• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২২ মার্চ, ২০২০
সর্বশেষ আপডেট : ২২ মার্চ, ২০২০

মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম: অকুতোভয় এক মুক্তিযোদ্ধা

অনলাইন ডেস্ক
[sharethis-inline-buttons]

শৈশবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গভীর ছাপ ফেলে তার মনে। মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারব না এই বোধ শিশুহৃদয়ে যে দ্রোহের আগুন জ্বালে, তা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পথ করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে তাঁকে দু’বার ভাবতে হয়নি। ৯ মাস বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাংলার মুক্ত আকাশে উড়িয়েছেন লাল-সবুজ পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের ১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম প্রিয় পদরেখার এবারের ব্যক্তিত্ব। লিখেছেন- সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি – সিরাজুল ইসলাম আবেদ

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে ছিনিয়ে নিয়ে আসে বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এবং নিজস্ব পতাকা। আর এ জন্যই মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। ১৯৭১ সালের মার্চে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ঢাকায় যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করছিল, তখন চট্টগ্রামে একজন আত্মপ্রত্যয়ী বীর অসীম সাহস আর বিচক্ষণতার সঙ্গে বাঙালি সৈন্যদের নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন আসন্ন যুদ্ধের মুখোমুখি হতে। তিনিই তৎকালীন চট্টগ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) অ্যাডজুট্যান্ট মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম। ‘শুধু আমি না, আমার মতো অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন এটি আলোচনার নামে কালক্ষেপণ। যুদ্ধ আসন্ন। এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে পাকিস্তানি সৈন্যের ওপর আগেই আক্রমণ করতে হবে।’- বলছিলেন রফিকুল ইসলাম। তাঁর ভাবনাই সত্য হয়েছিল। দু-একজনের অসহযোগিতার মুখেও তিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিপক্ষের ব্যাপক ক্ষতি করে ২ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। কীভাবে সম্ভব হয়েছিল এটি, কোথায় পেয়েছিলেন এই অকুতোভয় মনোবল? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের শুরু করতে হয় মেজর রফিকের শৈশব থেকে।

শৈশবের আশ্চর্য বিদ্রোহের অগ্নিশিখা

মেজর রফিকের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার নাওড়া গ্রামে। বাবা আশরাফ উল্লাহ এবং মা রহিমা বেগম। তিন ভাই ছয় বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। পড়াশোনার শুরু নিজ গ্রাম নাওড়া স্কুল থেকে। বাবা ছিলেন স্কুল ইন্সপেক্টর। বাবার বদলির চাকরি সূত্রে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায়, গোপালগঞ্জ মডেল স্কুল, পালং (বর্তমান শরীয়তপুর), কুমিল্লার চান্দিনা স্কুল হয়ে ও ১৯৫৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা মডেল হাই স্কুল থেকে অঙ্কে লেটার মার্ক নিয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন।

সেই সময়ের স্মৃতি টেনে বললেন, ১৯৪৮, ‘৪৯, ‘৫০ সময়কালে আমরা পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় ছিলাম। বিচ্ছিন্ন একটা অঞ্চল ছিল এই ভাণ্ডারিয়া। সপ্তাহে একটি বা দুটি স্টিমার যেত। ঘাট না থাকায় স্টিমার থেকে নৌকায় করে তীরে আসতে হতো। সেই সময়ের একটা স্মৃতি বেশ মনে পড়ে। রাত ৮টার দিকে ভূমিকম্প হলো। নদীর পানি ফুলে পাঁচ-ছয়শ’ গজ দূরে থাকা আমাদের বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছিল। বেশ মনে আছে, আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। এর কিছুদিন পর বাবা সেখান থেকে বদলি হয়ে এলেন গোপালগঞ্জ। মধুমতী নদীর পাড়েই ছিল গোপালগঞ্জ শহর। তখনকার দিনে গোপালগঞ্জ ছিল অত্যন্ত সুন্দর এক শহর। নদীর পাড়ে চারটি বাঁধানো ঘাট ছিল। পাশ দিয়ে ছিল কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি। খুব ভালো লাগত শহরটাকে। আমি মডেল স্কুলে ভর্তি হলাম। প্রথমে থাকতাম ব্যাংকপাড়া। পরে চলে যাই থানাপাড়ায়।

