অনলাইন ডেস্ক:
বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হওয়া করোনা ভাইরাস থাবা বসিয়েছে বাংলাদেশেও। এ ভাইরাসের ব্যাপকতা রোধে এখনই ব্যারিকেড দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সর্বোচ্চ সচেতনতা ও প্রস্তুতি। যুদ্ধকালীন অবস্থা বিবেচনা করে জনসাধারণকে ঘরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশফেরতদের পাশাপাশি সংক্রমিতদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে খুঁজে বের করে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা।
তারা বলেছেন, ছোটো আগুন দ্রুত নিভিয়ে ফেলুন। নইলে বড়ো আগুন লাগলে নেভানোর মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংকট দেখা দেবে প্রকট। আমেরিকা, ইতালি, ফ্রান্সের মতো দেশ বড়ো আগুন নেভাতে ব্যর্থ হচ্ছে। ঘটনার শুরুতে এক-দুইটা কেসকে গুরুত্ব দেয়নি। অর্থাত্, ছোটো আগুন নিয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ঐ সব দেশেও আগে অল্পসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত ও মারা গিয়েছিল। বাংলাদেশে যেমনটা এখন হচ্ছে। আমেরিকা, ইতালি ও ফ্রান্স প্রথম গুরুত্ব দেয়নি বলে এখন তারা ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন। এখন ঐ সব দেশ করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। কোনো কোনো সরকারপ্রধান বলে ফেলেছেন, আর পারছি না। এখন সবকিছু সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশে আগামী দুই সপ্তাহ করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ‘পিক টাইম’ (সর্বোচ্চ ব্যাপ্তির সময়) বলে মনে করছেন ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা। আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিদেশফেরতদের আসার ওপর নির্ভর করে এ আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই দেশে ভাইরাসের বিস্তার রোধে এ দুই সপ্তাহ সর্বোচ্চ সতর্কতা আরোপ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, করোনা ভাইরাস মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে সবচেয়ে বেশি সময় পেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। কিন্তু তারা সেই ধরনের প্রস্তুতি নেয়নি। এই মহামারি খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে না বলেও তারা সতর্ক করে দিয়েছে।
এদিকে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির সঙ্গে পুরো বিশ্ব এখন লড়াই করছে। ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াই করে ইতিমধ্যে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান সফল হওয়ার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছে দেশগুলো। চীন সরকার একে ‘গণযুদ্ধ’ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ‘ফাইট অন উহান, ফাইট অন চায়না’ কর্মসূচি চালু করে। এ ছাড়া প্রেরণামূলক ছবি, বিজ্ঞাপন তৈরি করে যুদ্ধকালীন প্রচারের মতো প্রচার চালাতে শুরু করে। অন্য দেশগুলোও চীনের নীতি অনুসরণ করে সফল হয়েছে। বাংলাদেশেও যুদ্ধকালীন অবস্থা বিবেচনা করে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরো পড়ুন: করোনা: আগামী ১৪ বিপদজনক সময়, ঘরে থাকার বিকল্প নেই
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনা মোকাবিলায় সময় থাকতে শিক্ষা নেওয়া উচিত। নইলে ব্যাপকতা দেখা দিলে কেউ কাউকে খুঁজে পাবে না। আমেরিকার মতো দেশের এখন টালমাটাল অবস্থা। তাই বিশ্ব থেকে শিক্ষা নিয়ে সবাইকে দুই সপ্তাহ ঘরে থাকতে হবে। আর ঘরে থাকা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ঘরে থেকে নিজে বাঁচুন, পরিবার ও দেশকে বাঁচান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বারবার দেশবাসীর প্রতি এই আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, রোগ হওয়ার আগে প্রতিরোধ দরকার। যেহেতু করোনা ভাইরোসের কোনো প্রতিষেধক নেই, তাই প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। ঘরে থাকার মাধ্যমে এই ভাইরাস ব্যারিকেড দেওয়া সম্ভব হবে। আর এক্ষেত্রে কোনো দয়া দেখানোর সুযোগ নেই। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যা যা করার দরকার তাই করতে হবে। সবারই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তাহলে নিজে, দেশ ও জনগণ রক্ষা পাবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম তিন জনের শরীরে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে, যাদের মধ্যে দুই জন সংক্রমণ নিয়ে এসেছিলেন বিদেশ থেকে। এর ১০ দিনের মাথায় বাংলাদেশে প্রথম মৃত্যুর কথা জানায় আইইডিসিআর। সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা বাড়তে থাকায় সরকার ইতিমধ্যে সারা দেশে ছুটি ঘোষণা করে সবাইকে যার যার বাড়িতে থাকতে বলেছে, বন্ধ রাখা হয়েছে সব ধরনের যানবাহন চলাচল। কিন্তু ঢাকার কিছু কিছু এলাকায়, ঢাকার আশপাশে এবং সারাদেশে ইউনিয়নে, গ্রামে-গঞ্জে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ছে, বাইরে ঘোরাফেরা করছে, চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে।
