—–গাজী মহিনউদ্দিন——
অমূল রতন “মা” অতি আপন একটি মধুময় উচ্চারণ। মা জননী হলো বটবৃক্ষের ছাড়া। সন্তান যতোই অন্যায় অপরাধ করুক মায়ের আঁচল সব সময় সন্তানের জন্য উন্মুক্ত ছাড়া দান করে। মা যে কি একটি মধুর উচ্চারণ যার মা নেই সেই বুঝতে পারে।
পৃথিবীতে নতুন অতিথি হিসেবে আসার পর পরই যে মানুষটির মুখ প্রথম দেখতে পাই, সেইজন জনম দুঃখিনী মা। জন্ম থেকে শুরু করে বুঝে ওঠার আগ পর্যন্ত মা জননী সন্তানের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেন। শুধু পরিশ্রম নয়, সন্তানের সুখ-দুঃখ বেদনায় সবার আগে মায়ের হৃদয়টা নাড়িয়ে দেয়।
যেজন দেখালে পৃথিবীর আলো, দুঃখ কষ্টে লালন করেছেন, অবুঝ খোকা কে বুঝার পথে পৌঁছে দিয়েছেন, নিজের মুখে আহার তুলে দিয়েছেন সন্তানের মুখে, সন্তানের প্রসাবের ভিজা স্থানে নিজে ঘুমিয়ে শুকনো কাঁথায় ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন, ঘুম পাড়ানি মাসি ফিসির গান গেয়ে মাথায় হাত বুলিয়েছেন। দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে যে জন মোদের জোৎসনা রাতে চাঁদের ছায়া, সোনালী রোদের ঝিলমিল আলো দেখিয়েছেন তিনি হলেন “মা”।
পৃথিবীতে ‘মা’ শব্দটির মত মধুর ডাক মনে হয় আর কোনটি নেই। যে জন সন্তানের মুখ থেকে মা শব্দটি শুনলে উদার মনে দু’হাত তুলে বিধাতার নিকট সন্তানের আর্শিবাদ কামনা করেন। আর সে সন্তান কী মাকে একদিনে ভালোবাসা দিয়ে সকল গ্লানি মুছে দিতে পারে? এক দিনের ভালবাসায় সন্তানকে কাছে পেয়ে কি আর মায়ের দুঃখ গুটে যাবে! সভ্যতা আর সংস্কৃতির বৈপ্লিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের আচরণের যে পরিবর্তন ঘটেছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিবেক কে উল্টো-পথে নিয়ে গেছে। যাদের জন্যে আমরা দুনিয়ার আলো দেখতে পাই। তাদের বাধক্যে এসে নিন্মজ্জ্বিত জীবনের পথে ঘুরে বেড়াতে হয়।
বিশ্ব মা দিবস ১০ মে। তা সবার জানার কথা থাকলেও অনেক সময় অজানায় রয়ে যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে মূলবান রত্ম যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। যার মূল্য নির্ধারন করার মত পৃথিবীতে কোন অর্থ নেই বললেই চলে। জন্মের আগে এবং পরে যে জন সব চেয়ে বেশি কষ্ট দুঃখ, ক্ষুধা নিদ্রা শত পরিতাপের মধ্য দিয়ে সন্তানের কল্যান কামনা করেছেন। সে জনম দুখিনী মা যার শান্তি-ক্লান্তি নেই, বিরাম নেই, আছে শুধু সন্তানের জন্য মায়াময় ভালবাসা। মা দিবস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না অনেক জননী, শুধুই জানের সন্তানকে কাছে পেলেই সকল গ্লানি মুছে যাবে। অনেক মা আছে যে এখনো জানেন না যে মা দিবস আছে এবং বছরের একটি দিন দুনিয়ার সকল মা-দের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য উৎসর্গ করা হয়।
যখনই কোন হতভাগিণী মহিয়সী জানতে পারেন একটা মাত্র দিন মাকে স্মরণ করার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে: তখনই দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ভাবেন “১০ মাস কষ্ট করে মাত্র ১ দিন সন্তানদের ভালবাসা পাওয়া অধিকার”? সত্যি কথা বলতে কি নিজেদের মধ্যেও যে খুব কষ্ট দায়ক যন্ত্রনার জন্ম দেয়। মাকে শুধু নির্দিষ্ট একটা দিনে খুব বেশী ভালোবাসবো এই ধরণের চিন্তা আমাদের মাথায় ঠিক নয়। যার কারণে পৃথিবীতে আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছিলাম; সুন্দরের অবলোক করে, নতুন জীবনে সৌরভের বাগান সাজিয়ে তোলবো। আর মা যদি কষ্ট সাধন না করতেন তাহলে কি আমরা পৃথিবীর আলো দেখতে পেতাম না। এক্ষেত্রে আমাদের অসামাজিক বা আনসফিস্টিকেটেড বললে খুব একটা ভুল হবে বলে আমি মনে করিনা। কারণ আমার যেটুকু কষ্ট হয়েছে তাতো হয়েই গেছে, কথাটা শুনলে মা আরো বেশী কষ্ট পাবেন। ৩৬৫ দিন একত্রে করেই একটি বছর গুনা হয়।
