হাজীগঞ্জ, ৪ মে, সোমবার:
মা ঘরেই আছেন, তবে কোন সাঁড়া শব্দ নেই। মা, মা করে কাঁদছে শিশু। জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছেন। মাকে ঠিকই দেখা যাচ্ছে, তবে কোন শব্দ নেই। কোমলমতির শিশু আরো জোরে কাঁদছে। কখনো কখনো জানালার ফাঁক করে হাত দুটি গ্রীলে ধরে জানালা দিয়ে উপরে উঠার চেস্টা করছে যদি মায়ের সাথে একটু কথা বলা যায়। এমন ছবি দেখলে সত্যিই চোখে পানি এসে যায়। বিশ্বের কোন মানুষই এমন ছবি দেখে কান্না থামিয়ে রাখতে পারবেনা।
যে লোকটি এক সময় হাজীগঞ্জ উপজেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বীরদপে হাজীগঞ্জবাসিকে ভালো রাখার জন্য দাবিয়ে বেড়াতেন সেই লোকটি আজ করোনায় আক্রান্ত। তাঁর ৪ বছরের শিশু দ্বিজরাজ মায়ের বঞ্চিত হচ্ছে মায়ের আদর থেকে।
তিনি হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বৈশাখী বড়ুয়া। গত ২৯ এপ্রিল তাঁর করোনা রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। এর পর থেকে তিনি সরকারি কোয়ার্টারের এক রুমে পরিবার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা থাকছে।
আরো পড়ুন: হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বৈশাখী বড়ুয়া করোনায় আক্রান্ত
কিন্তু‘ছোট্ট কোমলমতি শিশু পা দুটি উঁচু করে, নরম তুলতুলে হাত দিয়ে শক্ত করে জানালার গ্রিল ধরে উঁকি-ঝুঁকি’ মেরে মাকে দেখার চেষ্টা করছে, আর মা মা বলে ডাকছে বছর চারেকের শিশু ছেলে। তবু সাড়া মিলছে না। মায়ের সাড়া না পেয়ে, চিৎকার, চেঁচামেচি তারপর কাঁদতে শুরু করা।
এভাবেই বাচ্চাটি সারাদিন কেবল মাকে ডাকছে। মায়ের কাছে যেতে চাওয়া ছাড়া আর একটি কথাও বলে না। অথচ মা কক্ষেই অবস্থান করছেন। কোনো সাড়া-শব্দ নেই, নীরবেই বসে আছেন। ছেলের কান্নায় এতটুকু মন গলেনি তার।
এ কেমন মা। ঘরে থেকেও সন্তানের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না। তিনি কি অভিমান করে বসে আছেন, নাকি লুকোচুরি খেলছেন? না তিনি (মা) অভিমানও করেননি, আর লুকোচুরি খেলছেন না। তবে ভবনের একটি কক্ষে বসে নীরবে কাঁদছেন।
আরো পড়ুন: হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের ১৩জনের নমুনা সংগ্রহ
কারণ তিনি করোনা পজেটিভ। তাই শিশু সন্তান দ্বিজরাজসহ পরিবারের সবার কাছ থেকে আলাদা রয়েছেন।
করোনা ঠেকাতে, প্রান্তিক মানুষের সেবা নিশ্চিতকরণে ত্রাণ বিতরণ, কোয়ারেন্টাইন বাস্তবায়ন, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে সম্মুখভাগের যোদ্ধা হয়ে মাঠ প্রশাসনে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট সতর্ক থাকলেও সংক্রমণ এড়ানো সম্ভব হয়নি প্রশাসন ক্যাডারের এ কর্মকর্তা। কখন জানি এ ভাইরাসটি তাকেও আক্রমণ করেছে।
গ ২৭ এপ্রিল নমুনা পরীক্ষা করান তিনি। তবে কোনো উপসর্গ না থাকলেও মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন, সেই কৌতুহলবশত:ই নমুনা পরীক্ষা করান তিনি।
এদিকে সরকারি বাসভবনে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকায় পরিবারের সবার কাছ থেকে আলাদা থাকতে হয় ইউএনওকে। কিন্তু তার একমাত্র শিশু সন্তান কি বুঝে হোম কোয়ারেন্টাইন কি? সারাক্ষণ মা মা বলে চিৎকার-চেঁচামেচি, তারপর কাঁদতে শুরু করা।
আরো পড়ুন: হাজীগঞ্জে ৫৬জনের মধ্যে রিপোর্ট এসছে ৪৯জনের, সবগুলোই নেগেটিভ
এই বিষয়টি ফেসবুক তুলে ধরেছেন, নরসিংদি জেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রেজাউল করিম। তিনি হাজীগঞ্জে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন। পাঠকদের উদ্দেশে তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
আপাত দৃষ্টিতে বাচ্চাদের লুকোচুরি খেলার ছবি এটি। কিন্তু না, এর ভেতরে আছে বুকে চিনচিনে ব্যথার গল্প! আমাদের সবার প্রিয় মানুষটির একমাত্র ছেলে দ্বিজরাজ উঁকি দিয়ে তার মাকে দেখছে। মা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। করোনা শুরুর প্রথম দিন থেকেই উপজেলা আনাচে কানাচে ছোটাছুটি করেছেন উপজেলাকে করোনামুক্ত রাখতে। তিনি তার কাজে সফল কিন্তু নিজে আক্রান্ত…।
উল্লেখ্য, করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি মোকাবেলায় গত ৯ এপ্রিল চাঁদপুর জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করেন জেলা প্রশাসক মাজেদুর রহমান খান। এরপর থেকেই লকডাউন কার্যক্রম ও করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণে জনসমাগম ঠেকাতে হাজীগঞ্জে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করেন ইউএনও বৈশাখী বড়ুয়া।