এদিকে করোনা ভাইরাসজনিত রোগ কোভিড-১৯ এর প্রাথমিক উপসর্গ জ্বর-কাশি হলেও পরে অনেকের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তখন রোগীকে ভেন্টিলেশনে রাখারও প্রয়োজন হতে পারে। ব্যাপক হারে দেখা দিলে ৫০০ কিংবা এক হাজার ভেন্টিলেশনে কোনো কাজ হবে না। ভাইরাসটি যেহেতু সংক্রামক, তাই সবাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিশেষ করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য ঘরে থাকার নীতি অনুসরণ করতে হবে। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসের কোনো কার্যকর ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হয়নি, সুতরাং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ পুরো বিশ্বের গবেষক, চিকিত্সক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মূলত প্রতিরোধকেই এ ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রোধে কার্যকর উপায় বলে মনে করছেন। এর প্রতিরোধের মূল কথা হলো—আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে না আসা আর কারো যদি এ ভাইরাসের কোনো লক্ষণ থাকে কিংবা আক্রান্ত কোনো দেশ থেকে কেউ এসে থাকেন, তাহলে ঘরে কিংবা নির্ধারিত জায়গায় আলাদাভাবে কমপক্ষে ১৪ দিন নির্ধারিত কিছু নিয়ম মেনে অবস্থান করে চিকিত্সা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ কিংবা ‘আইসোলেশন’ এই টার্মগুলোর কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো—গত ১৫ দিনেই বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন ১ লাখের বেশি প্রবাসী। এর মধ্যে সরকারি হিসাবেই মাত্র ২০ হাজার মানুষ আছে কোয়ারেন্টাইনে। তাহলে বাকি প্রায় ৮০ হাজার প্রবাসী এখন পর্যন্ত নজরদারির বাইরে এবং সবার জন্য হুমকি। বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, চারদিকে এত প্রচার-প্রচারণার মধ্যেও মানুষ নিজের ও পরিবারের সবার জন্য মঙ্গল বিবেচনাতেও কেন ঘরে থাকতে চায় না? সবাইকে ঘরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দিতে হবে। ত্রাণ দেওয়ার নামে জনসমাগম সৃষ্টি বিপদ আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।
আরো পড়ুন:চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের প্রশংসনীয় উদ্যোগ “ত্রাণ যাবে বাড়ী”
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতিতে কেউ দেশে এলে তাকে ঘিরে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে একটা উত্সবভাব কাজ করে। প্রবাসীরা অনেকেই বিদেশ থেকে এসে ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে চায় না। তাই এখন বিদেশফেরতদের ঘরে তালা দিয়ে রাখার উপায় খুঁজতে হচ্ছে। এদিকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়ে সরকার সব ছাত্রছাত্রীকে ঘরে থাকতে বলেছে। পরীক্ষা পরীক্ষা করে সারা বছর ফেনা তুলে ফেলা বাপ-মা এ রকম অপ্রত্যাশিত ছুটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করে দিয়েছে। এতেও বিপদ বাড়ছে।
উল্লেখ্য, ২০০৩ সালের সার্স ভাইরাস আক্রমণের পর মহামারিতে জ্বর মাপা চীন নিয়মে পরিণত করেছিল। তাপমাত্রা মাপার জন্য পুলিশ কর্মকর্তারা অনেক জায়গায় বাড়ি বাড়ি গিয়েছিল। অনেক সময় বলপ্রয়োগের ঘটনাও ঘটেছে। এখন কঠোর লকডাউন ঘোষণা করে চীন করোনা সংক্রমণ দমিয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই কেউ ঘর থেকে বের হতে পারেনি। কিছু বিল্ডিং পুরো লকডাউন ছিল। কিছু কমিউনিটি লকডাউন ছিল। কেউ অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে যেত। খাদ্য থেকে শুরু করে ওষুধ, সব দুয়ারে দুয়ারে পাঠানো হয়েছে। চীন সরকার শুরুতে একটু দেরি করলেও পরে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ ঘোষণা করে করোনাকে প্রায় হারিয়ে দিয়েছে।