সুদীপ চন্দ্র হালদার
হৃদয়বৃত্তির সুকোমল চেতন বোধ থেকে উৎসারিত ভালবাসা জাগানিয়া এক ছোট্ট শব্দগুচ্ছ “শেখ রাসেল”। ১৯৬৪ সালের ১৮ই অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নং সড়কের ঐতিহাসিক ৬৭৭ নাম্বার বাড়িতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা এর কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করে রাসেল, শেখ রিসালউদ্দিন। রাসেল এর জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন চট্টগ্রাম, নির্বাচনী প্রচারের কাজে।
বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা “শেখ মুজিব আমার পিতা” বইয়ে “স্মৃতি বড় মধুর স্মৃতি বড় বেদনার” রচনায় বলেছেন, “১৯৬৪ সালের অক্টোবরে রাসেলের জন্ম। তখনও বাড়ির দোতলা হয়নি, নিচ তলাটা হয়েছে। উত্তর-পূর্ব কোণে আমার ঘরেই রাসেলের জন্ম। মনে আছে আমাদের সে কি উত্তেজনা।… এদিকে ভাই না বোন! ভাইদের চিন্তা আর একটা ভাই হলে তাদের খেলার সাথী বাড়বে, বোন হলে আমাদের লাভ। আমার কথা শুনবে, সুন্দর সুন্দর ফ্রক পরানো যাবে, চুল বাধা যাবে, সাজাব, ফোটো তুলব, অনেক রকম করে ফোটো তুলব।… এর মধ্যে মেঝ ফুপু এসে খবর দিলেন ভাই হয়েছে। সব তর্ক ভুলে গিয়ে আমরা খুশিতে লাফাতে শুরু করলাম।..বড় ফুপু রাসেলকে আমার কোলে তুলে দিলেন।…কামাল, জামাল সবাই ওকে ঘিরে দারুণ হইচই।” সত্যিই আনন্দের বন্যা বয়ে দিয়েই রাসেল এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারে। বঙ্গবন্ধু ছেলের জন্ম খবর শুনে দ্রুতই ঢাকায় ফিরলেন। ছেলেকে কোলে নিলেন, আর নাম রাখলেন রাসেল, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সাথে মিলিয়ে। এই মহান ব্যক্তিত্বের লেখনীর দর্শন বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ আকৃষ্ট করত, তার সংগ্রামী জীবনের দীর্ঘ সময় জেলে কাটানোর সময়ে তিনি রাসেলের বই পড়তেন।
জনাব শামসুজ্জামান খান “দার্শনিকের নামে রাখা নাম ” শীর্ষক রচনায় বলেছেন, ” আমাদের কালের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিশ্ব শান্তি ও পারমাণবিক যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন এই ব্রিটিশ দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক। যাঁর নাম রাসেল। এই বিশ্বকে মানুষের জন্য সুন্দর ও শান্তিময় বাসভূমি করার লক্ষ্যে এই মনীষী ছিলেন সদা সক্রিয়। এই মতো মহতের নামে নাম রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু তার আদরের ছোট সন্তানের। তার আশা ছিল রাসেল বড় হয়ে রাসেলের মত হবে। কী চমৎকার, আর কি সুন্দর স্বপ্ন।” দারুণ প্রানবন্ত মেধাবী রাসেল বড় হয়ে সত্যিই যদি বার্ট্রাড রাসেল এর মত হতেন তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না; সেই ছোটবেলাতেই তার কি ভাবনা-১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে, অনেকে বলাবলি করছে এবার বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট হবেন, আর তাকে থাকতে হবে রাওয়ালপিণ্ডির প্রেসিডেন্ট বাড়িতে, একথা শোনা মাত্র হাত চাপড়ে প্রতিবাদ করত ছোট্ট রাসেল, বলত সে পাকিস্তানে যাবে না, ওটা তার দেশ না, আর বাবা মাকেও যেতে দিবে না!! নিজে কবুতর পুষত কিন্তু কবুতরের মাংস খেত না , ডিম ভাজি আর চিনি তার প্রিয় খাবার, আর খাবার সবার সাথে বিলিয়ে খেতে তার সেকি আনন্দ!! ডাকটিকিট সংগ্রহ, বন্ধু আদিল আর ইমরানের সাথে ক্রিকেট- ফুটবল খেলা, লেকপাড়ে সাইকেল দিয়ে চক্কর দিয়ে দিয়ে মুক্ত হাওয়ায় মুক্ত বাতাসে স্বপ্নীল শৈশব কাটাচ্ছিল রাসেল। খুব মেধাবী ছিল রাসেল, প্রিয় হাসু আপা, রেহানা আপার কাছ থেকে গল্প শোনা ছিল তার অভ্যাস। বঙ্গবন্ধুর তৈরি একটা ছোট খাট লাইব্রেরী ছিল বাড়িতে, সেখান হতে বই নিয়ে গল্প শোনাতেন বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। একই গল্প ক’দিন পরে আবার পড়ে শোনালে যদি কোন লাইন বাদ যেত তাহলে রাসেল ঠিকই ধরে ফেলত, বলত সেই লাইনটা পড়নি কেন!!