সব কিছু যেন ছবির মতো মেজর রফিকের সামনে এসে ধরা দেয়। আশ্চর্য সুন্দর শৈশব।

তবে একটা ঘটনা তাকে আমূল পাল্টে দেয়। আবার শুরু করেন তিনি,- তখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছে। আমি আব্বাকে বলেছিলাম, এই আন্দোলন কী নিয়ে? আব্বা সহজ করে বললেন, তুমি আর বাংলায় কথা বলতে পারবে না। উর্দুতে কথা বলতে হবে। কথাটা শুনেই মনটা কেমন করে ওঠে। আমি আমার ভাষায় কথা বলতে পারব না! এটা যারা করছে তারা কারা। সবার অলক্ষ্যে শিশু রফিকুল ইসলামের মধ্যে বিদ্রোহের অগ্নিশিখা সেদিনই জ্বলে ওঠে। সেই অগ্নিশিখাই পরবর্তী সময়ে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত করে। মেজর রফিক যুক্ত করেন, সেনাবাহিনীতে যাওয়ার যে চিন্তা-চেতনা সেটার পেছনেও কাজ করেছে এই বিদ্রোহী মন।

ভাষা আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ

১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে যখন তুমুল আন্দোলন চলছে, বঙ্গবন্ধু তখন জেলে থেকে এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে গেছেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে মহিউদ্দিন আহমেদকে সঙ্গে করে অনশন শুরু করেন। টানা ১৪ দিন অনশন করে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে স্বাস্থ্যগত কারণে ফরিদপুর জেল থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর থেকে পরিবারের সদস্যরা গোপালগঞ্জ নিয়ে আসেন। ওই খবর পেয়ে শহরের অনেক মানুষ তাকে স্বাগত জানাতে গিয়েছিল। আবার শুরু করেন তিনি,- আমার স্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে আমিও সেদিন বঙ্গবন্ধুর হাতে ফুল দিয়ে স্বাগত জানাই। তিনি খুব খুশি হয়ে আমাদের মাথায় হাত দিয়ে আদর করেছিলেন। শৈশবের এই স্মৃতি একটা ঐতিহাসিক ঘটনা এবং সারাজীবন আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে রয়েছে। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। রাতে ডিবি পুলিশের লোক বাসায় এসে আব্বাকে জানায়, ‘যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা তার ছেলেমেয়ে এসব মিছিল-টিছিলে যায় বা শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে, তাহলে গভর্নমেন্ট তাকে চাকরিতে রাখবে না।’ এই হুমকির পরও বাবা আমাকে নিষেধ করেননি। বরং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই সময় আব্বার পরিচয় হয় এবং এটা পারিবারিক সম্পর্কে গড়ায়। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই ১৯৭১এ আবার যোগাযোগ হয়।

সংক্ষিপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্র রাজনীতি

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্সে পড়াশোনা করেন। ওই সময় শরীফ কমিশন শিক্ষানীতি প্রকাশ করলে এর বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। গর্বের সঙ্গেই বললেন, আমিও সে আন্দোলনে ছিলাম। আমি তখন ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্ট ইউনিয়ন করতাম। আজকে যেটা বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো- আমরা সবাই একসঙ্গে ছিলাম। এখন যেটা শহীদুল্লাহ হল, তখন সেটা ছিল ঢাকা হল। আমি ওই হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। আমাদের এই আন্দোলনের ফলে আইয়ুব খান তখন হামুদুর রহমানকে দায়িত্ব দিলেন, এটা রিভিউ করে একটা রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। তিনিও শরীফ কমিশনের মূলধারা ঠিক রেখেই রিপোর্ট দিলেন। এতে আন্দোলন আরও বেগবান হলো। একটা জিনিস আমরা বুঝেছিলাম, এই রিপোর্ট বা নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে ধনীর ছেলেমেয়েরাই শুধু উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারবে। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে পশ্চিমারাই এ দেশে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে। এটাই ছিল এই রিপোর্টের অন্তর্নিহিত চক্রান্ত। সুতরাং আমরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলাম।

