বিশ্ব-বিখ্যাত ন্যানো সায়েন্টিস্ট ড. জামাল উদ্দিনের সাথে এক দিন

  • আপডেট: ০২:৩২:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ মার্চ ২০২০
  • ২৭

নিজস্ব প্রতিনিধি:
বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানি, যুক্তরাস্ট্রের মেরিল্যান্ডের কোপেন স্ট্যাট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ন্যানো সায়েন্টিস্ট ড. জামাল উদ্দিন শনিবার চাঁদপুরের তিনটি কলেজ পরিদর্শন ও ন্যানো প্রযুক্তি বিষয়ক মোটিভেশনালের উপর বক্তব্য রাখেন। তিনি সকাল ১০টায় চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ, দুপর ১২টায় চাঁদপুর সরকারি কলেজ ও ১.৩০ চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ পরিদর্শন ও শিক্ষার্থীদের সাথে ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে মতবিনিময় করেন। প্রফেসর ড. জামাল উদ্দিন ন্যানো প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান বিশ্বে আয়রন ন্যানো-টেকনোলজি, কপার ন্যানো-টেকনোলজি, সিলভার ন্যানো-টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষত সিলভার ন্যানো-টেকনোলজি কৃষি ক্ষেত্রে প্রয়োগের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি এবং ননটক্সিক এগ্রিকালচার প্রোডাক্ট পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।’’ সোলার প্যানেলে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সভাতে তিনি অবহিত করেন। আলোচনা সভার পর প্রধান আলোচক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন প্রফেসর ড. জামাল উদ্দিন।

হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন বিশ্ব-বিখ্যাত ন্যানো সায়েন্টিস্ট ড. জামাল উদ্দিন।

হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে অনুষ্ঠিত মোটিভেশনালে সভাপতিত্ব করেন কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাসুদ আহমেদ। বক্তব্য রাখেন উপাধ্যক্ষ মো. আনোয়ার হোসেন, কলেজের সহকারি অধ্যাপক সেলিম প্রমূখ।

বক্তব্য শেষে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানি প্রফেসর ন্যানো সায়েন্টিস্ট ড. জামাল উদ্দিন।

বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানি ড. জামাল উদ্দিনের জন্মেছেন ঢাকায়, ১৯৬৭ সালের ১ জানুয়ারি। পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার রাজারগাঁও ইউনিয়নের মেনাপুর গ্রামে। বাবা মরহুম আবদুল জলিল, মা বেগম ফজিলেতুন্নেছা। তাঁদের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে জামাল দ্বিতীয়। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। সাংসারিক কারণে লেখাপড়াটা খুব বেশিদূর নিয়ে যেতে পারেননি। সব সময় চাইতেন ছেলেমেয়েরা সবাই উচ্চশিক্ষিত হোক। সব সময় খেয়াল রাখতেন কোনোভাবেই যেন তাদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন না ঘটে। জামাল উদ্দিন পড়াশোনা করেছেন তেজগাঁও পলিটেকনিক হাই স্কুলে। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৮২ সালে পাস করেছেন এসএসসি। একই কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এইচএসসি। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে। মেধার স্বাক্ষর রেখে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। কিছুদিন কলেজে শিক্ষকতা করেন। এটাই তাঁর প্রথম চাকরি। এরই মধ্যে লাভ করেন জাপান সরকারের মনবুসু স্কলারশিপ। ১৯৯৪ সালে পিএইচডি করতে চলে যান ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ড. তাকিসি ও ন্যুর অধীনে পিএইচডি শেষ করে পেয়ে যান মিশিগান অঙ্গরাজ্যে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ।

চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজে বিশ্ব-বিখ্যাত ন্যানো সায়েন্টিস্ট ড. জামাল উদ্দিনের সাথে শিক্ষার্থীরা।

২০০২ সালে জাপান থেকে চলে যান আমেরিকায়। ম্যারিল্যান্ডের কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শুরু করেন গবেষণা। বিষয় আলোক রসায়ন। সেটি ছিল ন্যানো-পার্টিকলসের (অতি ক্ষুদ্র সূক্ষ্ম কণা) কাজ। কোয়ান্টাম ডটস দিয়ে তৈরি করতে হতো সোলার সেল। সে বছরই খণ্ডকালীন শিক্ষকতা শুরু করেন বাল্টিমোর কমিউনিটি কলেজ ও টাউসেন ইউনিভার্সিটিতে।

২০০৫ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। দুই বছর পর হন সহকারী অধ্যাপক। এখন তিনি স্থায়ী সহযোগী অধ্যাপক।

