জালের সঙ্গে বাঁধা যাদের জীবনতরী। যে জালে মাছ শিকার, সেই জালেই বন্দি তাদের জীবন। বাপ-দাদার আদি পেশা আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছেন কিছু জেলে। হাজারো এ জেলেদেরর ভীরে বেশীর ভাগই মৌসুমী পেশা হিসেবে মাছ ধরাকে বেছে নেন। বিশেষ করে নদীতে যখন মাছ ধরায় সরকারি বিধি নিষেধ থাকে।
দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে এ সম্প্রদায়ের প্রকৃত নাগরিকেরা চরম সংকটের মুখে। একদিকে নদীতে মাছ ধরতে প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই। অন্যদিকে পেশা ছেড়ে অন্য কাজে ফেরাও এদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ মাছধরা ছাড়া কোনো কাজই এরা জানেন না। সংসারের অভাব মেটাতে কোনো উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরতে নদীতে যেতে বাধ্য হচ্ছে মেঘনা পাড়ের জেলেরা
চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের সাখুয়া গ্রামের জেলে মোঃ ইউনুস বলেন, আমি দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে নদীতে মাছ ধরছি। আমার বাবাও মাছ ধরতেন তার কাছ থেকেই আমি মাছ ধরা শিখেছি। মাছ ধরা ছাড়া আর কোন কাজ শিখি নাই, তাই যখন নদীতে মাছ ধরতে পরি না তখন পোলাপাইন নিয়া সংসার চালাইতে কষ্ট হয়। আমরা যারা শুধু মাছ ধরি তারা কিন্তু সরকারে আইন মানি। মাছ ধরা বন্ধের সময় চাঁদপুরে বাইরের জেলা থেকে লোকজন এসে নদীতে মাছ ধরে বদনাম হয় আমাদের। অনেক সময় পুলিশ আমদের বাড়িতে হানা দেয় বলে আমরা নাকি নদীতে নেমেছি। মাছ ধরা বন্ধের সময় সরকার শুধু চাল দেয় এ দিয়া কি সংসার চলে, শুধু চাল না দিয়ে এসময় কিছু একটা কাজ দিলে ভাল হয়।
জেলে ওমর ফারুক বলেন, আমরা জেলেরা ভাল নেই, নদীতে বালু কাটায় এখন আমর মাছ নদীতে নাই। কত কষ্ট কইরা সুদে টাকা নিয়া জাল তৈরি করছি কিন্তু নদীতে জাল ফালাইও শান্তি নাই। বড় জাহাজের কারনে জাল ছিড়া ও কাইটা যায়। সুদের টাকা দিতে দিতে জান শেষ, আমরা চাঁদপুরের জেলেরা আঙ্গ নদীতে মাছ পাই না কারন অন্য জেলার জেলেরা মাছ ধইরা নিয়া যায়। নদীতে ইলিশ পেলেই পরিবার নিয়া ভালো থাকি।
জেলে মোঃ হারুন, মোঃ আলী ও শাহাদৎ মাতাব্বর বলেন, নদীতে ড্রেজার দিয়ে যততত্র বালু উত্তোলন করায় হতাশ জেলেরা। এর কারনে নদীতে কোন প্রজাতির মাছই বাড়তে পারছে না। অন্যদিকে নিষিদ্ধ মৌসুমে মৌসুমী জেলেদের উৎপাতে প্রকৃত জেলেরা কোনঠাসা। তারা আরো বলেন, মাছ ধরা নিষিদ্ধ মৌসুমে পুলিশ সহায়তা করে মৌসুমী জেলে ও আড়তদারদের। অন্য জেলা বিশেষ করে শরীয়তপুর ভোলা জেলার অনেক জেলে চাঁদপুরে সীমানায় এসে মাছ ধরায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি আমরা।
চাঁদপুর মাছ ঘাটের দীর্ঘ দিনের আড়তদার ও জেলা মৎস্য বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি আলহাজ মিজানুর রহমান কালু ভূঁইয়া বলেন, আমরা প্রকৃত আড়তদাররা সরকারের বিধি নিষেধ মেনেই মাছ ঘাট পুরোপুরি বন্ধ রাখি। নদীতে আমাদের কোটি কোটি টাকা দাদন দেওয়া সত্ত্বেও আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে ব্যবসা করছি। কিন্তু নিষিদ্ধ মৌসুমে অনেক মৌসুমী আড়রদার অসাধু উপায়ে জেলেদের দাদন দিয়ে নদীতে নামায় এতে করে আমাদের মতো প্রকৃত আড়রদাররা ক্ষতিগ্রস্থ হই। এ বিষয়ে প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
এ বিষয়ে চাঁদপুর ফিসিং বোর্ড মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম মল্লিক বলেন, চাঁদপুরে মাছ ধরার কাজে ছোট বড় প্রায় ১০ হাজার নৌকা রয়েছে। এর মধ্যে এক থেকে দই হাজার রয়েছে বড় ধরনের নৌকা। প্রকৃত জেলেরা মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময়ে পরিবার নিয়ে ভীষন কষ্টে থাকেন। কারন প্রায় প্রত্যেক জেলেই সুদে টাকা নিয়ে তার নৌকা ও জাল মেরামত করে থাকে। নিষিদ্ধ মৌসুমে সুদের কিস্তি নেওয়া বন্ধ থাকলে অনেই জেলেই নদীতে মাছ ধরতে নামবে না বলে আমি বিশ্বাস করি। জেলেদের শুধুমাত্র ২০/৩০ কেজি করে চাল দিলেই হবে না, তাদেরকে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।লবিধি নিষেধের সময়ে অনেক মৌসুমী জেলে যেমন নদীতে নামে তেমনি করে মৌসুমী আড়তদারও তৈরি হয়। এ মৌসুমী আড়রদারাই দাদন দিয়ে নিষিদ্ধ মৌসুমে নদীতে জেলেদের নামিয়ে থাকে।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, চাঁদপুর জেলায় নিবন্ধিত ৪৪ হাজার ৩৫ জন জেলে নদীতে মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করে। প্রকৃত জেলেদের বিষয়ে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সহযোগিাতা করে থাকে। জেলেদের সচেতন করার লক্ষে ইতোমেধ্যে চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচেতনামূলক সভা করা হয়েছে। মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে জেলেরা যাতে নদীতে না যায় সেজন্য নিবন্ধিত প্রত্যেক জেলেকে চাল দেওয়া হয়। আগামী পহেলা মার্চ থেকে শুরু হয়ে আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত টানা দুই মাস পদ্মা-মেঘনায় কোন প্রকার জাল ফেলা এবং মাছ ধরা নিষিদ্ধ। চাঁদপুরের মতলব উত্তরের ষাটনল থেকে হাইমচরের চরভৈরবির ৭০ কিলোমিটার এলাকায় জেলেদের নদীতে নামার ওপর থাকবে এ নিষেধাজ্ঞা।