সব ছেড়ে সেনাবাহিনীতে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও তার আঁচ রয়ে গিয়েছিল তার পরের দশকগুলোতে। মেজর রফিক বলেন, আমি বিভিন্ন দেশের যুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস পড়া শুরু করলাম। সেগুলো পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম এবং সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে একটা জিনিস অনুধাবন করি, দেশের জন্য কিছু করতে হলে শক্তির প্রয়োজন। শক্তি ছাড়া আমরা টিকে থাকতে পারব না। এই শক্তি সামরিক শক্তি। যুদ্ধের কৌশল শিখতে হবে। তা না হলে দেশকে স্বাধীন করা যাবে না। তাহলে আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে। কৌশল শিখতে হবে। এই ভাবনা থেকেই বাবার অমতেই সেনাবাহিনীতে আবেদন করি।

পূর্ব পাকিস্তানের ৮ থেকে ৯ হাজার প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ৮ জন নির্বাচিত হয়। তার অন্যতম ছিলেন মেজর রফিক। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান আর্মিতে যোগ দেওয়ার পর ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান আর্মির ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন লাভ করেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়লে তাঁকে আর্টিলারি কোরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে তিনি লাহোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে তার ইউনিট ‘২৪ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট’সহ যশোর ক্যান্টনমেন্ট আসেন এবং রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্টের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ডেপুটেশনে দিনাজপুরে ৮ উইং ইপিআরের অ্যাসিস্ট্যান্ট উইং কমান্ডার নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের চট্টগ্রাম হেডকোয়ার্টারে অ্যাডজুট্যান্ট পদে যোগ দেন। প্রতিটি স্থানেই তিনি বাঙালি অফিসার, জওয়ান এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে নিজেদের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি এবং চেতনা নিয়ে গোপনে কাজ করেন। বিপদেও পড়েছেন একাধিকবার। কিন্তু ‘ভালো অফিসারের সুনাম এবং ভাগ্য’ তাকে বারবার বাঁচিয়ে দিয়েছে।

এলো যুদ্ধের ডাক

১৯৭১ সালে মেজর রফিক চট্টগ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। তখন তিনি ক্যাপ্টেন। রাজনৈতিকভাবে তখন চরম উত্তাল দিন। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে চলছে নানা টালবাহানা। এরই মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সেনা মোতায়েন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মেজর রফিকের বুকের গভীরে বহু আগে রোপণ করা স্বাধীনতার বীজটি অঙ্কুর মেলে। সিদ্ধান্ত নেন বিদ্রোহ করার। তার অধীন বাঙালি অফিসার ও সেনাদের সঙ্গে আলোচনা করে কর্তব্য স্থির করেন। এরপর সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন।

মেজর রফিক ফিরে যান ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ। তিনি বলেন, দিনের বেলা পশ্চিমারা কৌশলে চট্টগ্রামের দায়িত্বে থাকা একজন বাঙালি ব্রিগেডিয়ারকে ঢাকা নিয়ে যান। তাকে বলা হয়, ‘রাজেন্দ্রপুরে সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছে, সেখানে তাকে লাগবে।’ এরপর চট্টগ্রামের দায়িত্ব দেওয়া হয় অবাঙালি ব্রিগেডিয়ার আনসারিকে। এ সময় চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত নামে একটি জাহাজে ১০ হাজার টন অস্ত্র, গোলাবারুদ মজুদ ছিল। আমরা নিশ্চিত ছিলাম এই অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাঙালি হত্যার কাজেই ব্যবহার করা হবে।

সেই দিনই বিদ্রোহ করেন মেজর রফিকুল ইসলাম। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন দেশকে বাঁচাতে যুদ্ধের বিকল্প নেই। পরিকল্পনা অনুসারে সেই দিন বিকেলেই চট্টগ্রামের সীমান্ত এলাকার দখল নিতে শুরু করে তাঁর সেনারা।

