আনিছ (ছদ্মনাম) একটি কোম্পানিতে জব করে৷ তার বাসা মিরপুর, ঢাকায়৷ মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তার পরিবার৷ সকালে ঘুম থেকে উঠা, নামাজ পড়া, কুরআন পড়া, তারপর ব্রেকফাস্ট৷ বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসার পর অফিসে যাওয়া, অফিস শেষ করে রাতে বাসায় ফেরা- এ নিয়ে রুটিনমাফিক জীবনযাপন-ই চলছিল তার৷ বলতে গেলে বেশ সুখে-শান্তিতেই দিন কাটাচ্ছিল৷ কিন্তু কে জানে এই সুখের মধ্যেই নেমে আসবে এমন এক অসুখ, যা তার নিত্যদিনের কর্মস্পৃহাকে প্রতিরুদ্ধ করবে, নিমিষেই ধূলিসাৎ করে দিবে সকল স্বপ্ন সকল পরিকল্পনাকে৷ জীবনচলার পুরো সিস্টেমকে থমকে দিবে, আটকে পড়বে জেলখানায়৷ যাতে সে নিদারুণ কষ্ট, দুর্ভোগ সহ্য করে দিনাতিপাত করবে৷ কারো সাথে থাকবেনা কোনো কথা, কোনো বার্তা, এমনকি দেখা-সাক্ষাৎ পর্যন্ত বন্ধ৷ এ যেন এক অন্ধকুটির! নিশ্বাস-প্রশ্বাস স্তব্ধ হওয়ার উপক্রম৷ কে জানত এসব রাতারাতিই ঘটবে!
একি সত্যিই জেলখানায় বন্দি? নাকি অন্য সকলের মত ঘরবন্দি? হ্যাঁ, ঠিকই অনুমান করেছেন৷ এ যেন নিজের ঘরে থেকেও জেলখানা, নিজের আবাসভূমি হয়েও প্রবাসী, সময় থাকা সত্ত্বেও অসময়, কর্মঠ হয়েও অকর্মা, উর্বর মাটি থাকা সত্ত্বেও অনুৎপাদন, বাজারে পণ্য থাকা সত্ত্বেও ক্রয়-বিক্রয়ের সীমাবদ্ধতা৷ মানুষ আজ স্বাধীন হয়েও ছোট্ট একটি কীটের (ভাইরাস) কাছে জিম্মী- বড়ই পরাজয়, বিশ্বের সবশক্তি আজ ঘনীভূত হয়েও অপারগ-অসার, বিজ্ঞান আজ অসহায় হয়ে পরিণত হয়েছে করুণার পাত্রের আধার৷
সেদিন আনিছ যোহরের নামাজ আদায় করার পর একটু ঘুমাচ্ছিল৷ হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়৷ চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলে দেখে পাশের বাড়ির খালাম্মা বড় বড় প্লেটে করে ইফতারি আয়োজন নিয়ে হাজির৷ একি খালাম্মা আজ এত তাড়াতাড়ি ইফতারি প্রস্তুত?
আনিছের কথায় খালাম্মা মৃদু হাসলো৷ বললো আজ একটু আগেভাগেই সেরে ফেল্লাম বাবা৷
প্লেট রাখতে রাখতে আনিছের চোখ পড়লো খালাম্মার বাচ্চা ছেলেটির দিকে৷ বয়স ৩/৪ হবে৷ গায়ে জড়ানো একটি গেঞ্জি, ছোট্ট একটি পেন্ট৷
মায়াময় চেহারার অসম্ভব সুন্দর দুটি নয়নকাড়া চোখ চেয়ে আছে কোনো এক স্পর্শের প্রতিক্ষায়৷ একটু কথা বলা একটু আদর-স্নেহ, একটু কাছে টানা একটু হাত বুলানোর প্রত্যাশায়৷ শত ইচ্ছা নিয়ে আনিছ বরাবরের মত যেই বাচ্চাটিতে একটু ছুঁতে যাবে অমনিতেই হৃদগহীনে একটা প্রকম্প একটা ভয় একটা হতাশা৷
একি! আগে তো এমন হয়নি কখনো! আজ আমার অনুভূতি কেন বিগড়ে গেল! কোনো একটা দেয়াল এসে যেন সব বিচ্ছিন্ন করে দিল, সুসম্পর্ক থেকেও যেন সব পর করে দিল!
