হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন

  • আপডেট: ০৫:০৭:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০১৯
  • ২৮

মো. জাহিদ হাসান

ভারতবর্ষে মধ্যযুগে মুসলমানদের আগমন ঘটে বলে ধরে নেয়া হয়। বখতিয়ার খলজী কর্তৃক ১২০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলমান শাসনের সূচনা হয়। তবে এর আগে বারো শতকের শেষের দিকে আফগানিস্তানের ঘোরী বংশীয়দের দিল্লি অধিকারের মধ্যে দিয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলায় মুসলমানদের গোড়াপত্তন ঘটেছিল। এটা সত্য যে, বাংলায় মুসলমানদের আগমন ও মুসলিম শাসন শুরু শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বহুমাত্রিক পরিবর্তন আনে। বাংলার স্থানীয় মুসলমানদের সাথে বহিরাগত মুসলমান তথা আরব, পারস্য ও আফগানদের জীবন উপাদানের সমন্বয়ের ফলে সব ক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলিম নামে পরিবর্তনের সূচনা হয়। এ সময় অনেক উপাদানের সাথে বাংলার স্থাপত্য শিল্পের যে বিকাশ সাধিত হয় তা মূলত মুসলমানগণ নিয়ে এসেছিলেন ধর্মীয় প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি রাখতে। বিশেষ করে, তৎসময়ে মুসলমানরা ইমারত নির্মাণে ক্ষেত্রে কাঠামো পরিকল্পনার সাথে যে নির্মাণশৈলী ফুটিয়ে তুলেছে তাতে ভারতীয়দের কোন পরিচয় ছিল না। তারা প্রাক-ইসলাম যুগে ব্যবহৃত রোমান-বাইজেন্টীয় ও পারসিক থেকে এমনভাবে গ্রহণ করে যে, সারা বিশে^ এগুলো মুসলিম ইমারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। মধ্যযুগে ধর্মীয় স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে মুসলমানদের নির্মিত মসজিদগুলো অন্যতম। মিনহাজের তবকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, বখতিয়ার খলজী মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা নির্মাণ করেছিলেন। রাজশাহীর বাঘা মসজিদ ও কুসুম্বা মসজিদ, গৌড়-লখনৌতির ছোট সোনা মসজিদ, ঢাকার খান মুহাম্মদ মির্ধা মসজিদ, বিবি পরীর মসজিদ সহ বহু মসজিদ আজ মুসলমানদের স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে মাথা উঁচু করে আছে। এদের অধিকাংশ জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ হতে পেরেছে। এগুলো ছাড়াও সারা দেশে আরো বহু মসজিদ রয়েছে যেগুলোর বিষয়ে আমরা নির্মাণ কাজের ধরণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুই জানি না। এমন একটি অনন্য মুসলিম স্থাপত্য নিদর্শন হলো চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ।

হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ চাঁদপুর জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বে হাজীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। ঐতিহাসিক এই মসজিদটি নির্মাণের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ হিসেবে উল্লেখ্য যে, বাংলা এগার’শ পঁছাত্তর থেকে বার’শ সালের মধ্যে হযরত মকিমউদ্দিন (রহ.) নামে এতজন বুজুর্গ অলীয়ে কামেল ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে পবিত্র আরব ভূমি থেকে অত্র এলাকায় আগমন করেছিলেন। তিনি স্বপরিবারে বর্তমান বড় মসজিদের মেহরাব সংলগ্ন স্থান, যেখানে একটু উঁচু ভূমি বিদ্যমান ছিল, সেখানে আস্তানা তৈরি করে পরিবার পরিজন নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। তাঁর প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও চারিত্রিক মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে বহু লোক তাঁর কারেছ দীক্ষা নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি দু’একজন নব্য মুসলমান নিয়ে চৌধুরী ঘাটে নামাজ আদায় করতেন। হিন্দু-মুসলমান সকলের কাছে তিনি শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। মূলত এ এলাকায় হাজী মকিমউদ্দিন (রহ.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে ইসলামের আবাদ করেন। তারই বংশের শেষ পুরুষ হযরত মনিরুদ্দিন হাজী ওরফে মনাই হাজী (রহ.)’র দৌহিত্র আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.) বাংলা তেরশ পঁচিশ থেকে ত্রিশ সালের সালের দিকে বড় মসজিদের মেহরাব বা তৎসংলগ্ন স্থান জুড়ে প্রথমে একচালা খড়ের ইবাদতখানা, অতঃপর খড় এবং গোলপাতা দিয়ে তৈরি দো’চালা মসজিদ নির্মাণ করেন। যা পরবর্তীতে টিনের দো’চালা মসজিদ থেকে পাকা মসজিদ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরম করুনাময় আল্লাহপাকের অশেষ মেহেরবানীতে শরীর, মনোবল এবং প্রচ- মেধাশক্তির অধিকারি আহমাদ আলী পাটওয়ারী আল্লাহর উপর ভরসা করে পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া তথা ধনাঢ্য পিতার সম্পদ-সম্পত্তি এবং পরম শ্রদ্ধেয় নানা মনাই হাজী (রহ.) উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রাপ্ত সকল সম্পদ সম্পত্তি দেখা-শুনার পাশাপাশি নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা হিসেবে নিজ হাতে নির্মিত মসজিদের কাজে গুরুত্ব প্রদান করেন। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের, ১৭ আশি^

