জীবন যুদ্ধে হার না মানা আলোকিত মানুষ অভিরঞ্জন

  • আপডেট: ০৬:২৫:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯
  • ৩০

শরীফুল ইসলাম:
বৃদ্ধ বয়সে মানুষের জীবনে কঠিন সময় পার করতে হয়। আর এই সময় যদি পরিবার সন্তান অভিভাবক না থাকে, সে অসুস্থ হয়ে জীবন যন্ত্রনাদায়ক হয়ে উঠে। সেই যন্ত্রনা কষ্ট আপনার সামান্য সহযোগিতা কমতে পারে এবং অসুস্থ বৃদ্ধ বয়সের শেষ দিনগুলো একটু আরামদায়ক হতে পারে। বলছিলাম চাঁদপুর শহরের ছায়াবানী এলাকার প্রতাপসাহ রোডের বাসিন্দা অভিরঞ্জন দেবনাথ (৮৮) এর কথা। খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারানোর পর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে পড়ে অভিরঞ্জন দেবনাথের।

পরলোক গমনের আগে তার বাবা ইন্দোলাল দেকনাথ কিছুই রেখে যেতে পারেননি। স্ত্রী এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। তাই দুই বেলা দুমুঠো খাবার জোটানোর জন্য ওই সময় থেকে কাজে নামতে হয় অভিরঞ্জনকে। পেশায় তিনি একজন ভ্রাম্যমান দর্জী। সেলাই মেশিনের সাথে কখন তার জীবন আটকে যায় তা তিনি নিজেও জানেন না। দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে অভিরঞ্জন ফুটপাতে একটি সেলাই মেশিন নিয়ে কাজ করছেন। চাঁদপুর শহরের পালবাজার ব্রীজ সংলগ্ন আসলেই দেখা মিলবে বৃদ্ধ দর্জী অভিরঞ্জন দেবনাথের।

সদিচ্ছা, সুদৃঢ় সংকল্পই মানুষের জীবনে সাফল্য বয়ে এনে তাকে করে তোলে গৌরবান্বিত। এভাবে মানুষ অসাধ্যও সাধন করতে পারে। আর সদিচ্ছা শক্তির প্রভাবে জীবন চলার কণ্টকাকীর্ণ পথের সব বিষাক্ত কাঁটা নিজ হাতে উপড়ে ফেলে বীরদর্পে এগিয়ে যেতে হয় সাফল্যের উচ্চ শিখরে। অভিরঞ্জন দেবনাথ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন পার করছেন। তুবুও নিজের পেশাকে বন্ধ না করে কারো কাছে হাত পাতেননি। মাথার উপর চিকন পলিথিনের ছাউনি আর একটি বসার টুল নিয়ে কাজের ব্যস্ততায় সময় পার করেন অভিরঞ্জন। সারাদিন কাজ করে যেটুকু আয় হয়, তা দিয়ে চলে সোনার সংসার।

অভিরঞ্জন দেবনাথের ছেলে অর্জুন শহরের একটি স্বর্ণের দোকানে কাজ করে। আর মেয়ে অঞ্জলিকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্ত্রী আর এক সন্তানকে নিয়েই চলছে অভিরঞ্জন দেবনাথের সংসার জীবন। ছেলে কাজ করে যা পারে, তাই সহযোগিতা করে থাকে বলে জানান তিনি। স্ত্রী সোনালী রানী দেবনাথ সব সময় পাশে থেকে মনে সাহস যুগিয়েছেন বলেই এখনো কাজ করে চলছি বলে অভিরঞ্জন জানান।

কয়টা টাকার জন্য অসুস্থ শরীর নিয়ে সারাদিন কাজ করি বলে কান্নান ভেঙে পড়েন বৃদ্ধা অভিরঞ্জন দেবনাথ। তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েছি। কিন্তু ভাগ্যের চাকা নড়েনি। পালবাজার এলাকায় প্রায় ৭৫ বছর ধরে দর্জীর কাজ করে আসছি। একটু সৎ ভাবে ভালো থাকার চেষ্টা করেছি। অনেক বয়স হয়েছে, তাই এখন আর আমার কাছে কেউ কাজ করায় না। কোন দিন কাজ থাকলে ১শ’ থেকে দেড়শ টাকা। আর কাজ না থাকলে ৪০-৫০ টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে হয়।