বঙ্গবন্ধুও সময় পেলে বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকে গল্প শোনাত। তবে রূপকথার গল্প নয়, তিনি শোনাতেন নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের গল্প, সংগ্রামের গল্প, স্বাধীনতা অর্জনের গল্প। কখনো কখনো রাসেলও গল্প শোনাত বঙ্গবন্ধুকে। রাসেল গল্প শোনাত বরিশাল, ফরিদপুর, ঢাকা এবং উর্ধু ভাষা মিশিয়ে। রাসেলের ভাষা শুনে বঙ্গবন্ধু হো হো করে হেসে উঠতেন। শেখ রেহানা “রাসেল আমাদের ভালবাসা” শীর্ষক একটি রচনায় বলেছেন,” আব্বা খুব আদর করতেন ওকে। বাইরে থেকে ঘরে ফিরেই প্রথমে রাসেলকে খুজতেন। ওকে কোলে বসিয়ে কত কথা বলতেন। রাসেলও কত কথা জিজ্ঞেস করত। ওর কথা বলার ধরন দেখে আমাদের খুব মজা লাগতো”। মজার বিষয়, রাসেল এক শিক্ষকের কাছে বেশিদিন পড়তে চাইত না; তবে গীতালি দাসগুপ্ত নামে এক বাংলার শিক্ষকের সাথে তার ভীষণ ভাব জমে যায়!
বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ছিল প্রগাঢ় ভালবাসা, বঙ্গবন্ধু জেলে থাকলে তার জন্য মাঝে মাঝে কাঁদতেন রাসেল, তার প্রিয় হাসু আপা, রেহানা আপা তার এই কান্নাকে পেটব্যথা বলে ভুল করতেন কখনো কখনো।
“কারাগারের রোজনামচা” বইয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন,” কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ওতো বোঝেনা আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম – তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে!! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি ওর জন্মদাতা। “
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন রাসেল দেশ বিদেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানুক, দেখুক।এই ভাবনা থেকেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে লন্ডন, ১৯৭৩ সালে জাপান এবং ১৯৭৪ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণে রাসেলকে নিয়ে যান।
ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে রাসেল পড়ত শিশু শ্রেণী থেকেই , সবার সাথে মিশত সহজ সরল ভাবেই, খুব সম্ভবত অহংবোধ বলেই কিছু ছিল না রাসেলের, সবাইকে হই হুল্লোড় করে মাতিয়ে রাখত। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট এক বিশেষ সমাবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর, আর তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগতম জানানোর জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির চার শিক্ষার্থীকে, রাসেল ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম জঘন্যতম হত্যাকান্ডের স্বীকার হওয়া রাসেলের ফুলেল স্বাগতম জানানো হয়নি বঙ্গবন্ধুকে, আর বঙ্গবন্ধুরও নেওয়া হয়নি সেই শুভেচ্ছা!!
একটু ভাবুন তো দশ বছর সাত মাসের একটা ছেলে, ভয়ের আর্তনাদে বলছে আমাকে মেরে ফেলনা, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চল; আর তাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সিড়ি দিয়ে যেখানে পড়ে রয়েছে তার প্রিয় বাবা আর ভাইয়ের লাশ!! ভাবুন তো যদি রাসেল বঙ্গবন্ধুর সন্তান না হয়ে আপনার আপনজন হোত!! এই ছোট্ট নিষ্পাপ ছেলের কি অপরাধ ছিল ; যে কিনা কবুতর পুষত বলে মমত্ববোধের কারনে কবুতরের মাংস খেত না!! পিশাচেরা নাকি তাদের ভাষায় রাসেলকে Mercy Murder (দয়া করে হত্যা) করেছে, হায়!! সুকুমার বড়ুয়া তার “রাসেলেরা” কবিতায় বলেছেন,” অতি লোভী নরপশু বন্দুকবাজরা রাসেলের কচি বুক করে দিল ঝাঁঝরা। দিন যায় দিন আসে ইতিহাস ডাকবেই একজন কোটি হয়ে রাসেলেরা জাগবেই।”
চির অমর রাসেল, চির শিশু রাসেল বাংলার ইতিহাসে দেদীপ্যমান এক ভালবাসার বাতিঘর হিসেবে থাকবে চিরকাল। শুভ দিন হোক-রাসেলের জন্মদিন।।
লেখকঃ রাজনৈতিক কর্মী;
মোবাইলঃ ০১৬৪০৪৪৩৩৯৯,
ইমেইলঃ sudipnipan@yahoo.com