মনিরুজ্জামান বাবলু
খাওয়া-দাওয়া হোটেলে মিষ্টিমুখ করে রওয়ানা হলাম। দুইশত কিলো মিটার পথ পাড়ি দিয়ে যেই গ্রামে পৌঁছলাম, সেই গ্রামের কারো সাথে দেখা হয়নি। কারণ তখন ভোর ৪টা। সফরসঙ্গীদের সিদ্ধান্ত নিয়েই পিছু হটলাম। কয়েকখানা দোকানের মধ্যে একটি খোলা পেয়ে মাইক্রোবাসটি রেখে সূর্য উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। সূর্য উঠার দৃশ্যটি মধুমতি নদীর উপর দাঁড়িয়ে দেখলাম। একখন্ড মেঘের আড়ালে লালবৃত্তটি সূর্য নাকি অন্য কিছু তা নিয়ে কয়েক বাক্য হয়ে গেল। সবাই বুঝলাম ঐ দিকটাই পূর্বদিক। সূর্য ধীরে ধীরে আলো ছড়ালো। ওই অঞ্চলের মানুষের ঘুম ভাঙ্গল। নির্জন ভোরে পাখির কলতান, যানবাহনের হুংকার, ভোরবিহণে শারিরিক ব্যায়ামে পথচলা অবলোকন করলাম। একটি সূর্য অন্ধকারকে ক্রমে দূরে ঠেলে দিয়ে জাগ্রত করল সকল জাতকূল, বর্ণ-বিবর্ণের জীব জাতিকে।
আর সেই জাতির সূর্য সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি হাজার বছরের বাঙ্গালী। তিনি বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি বঙ্গবন্ধু। তিনি জাতির জনক। তিনি গণতান্ত্রিক নেতা। তিনি রাজনীতিবিদ। তিনি বিশ্ব নেতা। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি। তিনি গণতন্ত্রের মানসকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা।
ভোরের সূর্য তেজস্ক্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে- সেই সূর্য সন্তানের সমাধিস্থলে একঝাঁক শিক্ষা গঠনের কান্ডারী হাজির হতে শুরু করলো। তাঁরা সবাই বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলো। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে, ওইখানে কোন দাবি নিয়েও তাদের যাওয়া হতো না।
বঙ্গবন্ধুর গাঁ। গাঁ অর্থাৎ টুঙ্গীপাড়া গ্রাম। ভোর ৪টায় মধুমতি নদীর উপর নির্মিত শেখ লুৎফুর রহমান ব্রিজটি সংলগ্ন দোকানে বসলাম। মহল্লার কয়েকজনের সাথে পরিচয় হয়। রাজনীতি নিয়ে কথা শুরু করে দিলাম। দোকানী বলে দিল- তার নানা নিজ হাতে শেখ মজিবুর রহমানের মৃতদেহকে কাপড় কাঁচার সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে ছিলেন। দোকানীর নানাও কয়েক বছর পূর্বে মারা গেছেন। ওই এলাকায় অন্য দলের কী অবস্থা জানতে চাইলে দোকানীসহ সবাই বলে দিল- এই এলাকায় আওয়ামী লীগ ছাড়া কোন দল নেই, কমিটিও হয় না। সবাই শেখ পরিবারের ভক্ত। ১৯৯১ সালে শেখ হাসিনার সাথে অমূল্য সেন নামের এক বিএনপি সমর্থক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। তখন বিএনপির প্রার্থী মাত্র ১১’শ ভোট পেয়েছিল।
দোকানী বলল- ‘আমাগো পদ্মা সেতুটা হইলে, ঢাকায়ও অন্য দলের কমিটি থাকবে না। মনে রাইখেন। তখন আমরা লাঠি লইয়া দৌড়াইয়া যামু।’
ষাটোর্ধ্ব এক বাসিন্দা বললেন, তখন তাঁর বয়স ১৬ কিংবা ১৭ ছিল। কয়েকজন আর্মি শেখ সাহেব কে হেলিকাপ্টারে করে নিয়ে আসলেন। কাউকে সেখানে জমায়েত হতে দেয়নি। যারা যারা দেখার দেখেই চলে আসতো। শেখ মুজিবুর রহমানের দাফনের কাজ শেষ করার কয়েক বছর পর মিলাদ শরীফ পড়া হয়। তখন সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। প্রতিবাদের ভাষা হারিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলের প্রথম গেইট দিয়ে ঢুকতেই দায়িত্বরত প্রহরীরা আমাদের চেকিং করে নিলো। তারপর আর নিরাপত্তা বাহিনী তেমন নজর পড়েনি। পরে জানতে পারলাম সিসি ক্যামেরায় সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা হয়। আর থানা পুলিশ ও সেনা ক্যাম্পসহ পর্যাপ্ত আইনশৃংখলা বাহিনী রয়েছে। চোখ জুড়ানো সমাধিস্থলে মাত্র কয়েক বছর হলো- কারুকাজ শুরু হয়। যেই ভূমিতে এই মহান নেতা জন্ম নিয়েছিলেন, সেই ভূমি এখন স্মৃতিময় ফ্রেমে বাঁধা শত ছবি ঝুলে আছে। যেই পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করতেন, সেই পুকুর পাড়ে এখন দর্শনার্থীদের বিশ্রামাগার।
যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে আঁতকে দিয়েছে, তা কল্পনা করা দায়। লক্ষ তরুণও বিশ্বাস করবে না_ এমন একটি অজঁপাড়া গ্রাম থেকে জাতির জনক হওয়ার গল্প। যেই অঞ্চলের চারপাশেই নদীতে ঘেরা। পশ্চিমে মধুমতি, দক্ষিণে গৌরিনদী, পূর্বে পদ্ম-মেঘনা, উত্তরে বাইগার নদী। সমাধিস্থলের প্রবেশকালে সফরসঙ্গী সহকর্মী বড় ভাই মোহাম্মদ শাহাজাহান বললেন_ ‘যে যত কথাই বলুক, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে- দেশ স্বাধীনতা পেতো না।’
বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলে গিয়ে গোপালগঞ্জ বাসিন্দাদের জীবনমানের চিত্র দেখার সৌভাগ্য হয়ে উঠেছে। ২০১৫ সালে বছরের ২৪ জানুয়ারি মধুমতি নদীর উপর শেখ লুৎফুর রহমানের নামকরণে একটি ব্রিজ করা হয়েছে। সড়কটি নতুন করে সংস্কার করা হয়। টুঙ্গীপাড়া গ্রামের শেখ বাড়ির সামনে দিয়ে পাকা সড়কটিও বেশি দিন হয়নি। সামাধিস্থলের প্রায় আধা কিলো মিটার পূর্বে আগমনী দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হয়েছে। পাশে নির্মিত হচ্ছে ব্যয় বহুল ও নয়নাভিরাম শিশু পার্ক। সমাধিস্থলের প্রায় তিন কিলো মিটারের আশপাশে একটি মাত্র খাবার হোটেল। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার নেই আগের মতো। কোটালিপাড়া বাজারে একটি মাত্র পাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। উনিশ শতকের দেশ ও জাতির কর্ণধার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মভূমির আশপাশ এলাকায় এখনো পোঁছায়নি গ্যাস। কিছু কিছু বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। নতুন সংযোগের কাজ চলছে। চলাচলের জন্য তিন চাকার ভ্যান বেশ জনপ্রিয়। নেই রিক্সা কিংবা অটোচালিত সিএনজি। উত্তরাঞ্চলের কালে-কালে নেতা সৃষ্টি হয়েছে, তবে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সেভাবে গড়ে উঠেনি। জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে বিভোর পরিশ্রমি যে মানুষটি জীবনের সিংহভাগই কাটিয়েছেন জেলখানায়, সেই মানুষটির জন্মভূমি জাতির কাছে কিনা প্রত্যাশা করতে পারেন।
বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলে যাবার কয়েক মাস পূর্বে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটির কয়েক পাতা পড়লাম। সেখান থেকে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর প্রথম জীবনে জেল খেটেছিলেন সাতদিন। এক হিন্দু সমপ্রদায়ের যুবককে মারধরের অভিযোগে। সেই মারামারির সূত্রপাত ইংরেজ বিরোধী বাগ-বিতন্ডা নিয়ে। গ্রামের আই এস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করার পর গোপালগঞ্জ জেলা সদর ও মাদারীপুরে পড়ালেখা করেছিলেন। মাদারীপুরে স্কুলে পড়াকালীন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায় মিছিল মিটিংয়ে যাওয়া শুরু করেন। গ্রামের বাড়ীতে ভলিবল,ফুটবল খেলতেন।
এ সমাধিস্থল গোপালগঞ্জ জেলা সদর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক এ সমাধিস্থলে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় জমে। স্থানীয় বাসিন্দরা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান টুঙ্গীপাড়া গ্রাম এখন নবালোকে উদ্ভাসিত একটি জনপদ। টুঙ্গীপাড়াকে বদলে দিয়েছে এই সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স। প্রতিদিন দেশ-বিদেশরা আসেন প্রিয় নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। গ্রামটি পাটগাতী ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে হলেও গ্রামের নামেই উপজেলা সদরের নাম হয়েছে টুঙ্গীপাড়া। এই টুঙ্গীপাড়াতেই ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে মত্যুহীন প্রাণ নিয়ে জন্মমাটি টুঙ্গীপাড়ায় ফিরে আসেন তিনি। পরদিন পারিবারিক কবরস্থানে মা-বাবার পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯৯ সালের ১৭ মার্চ সমাধিসৌধের নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ৩৮.৩০ একরজমির ওপর ১৭ কোটি ১১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয়ে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সহযোগিতায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এ সমাধিসৌধ নির্মিত হয়।