বছরের প্রতিটি দিনই আমাদের জন্য কল্যাণকর। বছরের প্রতিটি দিনই আমরা রীতিমত মাকে স্মরণ করা যায়। সারা বছর মায়ের কোন খোঁজ না নিয়ে বছরের একটি দিন মাকে স্মরণ করলে তা একজন মায়ের কাছে মনে হবে কষ্টদায়ক। নিভানো তুষের আগুনে যখন বাতাসের স্পষ্টতা পেয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে, ঠিক মায়ের কাছে তখন হারিয়ে যাওয়া অতীতের স্মৃতি নাড়া দিয়ে উঠবে। আর তখনি মা আগের তুলনায় একটু বেশি কষ্ট অনুভূতি অনুভব করবেন। এক দিনের ভালবাসায় তখন মন ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে। আর তখনি সন্তান জন্মলাভের যন্ত্রনার চেয়েও বেশি যন্ত্রনা ভোগ করবেন।
ভাষাবিজ্ঞান অনুযায়ী মা শব্দের ব্যুৎপত্তি আমার জানা নেই, তবে মা দিবসের পটভূমি ঘাটতে গিয়ে যা দেখলাম তাতে মনে হলো মা শব্দটির শিকড় হলো দেবী। প্রাচীন মিশরে ইসিস নামক এক দেবীর পূজা করা হত যিনি ছিলেন মিশরের প্রথম ফারাও হোরাস এর জননী। এই দেবী ইসিস-কে প্রাচীন রোমে বলা হত সিবিল এবং গ্রীকরা তাকে রিয়া নামে পূজা করত।
কিন্তু আমাদের আধুনিক মা দিবস এসেছে ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় সন্তানদের হারানোর পর জুলি ওয়ার্ড নামক এক মহিলা সকল মা-দের একত্রিত করেন। এজন্য যে, যাতে কোনো মায়ের সন্তান যেন অন্য মায়ের সন্তানদের হত্যা না করে। তিনি ৪ জুলাই মা দিবস পালনের প্রস্তাব রাখেন। তার প্রস্তাবনা বিবেচনা করে ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে ২ জুলাই আমেরিকার ১৮টি অঙ্গরাজ্যে মা দিবস পালন করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই এই আয়োজন স্তিমিত হয়ে যায়।
মা দিবস পালনের সবচেয়ে কার্যকারী উদ্যোগ নেন এ্যানা এম জারভিস। তার মা এ্যানা রিভস জারভিসের মৃত্যুর পর মাকে সম্মান জানানোর জন্য মা দিবস পালনের জন্য গির্জায় একটি দরখাস্ত জমা দেন। ৮ মে ১৯০৮ এ তার আবেদন মঞ্জুর করা হয় এবং তখন থেকেই এই দিন এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আমরা যে ধরণের মা দিবস পালন করি তা হল যে কোন মহান দিবস পালনের যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্করণ। আর সব দিবসের মত এতেও তারা বস্তুবাদের কালিমা লেপন করতে বাদ রাখেনি। মা দিবস পালনের সাধারণ পাশ্চাত্য ধারা হল বছরের একটি দিনে বৃদ্ধাশ্রম এ রাখা বুড়ো, অথর্ব মায়ের জন্য কিছু ফুল, এক বাক্স চকোলেট নিয়ে তাদের সাথে সারাদিন কাটিয়ে পরের বছরে একই দিনে দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া নিঃসঙ্গ, অসহায় মা’রা বহুদিন পর তাদের সন্তানদের দেখতে পেয়ে যে পরিমাণ খুশি হন তাতে সারা বছর দেখা না করার কষ্টটা কিছুক্ষণের জন্য বিলীন হয়ে যায়। চকোলেট ও কার্ড কেনা-বেচার দিক দিয়ে মা দিবস-এর অবস্থান ভালোবাসা দিবসের ঠিক পরে। সুতরাং সন্তানরা তাদের মায়েদের প্রতি কতটুকু কর্তব্য পালন করে জানিনা, তবে দেশের অর্থনীতিতে যে সক্রিয় ভূমিকা রাখে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
