অনলাইন ডেস্ক:
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়া এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব উত্তরণে বাজেট বরাদ্দ থেকে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করবেন তিনি। রোববার সকাল ১০টায় গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ের বিস্তারিত জানাবেন প্রধানমন্ত্রী।
বৃহস্পতিবার সরকারের দুটি পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করীম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনায় দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব উত্তরণের বিষয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গণভবনে সভা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ সভায় উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। বৈঠকে রোববার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
এছাড়া ওই সভায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন বলে তার সহকারী প্রেস সচিব ইমরুল কায়েস স্বাক্ষরিত আরেক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। নির্দেশনাগুলো হল-
১. করোনাভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।
২. লুকোচুরির দরকার নেই, করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।
৩. পিপিই সাধারণভাবে সবার পরার দরকার নেই। চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবার জন্য পিপিই নিশ্চিত করতে হবে। এই রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্কসহ সব চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত রাখা এবং বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
৫. যারা হোম কোয়ারেন্টিনে বা আইসোলেশনে আছেন, তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে।
৬. নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন।
৭. নদীবেষ্টিত জেলাগুলোয় নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখতে হবে।
৯. পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা। সারা দেশের সব সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।
১০. আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। জাতীয় এ দুর্যোগে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগসহ সব সরকারি কর্মকর্তা যথাযথ ও সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন- এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
১১. ত্রাণ কাজে কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবে না।
১২. দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক যেন অভুক্ত না থাকে। তাদের সাহায্য করতে হবে। খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত তালিকা তৈরি করতে হবে।
১৩. সোশ্যাল সেফটিনেট কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
১৪. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেন স্থবির না হয়, সে বিষয়ে যথাযথ নজর দিতে হবে।
১৫. খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে, অধিক প্রকার ফসল উৎপাদন করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে। কোনো জমি যেন পতিত না থাকে।
১৬. সরবরাহ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে। যাতে বাজার চালু থাকে।
১৭. সাধারণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
১৮. জনস্বার্থে বাংলা নববর্ষের সব অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে, যাতে জনসমাগম না হয়। ঘরে বসে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নববর্ষ উদযাপন করতে হবে।
১৯. স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, সমাজের সব স্তরের জনগণকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রশাসন সবাইকে নিয়ে কাজ করবে।
২০. সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে সমন্বয় করে ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
২১. জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসন ওয়ার্ডভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করে দুস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণ করবেন।
২২. সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যেমন- কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা/ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিক, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, পথশিশু, স্বামী পরিত্যক্ত/বিধবা নারী এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখাসহ ত্রাণ সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
২৩. প্রবীণ নাগরিক ও শিশুদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২৪. দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি (এসওডি) যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য সব সরকারি কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
২৫. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও নিয়মিত বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া মনিটরিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
২৬. আতঙ্কিত হয়ে অতিরিক্ত পণ্য ক্রয় করবেন না। খাদ্যশস্যসহ প্রয়োজনীয় সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
২৭. কৃষকরা নিয়মিত চাষাবাদ চালিয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে।
২৮. সব শিল্প মালিক, ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি পর্যায়ে নিজ নিজ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়িঘর পরিষ্কার রাখবেন।
২৯. শিল্প মালিকরা শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে উৎপাদন অব্যাহত রাখবেন।
৩০. গণমাধ্যমকর্মীরা জনসচেতনতা সৃষ্টিতে যথাযথ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গুজব ও অসত্য তথ্য যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৩১. গুজব রটানো বন্ধ করতে হবে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে নানা গুজব রটানো হচ্ছে। গুজবে কান দেবেন না এবং গুজবে বিচলিত হবেন না।
বাড়িভাড়া মওকুফ, ব্যাংক লোন ও বিদ্যুৎ বিল স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার : প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করীম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়- বাড়িভাড়া মওকুফ, ব্যাংক লোন ও বিদ্যুৎ বিল তিন মাসের জন্য স্থগিত করা, সব অফিসে এক মাসের ছুটির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। বিষয়গুলোকে গুজব হিসেবে উল্লেখ করে এসব অপপ্রচারকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বাড়িভাড়া মওকুফ, ব্যাংক লোন ও বিদ্যুৎ বিল তিন মাসের জন্য স্থগিত, সব অফিসে এক মাসের ছুটি সংক্রান্ত যে গুজবটি ফেসবুকে ভাইরাল করা হচ্ছে তা পুরোপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট। যারা অপপ্রচার চালাচ্ছেন তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার গৃহীত পদক্ষেপ নিজেই অথবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জানাবেন বলেও উল্লেখ করা হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
নিম্ন আয়ের লোকদের বাড়ি গিয়ে ত্রাণ পৌঁছান : করোনাভাইরাসের প্রভাবে গৃহবন্দি হয়ে পড়া সমাজের নিম্ন আয়ের লোকরাও ত্রাণ সহায়তা পাবেন। এ শ্রেণির পরিবারের তালিকা করে তাদের বাড়িতে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামাল।
তিনি প্রতিবেদককে বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত চলমান ছুটির মধ্যে নিম্ন আয়ের পরিবারের অনেকে আর্থিক সংকটে পড়তে পারেন। কিন্তু সংকোচবোধের কারণে তাদের পক্ষে কোথাও ত্রাণের জন্য হাতপাতা কিংবা লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নেয়া সম্ভব হবে না। এজন্য প্রধানমন্ত্রী তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে ত্রাণ সচিব শাহ কামাল বলেন, ‘কোনো ধরনের ত্রাণ সংকট নেই। ইনশাআল্লাহ তাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুদ আছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ডিসিদের কাছে বরাদ্দ দিচ্ছি। এ পর্যন্ত চার দফায় মোট চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪৮ হাজার ৫০০ টন এবং নগদ অর্থ দেয়া হয় প্রায় ১৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও ডিসিদের কাছে চতুর্থ দফার বরাদ্দপত্র পাঠানো হয়। এর মধ্যে চাল রয়েছে ৮ হাজার ৪৫০ টন এবং নগদ টাকার পরিমাণ ৪ কোটি ৭০ লাখ।’
এদিকে বৃহস্পতিবার বিকালে ত্রাণ সচিবের স্বাক্ষরে একটি পত্র জারি করা হয়। যেখানে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে যেসব কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে খাদ্য সমস্যায় আছেন তাদের তালিকা প্রস্তুত করে ত্রাণ দিতে হবে। এদের মধ্যে রয়েছে- প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ব্যক্তি, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিক, রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, চা শ্রমিক, চা বিক্রেতাসহ যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেন তারা এ ত্রাণ কর্মসূচির আওতাভুক্ত হবেন।