জাহিদ হাসান

ন আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.)’র পরম ইচ্ছায় হযরত মাওলানা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.)’র পবিত্র হাতে পাকা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।

হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ এ অঞ্চলে অন্যতম মুসলিম নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। মসজিদটি নির্মাণকালে স্থাপত্য শিল্পের যে নির্মাণশৈলী দেয়া হয়েছে তা যেন স্থাপত্য শিল্পরই বিশুদ্ধ ব্যাকরণ। মসজিদের বিভিন্ন অংশে যে কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা কালের সাক্ষ্য বহন করছে। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদখানা তিন অংশে নির্মিত হয়েছে। প্রথম অংশ ৪৭৮৪ বর্গফুট, মাঝের অংশ ১৩০০৬ বর্গ ফুট এবং তৃতীয় অংশে ১৬১৫ বর্গ ফুট। সর্বমোট ২৮৪০৫ বর্গফুট আয়তনের উক্ত মসজিদে প্রথম অংশে হযরত মাও: আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.) ভারী শরীর নিয়ে, মাচার উপর বসে, তার পবিত্র হাতে চুন-সুরকির মসলা কেটে কেটে অনেক কষ্ট করে মেহরাব সংলগ্ন দেয়াল ঘুরিয়ে মসজিদের প্রথম অংশের উপরের দিকে ‘সুরা ইয়াছিন’ ও ‘সুরা জুময়া’ লিপিবব্ধ করেন। বর্তমান সময়ে সংস্কারকালে তা উঠিয়ে মসজিদের কবরস্থানে দাফন করা হয়। উক্ত মসজিদের অনন্য সুন্দর মেহরাবটি কাচের ঝাড়ের টুকরো নিখুতভাবে কেটে কেটে মনোরম ফুলের ঝাড়ের ন্যায় আকর্ষণীয় নক্শায় সাজিয়ে তোলা হয়েছে। মাঝের অংশটি ৭৭ টি আকর্ষণীয় পিলার ও ঝিনুকের মোজাইক দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। তৃতীয় অংশটিতে রয়েছে তিনটি বিশাল গম্বুজসহ আকর্ষণীয় বিশাল সুউচ্চ মিনার। যা মসজিদটিকে আলাদা বিশেষত্ব দান করেছে। ১৯৫৩ সনে ১২৮ ফুট উঁচু এই মিনারটি তৈরি হয়েছিল। সুউচ্চ এই মিনারটিরও আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর তা হলো, মসজিদের প্রধান প্রবেশদ্বারে উপর এতো উঁচু মিনারের উপস্থিতি সে কালের নির্মাণ বিষয়টিকে ভাবিয়ে তোলে। মিনারের উঁচু প্লাটফর্মে বহু মুসল্লি ও পর্যটক উঠে হাজীগঞ্জের চারপাশের দৃশ্য অবলোকন করেন। প্রতিদিন মিনারের উচু থেকে একযোগে মাইক দিয়ে আজান প্রচার করা হয়। বহুদূর দূরান্ত থেকে এ আজানের ধ্বনি শোনা যায়।কারুকার্যখচিত মসজিদের সর্বশেষ পূর্ব প্রাচীরে পবিত্র কালেমা শরীফ খচিত চিনা বাসনের টুকরো দিয়ে তৈরি মনোরম ফুলের ঝাড়ের ন্যায় আকর্ষণীয় করে সাজানো বিশাল ফটক। মসজিদে প্রবেশের সুবিশাল ফটকের আকর্ষণীয় সাজ দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নেয়। পাথরের সাজে সজ্জিত অসংখ্য তারকাখচিত তিনটি বড় বড় গম্বুজ পর্যটকদের আকর্ষণ করে। মসজিদটি পবিত্র রমজান মাসে জুমাতুল বিদাআর জামাতের জন্য ঐতিহাসিকভাবে প্রসিদ্ধি রয়েছে। এক সময় পাক ভারত উপমহাদেশের মধ্যে হাজীগঞ্জ এতিহাসিক বড় মসজিদ অনন্য বৃহত্তম জুমাতুল বিদা নামাজের জামাত উদ্যাপনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাত ছিল। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মসজিদটিতে পবিত্র রমজান মাসে রোজা রেখে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক কষ্ট করে লক্ষাধিক রোজাদার মুসল্লি এখনও জুমাতুল বিদা নামাজের জামাত সমবেত হয়ে থাকে।

জেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত গৌরবোজ্জ্বল উক্ত প্রতিষ্ঠানে শুভাগমন করেছেন রাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গ। বিশেষ করে, অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নবাব মোশারফ হোসেন ও নওয়াব জাদা খাজা নসরুল্লাহ প্রমূখ। এছাড়াও পরবর্তী সময়ে হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদে শুভাগমন করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষাণীসহ ইতিহাস প্রসিদ্ধ আরও অনেক ব্যক্তিবর্গ। তাছাড়াও উক্ত প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ আরও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ শুভাগমন করেছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- শায়খুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.), আল্লামা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.), আল্লামা জাফর আহমদ উসমানী (রহ.), আল্লামা আতহার আলী (রহ.), আল্লামা এহতেশামুল হক থানভী (রহ.) সহ আরও বহু হক্কানী পীর মাশায়েখ এবং শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বীন।

লেখক পরিচিতি:
মো. জাহিদ হাসান
শিক্ষক ও কলাম লেখক

jahidhasan278@yahoo.com

Tag :
সর্বাধিক পঠিত

যে কারণে পুরুষে ৪টি বিয়ের পক্ষে হীরা সুমরো

হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন

আপডেট: ০৫:০৭:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০১৯

মো. জাহিদ হাসান

ভারতবর্ষে মধ্যযুগে মুসলমানদের আগমন ঘটে বলে ধরে নেয়া হয়। বখতিয়ার খলজী কর্তৃক ১২০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলমান শাসনের সূচনা হয়। তবে এর আগে বারো শতকের শেষের দিকে আফগানিস্তানের ঘোরী বংশীয়দের দিল্লি অধিকারের মধ্যে দিয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলায় মুসলমানদের গোড়াপত্তন ঘটেছিল। এটা সত্য যে, বাংলায় মুসলমানদের আগমন ও মুসলিম শাসন শুরু শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বহুমাত্রিক পরিবর্তন আনে। বাংলার স্থানীয় মুসলমানদের সাথে বহিরাগত মুসলমান তথা আরব, পারস্য ও আফগানদের জীবন উপাদানের সমন্বয়ের ফলে সব ক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলিম নামে পরিবর্তনের সূচনা হয়। এ সময় অনেক উপাদানের সাথে বাংলার স্থাপত্য শিল্পের যে বিকাশ সাধিত হয় তা মূলত মুসলমানগণ নিয়ে এসেছিলেন ধর্মীয় প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি রাখতে। বিশেষ করে, তৎসময়ে মুসলমানরা ইমারত নির্মাণে ক্ষেত্রে কাঠামো পরিকল্পনার সাথে যে নির্মাণশৈলী ফুটিয়ে তুলেছে তাতে ভারতীয়দের কোন পরিচয় ছিল না। তারা প্রাক-ইসলাম যুগে ব্যবহৃত রোমান-বাইজেন্টীয় ও পারসিক থেকে এমনভাবে গ্রহণ করে যে, সারা বিশে^ এগুলো মুসলিম ইমারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। মধ্যযুগে ধর্মীয় স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে মুসলমানদের নির্মিত মসজিদগুলো অন্যতম। মিনহাজের তবকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, বখতিয়ার খলজী মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা নির্মাণ করেছিলেন। রাজশাহীর বাঘা মসজিদ ও কুসুম্বা মসজিদ, গৌড়-লখনৌতির ছোট সোনা মসজিদ, ঢাকার খান মুহাম্মদ মির্ধা মসজিদ, বিবি পরীর মসজিদ সহ বহু মসজিদ আজ মুসলমানদের স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে মাথা উঁচু করে আছে। এদের অধিকাংশ জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ হতে পেরেছে। এগুলো ছাড়াও সারা দেশে আরো বহু মসজিদ রয়েছে যেগুলোর বিষয়ে আমরা নির্মাণ কাজের ধরণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুই জানি না। এমন একটি অনন্য মুসলিম স্থাপত্য নিদর্শন হলো চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ।

হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ চাঁদপুর জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বে হাজীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। ঐতিহাসিক এই মসজিদটি নির্মাণের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ হিসেবে উল্লেখ্য যে, বাংলা এগার’শ পঁছাত্তর থেকে বার’শ সালের মধ্যে হযরত মকিমউদ্দিন (রহ.) নামে এতজন বুজুর্গ অলীয়ে কামেল ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে পবিত্র আরব ভূমি থেকে অত্র এলাকায় আগমন করেছিলেন। তিনি স্বপরিবারে বর্তমান বড় মসজিদের মেহরাব সংলগ্ন স্থান, যেখানে একটু উঁচু ভূমি বিদ্যমান ছিল, সেখানে আস্তানা তৈরি করে পরিবার পরিজন নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। তাঁর প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও চারিত্রিক মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে বহু লোক তাঁর কারেছ দীক্ষা নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি দু’একজন নব্য মুসলমান নিয়ে চৌধুরী ঘাটে নামাজ আদায় করতেন। হিন্দু-মুসলমান সকলের কাছে তিনি শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। মূলত এ এলাকায় হাজী মকিমউদ্দিন (রহ.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে ইসলামের আবাদ করেন। তারই বংশের শেষ পুরুষ হযরত মনিরুদ্দিন হাজী ওরফে মনাই হাজী (রহ.)’র দৌহিত্র আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.) বাংলা তেরশ পঁচিশ থেকে ত্রিশ সালের সালের দিকে বড় মসজিদের মেহরাব বা তৎসংলগ্ন স্থান জুড়ে প্রথমে একচালা খড়ের ইবাদতখানা, অতঃপর খড় এবং গোলপাতা দিয়ে তৈরি দো’চালা মসজিদ নির্মাণ করেন। যা পরবর্তীতে টিনের দো’চালা মসজিদ থেকে পাকা মসজিদ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরম করুনাময় আল্লাহপাকের অশেষ মেহেরবানীতে শরীর, মনোবল এবং প্রচ- মেধাশক্তির অধিকারি আহমাদ আলী পাটওয়ারী আল্লাহর উপর ভরসা করে পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া তথা ধনাঢ্য পিতার সম্পদ-সম্পত্তি এবং পরম শ্রদ্ধেয় নানা মনাই হাজী (রহ.) উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রাপ্ত সকল সম্পদ সম্পত্তি দেখা-শুনার পাশাপাশি নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা হিসেবে নিজ হাতে নির্মিত মসজিদের কাজে গুরুত্ব প্রদান করেন। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের, ১৭ আশি^

জাহিদ হাসান

ন আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.)’র পরম ইচ্ছায় হযরত মাওলানা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.)’র পবিত্র হাতে পাকা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।

হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ এ অঞ্চলে অন্যতম মুসলিম নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। মসজিদটি নির্মাণকালে স্থাপত্য শিল্পের যে নির্মাণশৈলী দেয়া হয়েছে তা যেন স্থাপত্য শিল্পরই বিশুদ্ধ ব্যাকরণ। মসজিদের বিভিন্ন অংশে যে কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা কালের সাক্ষ্য বহন করছে। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদখানা তিন অংশে নির্মিত হয়েছে। প্রথম অংশ ৪৭৮৪ বর্গফুট, মাঝের অংশ ১৩০০৬ বর্গ ফুট এবং তৃতীয় অংশে ১৬১৫ বর্গ ফুট। সর্বমোট ২৮৪০৫ বর্গফুট আয়তনের উক্ত মসজিদে প্রথম অংশে হযরত মাও: আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.) ভারী শরীর নিয়ে, মাচার উপর বসে, তার পবিত্র হাতে চুন-সুরকির মসলা কেটে কেটে অনেক কষ্ট করে মেহরাব সংলগ্ন দেয়াল ঘুরিয়ে মসজিদের প্রথম অংশের উপরের দিকে ‘সুরা ইয়াছিন’ ও ‘সুরা জুময়া’ লিপিবব্ধ করেন। বর্তমান সময়ে সংস্কারকালে তা উঠিয়ে মসজিদের কবরস্থানে দাফন করা হয়। উক্ত মসজিদের অনন্য সুন্দর মেহরাবটি কাচের ঝাড়ের টুকরো নিখুতভাবে কেটে কেটে মনোরম ফুলের ঝাড়ের ন্যায় আকর্ষণীয় নক্শায় সাজিয়ে তোলা হয়েছে। মাঝের অংশটি ৭৭ টি আকর্ষণীয় পিলার ও ঝিনুকের মোজাইক দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। তৃতীয় অংশটিতে রয়েছে তিনটি বিশাল গম্বুজসহ আকর্ষণীয় বিশাল সুউচ্চ মিনার। যা মসজিদটিকে আলাদা বিশেষত্ব দান করেছে। ১৯৫৩ সনে ১২৮ ফুট উঁচু এই মিনারটি তৈরি হয়েছিল। সুউচ্চ এই মিনারটিরও আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর তা হলো, মসজিদের প্রধান প্রবেশদ্বারে উপর এতো উঁচু মিনারের উপস্থিতি সে কালের নির্মাণ বিষয়টিকে ভাবিয়ে তোলে। মিনারের উঁচু প্লাটফর্মে বহু মুসল্লি ও পর্যটক উঠে হাজীগঞ্জের চারপাশের দৃশ্য অবলোকন করেন। প্রতিদিন মিনারের উচু থেকে একযোগে মাইক দিয়ে আজান প্রচার করা হয়। বহুদূর দূরান্ত থেকে এ আজানের ধ্বনি শোনা যায়।কারুকার্যখচিত মসজিদের সর্বশেষ পূর্ব প্রাচীরে পবিত্র কালেমা শরীফ খচিত চিনা বাসনের টুকরো দিয়ে তৈরি মনোরম ফুলের ঝাড়ের ন্যায় আকর্ষণীয় করে সাজানো বিশাল ফটক। মসজিদে প্রবেশের সুবিশাল ফটকের আকর্ষণীয় সাজ দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নেয়। পাথরের সাজে সজ্জিত অসংখ্য তারকাখচিত তিনটি বড় বড় গম্বুজ পর্যটকদের আকর্ষণ করে। মসজিদটি পবিত্র রমজান মাসে জুমাতুল বিদাআর জামাতের জন্য ঐতিহাসিকভাবে প্রসিদ্ধি রয়েছে। এক সময় পাক ভারত উপমহাদেশের মধ্যে হাজীগঞ্জ এতিহাসিক বড় মসজিদ অনন্য বৃহত্তম জুমাতুল বিদা নামাজের জামাত উদ্যাপনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাত ছিল। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মসজিদটিতে পবিত্র রমজান মাসে রোজা রেখে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক কষ্ট করে লক্ষাধিক রোজাদার মুসল্লি এখনও জুমাতুল বিদা নামাজের জামাত সমবেত হয়ে থাকে।

জেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত গৌরবোজ্জ্বল উক্ত প্রতিষ্ঠানে শুভাগমন করেছেন রাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গ। বিশেষ করে, অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নবাব মোশারফ হোসেন ও নওয়াব জাদা খাজা নসরুল্লাহ প্রমূখ। এছাড়াও পরবর্তী সময়ে হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদে শুভাগমন করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষাণীসহ ইতিহাস প্রসিদ্ধ আরও অনেক ব্যক্তিবর্গ। তাছাড়াও উক্ত প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ আরও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ শুভাগমন করেছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- শায়খুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.), আল্লামা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.), আল্লামা জাফর আহমদ উসমানী (রহ.), আল্লামা আতহার আলী (রহ.), আল্লামা এহতেশামুল হক থানভী (রহ.) সহ আরও বহু হক্কানী পীর মাশায়েখ এবং শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বীন।

লেখক পরিচিতি:
মো. জাহিদ হাসান
শিক্ষক ও কলাম লেখক

jahidhasan278@yahoo.com