বৃদ্ধ অভিরঞ্জন আরো বলেন, টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে আমার পা স্বাভাবিক ভাবে নাড়াতে পারি না। এই শরীর নিয়ে চলাফেরা করতে খুব কস্ট হয়। এত কস্টের মধ্যেও দর্জীর কাজ করতে হচ্ছে। বর্তমানে পরিবার নিয়ে খুব কস্টে দীন ঝাপন করছি। যেখানে থাকি, তাও আবার ভাড়া বাড়ী। এত কস্টের মধ্যেকি আর জীবন চলে। আমি সরকারি ভাবে কোন সহযোগিতা পাইনা। বয়স্ক ভাতা কিংবা কোন আর্থিক সাহায্য কেউ কোন দিন করেনি। আমাকে যদি চাঁদপুরের প্রশাসন কোন ভাবে সহযোগিতা করে আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।

বৃদ্ধা অসুস্থ অভিরঞ্জন দেবনাথের মত হাজারো মানুষ রয়েছে আমাদের সমাজে। যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সৎ ভাবে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। একমাত্র কাজেই জীবন চলার পথকে সাফল্যের পথে নিয়ে আসবে। অভীষ্ট সাফল্যে পৌঁছতে হলে মানুষকে এমনি সদিচ্ছা পোষণ করেই শত বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে। জীবন যুদ্ধে এমনি একজন অভিরঞ্জন দেবনাথ। তিনি আজ সমাজের কাছে বৃদ্ধ বোঝা নন, তিনি একজন আলোকিত মানুষ।

Tag :

সম্পাদক ও প্রকাশক:
মোঃ মহিউদ্দিন আল আজাদ

মোবাইল : ০১৭১৭-৯৯২০০৯ (নিউজ) বিজ্ঞাপন : ০১৬৭০-৯০৭৩৬৮
ইমেইলঃ notunerkotha@gmail.com

সর্বাধিক পঠিত

পাকিস্তানে আফগানিস্তানের ভয়াবহ হামলা নিহত ১৯

জীবন যুদ্ধে হার না মানা আলোকিত মানুষ অভিরঞ্জন

আপডেট: ০৬:২৫:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শরীফুল ইসলাম:
বৃদ্ধ বয়সে মানুষের জীবনে কঠিন সময় পার করতে হয়। আর এই সময় যদি পরিবার সন্তান অভিভাবক না থাকে, সে অসুস্থ হয়ে জীবন যন্ত্রনাদায়ক হয়ে উঠে। সেই যন্ত্রনা কষ্ট আপনার সামান্য সহযোগিতা কমতে পারে এবং অসুস্থ বৃদ্ধ বয়সের শেষ দিনগুলো একটু আরামদায়ক হতে পারে। বলছিলাম চাঁদপুর শহরের ছায়াবানী এলাকার প্রতাপসাহ রোডের বাসিন্দা অভিরঞ্জন দেবনাথ (৮৮) এর কথা। খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারানোর পর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে পড়ে অভিরঞ্জন দেবনাথের।

পরলোক গমনের আগে তার বাবা ইন্দোলাল দেকনাথ কিছুই রেখে যেতে পারেননি। স্ত্রী এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। তাই দুই বেলা দুমুঠো খাবার জোটানোর জন্য ওই সময় থেকে কাজে নামতে হয় অভিরঞ্জনকে। পেশায় তিনি একজন ভ্রাম্যমান দর্জী। সেলাই মেশিনের সাথে কখন তার জীবন আটকে যায় তা তিনি নিজেও জানেন না। দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে অভিরঞ্জন ফুটপাতে একটি সেলাই মেশিন নিয়ে কাজ করছেন। চাঁদপুর শহরের পালবাজার ব্রীজ সংলগ্ন আসলেই দেখা মিলবে বৃদ্ধ দর্জী অভিরঞ্জন দেবনাথের।