জন্মদাত্রী হিসেবে আমার, আপনার, সকলের জীবনে মায়ের স্থান সবার ওপরে। তাই তাঁকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানানোর জন্য একটি বিশেষ দিনের হয়ত কোনো প্রয়োজন নেই। তারপরও আধুনিক বিশ্বে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটিকে ‘মা দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে, যার সূত্রপাত ১৯১৪ সালের ৮ই মে থেকে। সঙ্গে উপহার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সাদা কার্নেশন ফুল। সমীক্ষা বলছে, বছরের আর পাঁচটা দিনের তুলনায় এদিন অনেক বেশি মানুষ নিজের মাকে ফোন করেন, তাঁর জন্য ফুল কেনেন, উপহার দেন। আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, মায়েদের কি আলাদা করে কোনো উপহারের প্রয়োজন প্রয়োজন? তাঁরা যে সন্তানের মুখে শুধুমাত্র ‘মা’ ডাক শুনতে পেলেই জীবনের পরম উপহারটি পেয়ে যান।
কোনো মা, তা তিনি যে পেশাতেই থাকুন না কেন, যত কুশ্রীই হন না কেন, সন্তানের কাছে তিনি কিন্তু দেবীর মতোই। আর শুধু হিন্দু ধর্মে কেন? ইসলামে ‘মায়ের পায়ের নীচে বেহেস্ত’ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। খ্রিষ্টধর্মেও রয়েছে ‘মাদার মেরির’ বিশেষ তাৎপর্য। সেই মায়ের জন্য কিনা বছরে একটা মাত্র দিন!
তবে এ রীতিকে বোধহয় একেবারে তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয়। অন্তত একটা দিন তো মায়ের কথা, তাঁর সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা ভাবেন বিশ্ববাসী। সে কারণেই এটাকে আমার অনেকটা হিন্দুদের পুজো-আচ্চার মতো মনে হয়। এই যেমন, বৈদিক, সনাতন বা হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বাড়তি প্রতিদিন নানা দেব-দেবীর পুজো হলেও, বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ বিশেষ দেবতার পুজোও হয় আলাদাভাবে, ঘটা করে। এই ‘বিশ্ব মা দিবস’ ঠিক তেমনই নয় কি?
আসলে কেন জানি না লোকদেখানো, অহেতুক আড়ম্বর, ঘটা করে কিছু করা তেমন ভালো লাগে না আমার, বিশেষ করে সেটা যদি নিজের জন্মদাত্রী মায়ের জন্য হয়। আজকাল কত ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধুকে দেখি মায়েদের অযতœ করতে, তাঁদের অবহেলা করতে। তখন খুব খারাপ লাগে। যে মা-বাবা আমাদের আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছে, কথা বলতে শিখিয়েছে, মুখে তুলে দিয়েছে অন্ন, সেই বাবা-মা বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে, তাঁদের হাতে গড়া সন্তানটি ছোটবেলার কথা ভুলে বাবা-মা কে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।
কিন্তু নিজের মায়ের বেলায়? বেঁচে থাকতে কতদিন, কতবার তাঁকে আদর করেছি আমরা? কতবার বলেছি ‘মা, তোমায় ভালোবাসি’? জীবনচক্রের ঘূর্ণন শুরু হয় সেই জন্মলগ্ন থেকে। এরপর ছোটবেলা কাটিয়ে উঠে কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্বে, বার্ধক্য, আর সবশেষে অনিবার্য মৃত্যু৷ এই ধ্রুব সত্য শুধু আপনার-আমার নয়, সবার জন্য। তাই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিন৷ যতদিন ‘মা’ বেঁচে আছেন, ততদিন, প্রতিটি দিন পালন করুন ‘মা দিবস’ হিসেবে।
লেখক: সাংবাদিক ও সমাজকর্মী