রফিকুল ইসলাম বলেন, পশ্চিমা ব্রিগেডিয়ার দায়িত্ব নিয়েই সোয়াতের অস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাসের নির্দেশ দেন এবং যারা বাধা দিচ্ছিল তাদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিল। প্রায় একশ’ সেনাকে তারা হত্যা করেছিল। আমরা গোলাগুলির আওয়াজ পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারি, ওরা আমাদের ওপর যে কোনো সময় আক্রমণ শুরু করবে। কার্যকর করবে গণহত্যা, যার আঁচ আমি আগেই পেয়েছি। আমি চলে যাই রেলওয়ে পাহাড়ে। সেখানে হেডকোয়ার্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রেখেছিলাম। সন্ধ্যায় একটা বড় গাছের নিচে বসে আছি, এর মধ্যেই এলেন লে. কর্নেল চৌধুরী এবং মেজর জিয়া। আমার সঙ্গে একমত না হয়ে তারা চলে গেলেন। ফলে আমাকে যুদ্ধ শুরু করা থেকে বিরত থাকতে হয়।

পরদিন ২৫ মার্চ, সংঘর্ষ অনিবার্য অনুধাবন করে মেজর রফিক সক্রিয় বিদ্রোহ শুরু করেন এবং ইপিআরের অবাঙালি সৈন্য ও অফিসারদের জীবিত অবস্থায় বন্দি করেন। তার অধীনে ন্যস্ত সৈনিকরা এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমান সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহস্রাধিক বাঙালি সৈনিক ও অফিসারকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে কালুরঘাট ব্রিজের কাছে পাহাড়তলি স্কুলের পাশে অবস্থান নেয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে চট্টগ্রামের অন্যান্য সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আগত ইপিআর সৈনিকদের মেজর জিয়া চট্টগ্রামে মেজর রফিকের বাহিনীর সঙ্গে যোগদানে বাধা দেন এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের সঙ্গে কালুরঘাট ব্রিজ এলাকায় অবস্থান নিতে বাধ্য করেন। এ কারণে পর্যাপ্ত শক্তির অভাবে চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হন এবং এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রচুর ক্ষতি সাধন করে পিছু হটেন। মেজর রফিক হেডকোয়ার্টার সীমান্তের ওপারে হরিণায় স্থাপন করতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে এখান থেকেই তিনি ১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে চট্টগ্রাম এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। বহু বিপজ্জনক যুদ্ধে তার বাহিনী সফলতার পরিচয় দেয়। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যার ঠিক আগে ভাটিয়ারিতে যুদ্ধ চলছিল। তুমুল যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ঢাকাতেও পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পন করেছে। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর। মেজর রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে এক শিশুকে দিয়ে সঙ্গে রাখা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ যেন নতুন প্রজন্মের কাছে দায়িত্বভার অর্পণের এক প্রতীকী আয়োজন।

সারা জীবন

মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। বাবা আশরাফ উল্লাহ এবং মা রহিমা বেগম। তিন ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে মেজর (অব.) রফিক সবার বড়। স্ত্রী প্রয়াত রুবি ইসলাম। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর কিছুদিন চট্টগ্রামে ইংরেজি দৈনিক ‘দি পিপলস ভিউ’র সহযোগী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখেন ‘আ টেল অব মিলিয়নস’। গ্রন্থাকারে এটি ১৯৭৪ সালে প্রথম প্রকাশ হয়। ১৯৮১ সালে ‘আ টেল অব মিলিয়নস’ বইটি পরিবর্ধিত আকারে এবং বইটির বাংলা অনুবাদ ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়। তার আরেকটি বই ‘মুক্তির সোপানতলে’ প্রকাশ হয় ২০০১ সালে। এরশাদ সরকারের পতন হলে ১৯৯০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তিনি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে একই আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি বীরউত্তম ও সাহিত্যে বাংলা একাডেমির পুরস্কার (২০১৯) লাভ করেন। (সমকালের সৌজন্যে)

Sharing is caring!

[sharethis-inline-buttons]

আরও পড়ুন

error: Content is protected !!