সদিচ্ছা, সুদৃঢ় সংকল্পই মানুষের জীবনে সাফল্য বয়ে এনে তাকে করে তোলে গৌরবান্বিত। এভাবে মানুষ অসাধ্যও সাধন করতে পারে। আর সদিচ্ছা শক্তির প্রভাবে জীবন চলার কণ্টকাকীর্ণ পথের সব বিষাক্ত কাঁটা নিজ হাতে উপড়ে ফেলে বীরদর্পে এগিয়ে যেতে হয় সাফল্যের উচ্চ শিখরে। অভিরঞ্জন দেবনাথ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন পার করছেন। তুবুও নিজের পেশাকে বন্ধ না করে কারো কাছে হাত পাতেননি। মাথার উপর চিকন পলিথিনের ছাউনি আর একটি বসার টুল নিয়ে কাজের ব্যস্ততায় সময় পার করেন অভিরঞ্জন। সারাদিন কাজ করে যেটুকু আয় হয়, তা দিয়ে চলে সোনার সংসার।

অভিরঞ্জন দেবনাথের ছেলে অর্জুন শহরের একটি স্বর্ণের দোকানে কাজ করে। আর মেয়ে অঞ্জলিকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্ত্রী আর এক সন্তানকে নিয়েই চলছে অভিরঞ্জন দেবনাথের সংসার জীবন। ছেলে কাজ করে যা পারে, তাই সহযোগিতা করে থাকে বলে জানান তিনি। স্ত্রী সোনালী রানী দেবনাথ সব সময় পাশে থেকে মনে সাহস যুগিয়েছেন বলেই এখনো কাজ করে চলছি বলে অভিরঞ্জন জানান।

কয়টা টাকার জন্য অসুস্থ শরীর নিয়ে সারাদিন কাজ করি বলে কান্নান ভেঙে পড়েন বৃদ্ধা অভিরঞ্জন দেবনাথ। তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েছি। কিন্তু ভাগ্যের চাকা নড়েনি। পালবাজার এলাকায় প্রায় ৭৫ বছর ধরে দর্জীর কাজ করে আসছি। একটু সৎ ভাবে ভালো থাকার চেষ্টা করেছি। অনেক বয়স হয়েছে, তাই এখন আর আমার কাছে কেউ কাজ করায় না। কোন দিন কাজ থাকলে ১শ’ থেকে দেড়শ টাকা। আর কাজ না থাকলে ৪০-৫০ টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে হয়।

বৃদ্ধ অভিরঞ্জন আরো বলেন, টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে আমার পা স্বাভাবিক ভাবে নাড়াতে পারি না। এই শরীর নিয়ে চলাফেরা করতে খুব কস্ট হয়। এত কস্টের মধ্যেও দর্জীর কাজ করতে হচ্ছে। বর্তমানে পরিবার নিয়ে খুব কস্টে দীন ঝাপন করছি। যেখানে থাকি, তাও আবার ভাড়া বাড়ী। এত কস্টের মধ্যেকি আর জীবন চলে। আমি সরকারি ভাবে কোন সহযোগিতা পাইনা। বয়স্ক ভাতা কিংবা কোন আর্থিক সাহায্য কেউ কোন দিন করেনি। আমাকে যদি চাঁদপুরের প্রশাসন কোন ভাবে সহযোগিতা করে আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।

বৃদ্ধা অসুস্থ অভিরঞ্জন দেবনাথের মত হাজারো মানুষ রয়েছে আমাদের সমাজে। যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সৎ ভাবে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। একমাত্র কাজেই জীবন চলার পথকে সাফল্যের পথে নিয়ে আসবে। অভীষ্ট সাফল্যে পৌঁছতে হলে মানুষকে এমনি সদিচ্ছা পোষণ করেই শত বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে। জীবন যুদ্ধে এমনি একজন অভিরঞ্জন দেবনাথ। তিনি আজ সমাজের কাছে বৃদ্ধ বোঝা নন, তিনি একজন আলোকিত মানুষ।