মাস আগে লন্ডনে এক সভায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের জাতির পিতা উল্লেখ করে উপস্থিত নেতাকর্মীদের কাছে প্রস্তাব করেন এবং তাদের সমর্থন চান। নেতাকর্মীরা তারেক রহমানের ওই প্রস্তাবে সমর্থনও দেন। এ বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠে এলে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে দেশের একটি গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন মাহবুবুর রহমান। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি দলের স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করেন গয়েশ্বরচন্দ্র রায়। এর সঙ্গে যুক্ত হন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান। ওই বৈঠকে মাহবুবুর রহমানকে অব্যাহতি দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার কাছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলামকে পাঠানো হয়। কিন্তু মাহবুবুর রহমান তার বক্তব্যের পক্ষে অনড় থাকার সিদ্ধান্ত দেন। এর পরই তিনি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে তার পদত্যাগপত্র দেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সূত্র জানায়, মাহবুবুর রহমান সব সময়ই তারেক রহমানের সরাসরি বিরোধিতা করতেন। গত জানুয়ারিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মাহবুবুর রহমান অভিযোগ করেন, একাদশ নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। যদি দলের নেতৃত্ব দিতে হয়, তারেক রহমানকে দেশে আসতে হবে। দেশে এসেই তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিদেশ থেকে দলের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে দলীয় ফোরামে বিভক্তি ছিল। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার বিরুদ্ধে দলীয় ফোরাম ছাড়াও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দেন গয়েশ্বরচন্দ্র রায়।

মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমি সেনাপ্রধান ছিলাম, আমি যা বলি তা তো ফেরত নিতে পারব না। তাই পদত্যাগ করেছি, সেটি অস্বীকারও করব না। দলে রাজনীতি বলতে কিছু নেই। তারেক রহমান বিদেশে বসে স্বেচ্ছাচারী করছেন। দলে গণতন্ত্র নেই। এভাবে একটি দল চলতে পারে না। তাই রাজনীতি থেকে সরে এসেছি।’

বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘একাদশ নির্বাচনের পর তারেক রহমানসহ বর্তমানে যারা দল পরিচালনার সঙ্গে জড়িত, তারা পদপদবি ধরে রাখতে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে দৃশ্যমান রাজপথে কোনো কর্মসূচি না দিয়ে গা বাঁচিয়ে চলছেন। এটি খালেদা জিয়ার প্রতি চরম অপমান।’

দীর্ঘদিন থেকে দল পরিচালনায় স্থায়ী কমিটির নেতা ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও হয় না। বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান আমাদের সময়কে বলেন, দলের কোনো সিদ্ধান্তই জানতে পারি না। প্রতিদিন শুনতে পাই নয়াপল্টনে স্কাইপে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে ডেকে ডেকে কথা বলেন। কী বলেন, কী সিদ্ধান্ত নেন তাও জানি না। দলে আছি কী নেই তাও জানি না। এ অবস্থায় চারদিকে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, বিএনপি থেকে ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার শাজাহান ওপর বীরউত্তম, মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বেশ কিছু সিনিয়র নেতা যে কোনো সময় পদত্যাগ করছেন। যদিও এসব নেতার মধ্যে বেশ কয়েকজনকে বৃহস্পতিবারের দলীয় কর্মসূচিতে দেখা গেছে।‘

আপনিসহ আরও বেশ কয়েকজন নেতা বিএনপি ছাড়ছেন এমন গুঞ্জন বিষয়ে’ আলতাফ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আরও অনেক সাংবাদিক আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। এর পর আমি নিজে থেকে অনেক নেতার সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই বলেছে এটি ভুয়া খবর।’

দলের মধ্যে যে ক্ষোভ বিরাজ করছে তা কীভাবে দূর করা সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্ষোভ দূর করা সম্ভব নয়; ক্ষোভের কারণ দূর করতে হবে।

সম্প্রতি এক মামলায় হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনি আদালত থেকে জামিনেও মুক্ত হন। এর পর এক অনুষ্ঠানে তিনি অভিযোগ করে বলেন, রিজভী (বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী) ছাড়া কেউ তার অথবা তার পরিবারের খোঁজ নেননি।