“আমার দ্বারাও যেন অন্তত কোনো মাসুম বাচ্চা ক্ষতিগ্রস্থ না হয়- এই ভেবে নিজের মনকে কিঞ্চিৎ শান্তনা দিল৷ তৎক্ষণাৎ আনিছ দূরে সরে গেল, আবেগকে খুব কষ্টে বুকে চেপে নিল৷”
আরেকদিনের ঘটনা৷ বিকেলে মাঠে একটু পায়চারী করছিল আনিছ৷ দুর থেকে দেখছিল কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে একসাথে খেলায় মেতে উঠেছে, কেউবা পাশাপাশি বসে নিজেদের মত করে ভাঙা বাচনশিল্পে গল্প করছে, কেউবা ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা দুলিয়ে আনন্দ উপভোগ করছে, কেউবা গাছ থেকে ফুল সংগ্রহ করে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে, কেউবা লাফ-ঝাঁপ দিয়ে নিজেদেরকে স্নেহ-পরশের প্রতীকরূপে ফুটিয়ে তুলছে৷ যেন তারা কামনা করছে একজন এসে তাদের জড়িয়ে ধরুক, একটু কাছে টানুক, একটু বুকে জড়িয়ে পরম স্পর্শে ভালোবাসুক কিংবা তুলতুলে গাল দুটোতে ঠোঁটের একটু মৃদু চুমু বসাক৷
উফফ! কতই না সুন্দর ছিল দেখতে সেই প্রত্যাশিত চাহনীগুলো৷
ঠিক সেই মুহূর্তগুলোতে কি করে একজন মানুষ তাদের থেকে দূরে সরে থাকতে পারে, কি করে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে এসব শিশুদের থেকে, কিভাবে স্নেহবঞ্চিত করতে পারে এই অসহায় প্রাণগুলোকে, কতটা পাষাণ হৃদয় হলে এরূপ মনোভাব থাকতে পারে, আহ!
এসব ভেবে আনিছের তখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল৷ এ যেন কাছে থেকেও দূরে, মনে থেকেও বাহিরে, নাগালে থেকেও অস্পর্শে, অধিকার থেকেও অনায়ত্তে৷
মাঠে দাঁড়িয়ে এসব চিন্তা করতে করতে কখন যে ইফতারের সময় ঘনীয়ে এলো তা টেরই পায়নি আনিছ৷ হঠাৎ দূর থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ ভেসে আসলো- মাগরিবের আযান পড়ে গেল৷ সে এবার ঘরে ফেরার মনোনিবেশে হেঁটে চললো কিন্তু কে জানে তার মনে এখনো কি চলছে! সে কি এখনো কোনো অভাব অনুভব করছে নাকি অভাবটুকু হৃদয়ে চাপা দিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাস্তবতাকে মেনে নিচ্ছে৷ কবে হবে এসব দূরীভূত, কবে আসবে শান্তি, কবে আসবে সেই আকাংখিত সংস্পর্শ!
ঘরে ফেরার সামান্যটুকু রাস্তা আজ যেন ফুরাবার নয়! তাই আনিছের চোখ বারবারই পেছন ফিরে রয়, অনুভব করছে সেই ছোট্ট শিশুগুলোকে৷ বুকে হাজারো আকাংখা নিয়ে ‘আবার আসিবে ফিরে সুদিন’- এই প্রত্যাশায় চেয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে৷ এ দৃষ্টি যেন না ফেরাবার নয়
..(চলমান)