লাল সিরামিক ইট আর সাদা-কালো টাইলস দিয়ে গ্রিক স্থাপত্য শিল্পের আদলে নির্মিত সৌধের কারুকার্যে ফুটে উঠেছে বেদনার চিহ্ন। কমপ্লেক্সের সামনের, দু’পাশের উদ্যান পেরোনোর পরই বঙ্গবন্ধুর কবর। পাশেই তার বাবা-মায়ের কবর। এই তিন কবরকে ঘিরেই নির্মাণ করা হয়েছে মূল টম্ব। সাদা পাথরে নির্মিত গোলাকার এক গম্বুজ বিশিষ্ট সমাধিসৌধের ওপর দেয়ালে জাফরি কাটা। এই জাফরি কাটা দিয়েই সূর্যের আলো আসে। উপরে কাচের কারুকাজ দিয়েও আলো ছড়িয়ে পড়ে কবরে। চারদিকে কালো টাইলস ও মাঝখানে শ্বেতশুভ্র টাইলসে বঙ্গবন্ধুর কবর বাঁধানো। উপরের অংশ ফাঁকা। কবর তিনটি ঘিরে রাখা হয়েছে সংক্ষিপ্ত রেলিং দিয়ে। সমাধির প্রবশে মুখে দায়িত্বরত প্রহরী হুঁশিয়ারি করে দিলেন- কবরের ছবি তোলা যাবে না। তারপরও কে শুনে কার কথা। এমন স্মৃতিবিজড়িত স্থানে ডিজিটাল যুগ ছবি না তুলে পারিনি। সফরসঙ্গী ভাতিজা পাপ্পু মাহমুদকে দিয়ে মুঠোফোনে কয়েকখানা ছবি তুলে নিলাম।
২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকন্যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সমাধিসৌধের উদ্বোধন করেন। কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, প্রদর্শনী কেন্দ্র, মসজিদ, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ক্যাথেটেরিয়া, উম্মুক্ত মঞ্চ, বকুলতলা চত্বর,স্যুভেনির কর্নার, প্রশস্তপথ, মনোরম ফুলের বাগান ও কৃত্রিম পাহাড়।
এই কমপ্লেক্স পাঠাগারে ১২৭৮টি বই (১৬ অক্টোবর শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত) রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা ও শেখ হাসিনার লেখা বই রয়েছে। গোপালগঞ্জ জেলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বড় দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন আকর্ষণ টুঙ্গীপাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধ। এছাড়া আরো রয়েছে অন্যান্য নিদর্শন।
ছায়া-সুনিবিড়, তরুলতা ঘেরা, সবুজ শ্যামল ছোট্ট গ্রাম টুঙ্গিপাড়া আজ বাঙালি জাতির তীর্থস্থান। যাঁর জন্য টুঙ্গিপাড়া গ্রাম আজ জগৎ বিখ্যাত হয়ে আছে। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এ গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন। নদী ও প্রকৃতির প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর অগাধ ভালবাসা। এ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মধুমতি নদীতে শৈশবে তিনি সাঁতার কাটতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছুসংখ্যক বিপথগামী সেনা অফিসারের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এখানে শেষ শয্যায় সমাহিত করা হয়। প্রতি বছর ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুঙ্গীপাড়ায় যান।
পুকুরের চারপাশে ছায়াঘেরা পরিবেশে বসে বিশ্রাম নেয়ার জন্য রয়েছে বেঞ্চ। একটু সামনে গেলেই চোখে পড়বে সমাধি সৌধ ও দৃষ্টিনন্দন ঝর্ণা, সমাধি সৌধের পশ্চিম পার্শ্বে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত শৈশবের স্মৃতি ঘেরা পৈত্রিক ভিটা ও বাড়ী। যা শুধু কালের সাক্ষী হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল থেকে ফেরার পথে সফর সঙ্গী শিক্ষক শ্যামল কৃষ্ণ সাহার ইচ্ছাটুকুন পূরণ করতে বরিশালের গৌরনদী উপজেলা শহরের সু-স্বাদু দই খেলাম সবাই।
লেখক পরিচিতি- গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মী।
০১৭৫৬৪৬৯৫০৫