শিক্ষা, গবেষণা ও জনসংযোগে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ইউনিভার্সিটি সিসটেম অব ম্যারিল্যান্ড (ইউএসএম) প্রতিবছর ‘উইলসন এইচ এলকিনস প্রফেসরশিপ’ দেয়। গত বছর বিরল এই সম্মাননাটি লাভ করেছেন ড. জামাল উদ্দিন। সঙ্গে পেয়েছেন ৬৫ হাজার মার্কিন ডলার (৫১ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ টাকা)। এই টাকা ব্যয় করতে হয় ছাত্র ও সহযোগীদের নিয়ে গবেষণার কাজে।

ড. জামাল সে কাজও শুরু করে দিয়েছেন জোরেশোরে। যুক্তরাষ্ট্রের কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটির সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাথমেটিকস (এসটিইএম) সেন্টারে ছাত্রদের নিয়ে চালাচ্ছেন গবেষণা। ২০০৫ সালে যোগ দেন কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। ২০০৭ সালে গড়ে তোলেন ন্যানো-টেকনোলজি সেন্টার। তাঁরই পরিচালনায় চলে রিসার্চ সেন্টারটি। পাশাপাশি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করেন নতুন একটি কোর্সথন্যানো-টেকনোলজি অ্যান্ড সোসাইটি। কোর্সটির মাধ্যমে ছাত্ররা ন্যানো-টেকনোলজি নিয়ে কেবল গবেষণাই নয়, অভিজ্ঞতা-বিনিময়েরও সুযোগ পাচ্ছে। সেসব আলোচনায় পদার্থ, রসায়ন ও জীববিদ্যার মাধ্যমে ন্যানো-সায়েন্স, ন্যানো-মেডিসিন ও ন্যানো-টেকনোলজির নতুন কিছু আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা জোগান ড. জামাল।

চাঁদপুর সরকারি কলেজে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন বিশ্ব-বিখ্যাত ন্যানো সায়েন্টিস্ট ড. জামাল উদ্দিন।

ড. জামাল উদ্দিন ও তাঁর গবেষকদলের জন্য ২০১০ সালের অক্টোবর মাসটি ছিল একেবারেই অন্য রকম। নতুন এক ইতিহাস গড়ে তাঁরা জানান দেন বিশ্বকে। এই গবেষণাকর্মই তাঁদের নিয়ে আসে জনসমক্ষে। নতুন সে গবেষণায় তাঁরা বহুগুণে বাড়িয়ে দেন সোলার এনার্জি সেলের ক্ষমতা। প্রকল্পটিতে সব ধরনের সহযোগিতা করেছে ম্যারিল্যান্ড টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে ব্যয় করেছে ৮৯ হাজার মার্কিন ডলার।

২০১০ সালের ২৬ অক্টোবর ড. জামালের নেতৃত্বে কপিনের গবেষকদল ম্যারিল্যান্ড ফোর্ট ডেট্রিক আর্মি রিসার্চ ল্যাবে উপস্থাপন করেন উদ্ভাবন। কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের পাশাপাশি সেদিন উপস্থিত ছিলেন অনেক ন্যানোটেক বিজ্ঞানী, গবেষক ও পরিদর্শকও। এই আবিষ্কারের আগে সোলার সেলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য এনার্জির মাত্রা ছিল ৪২,৩ শতাংশ। তৈরি করেছিল স্পায়ার সেমিকন্ডাক্টর নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারও আগে ৪১.৬ শতাংশ সোলার এনার্জি তৈরি করেছিল বোয়িং স্পেকট্রোল্যাব। সেই এনার্জিকে বাড়িয়ে ৪৩.৪ শতাংশ মাত্রায় নিয়ে যায় ড. জামাল ও তাঁর দল। তখন পর্যন্ত এটিই বিশ্বে সোলার এনার্জির উৎপাদনের সর্বোচ্চ মাত্রা। তবে সেই অর্জন ধরে রাখা যায়নি। পরের বছরই সোলার জাংশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান এনার্জির মাত্রা ০.১ মাত্রা বাড়াতে সক্ষম হয়। থেমে থাকেননি জামাল উদ্দিনও। ছাত্রদের নিয়ে শুরু করেন সোলার এনার্জি সেলের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আরো গবেষণা। ফলাফলও পান কিছুদিনের মধ্যে। গত বছর সোলার এনার্জির শক্তি বাড়িয়ে নিয়ে যান ৪৪.৭ শংতাশে, যা তাঁদেরই আগের আবিষ্কার থেকে ১.৩ শতাংশ বেশি। এটাই এখন পর্যন্ত বিশ্বে সোলার সেলের শক্তি উৎপাদনের সর্বোচ্চ মাত্রা। তবে প্রধান গবেষক আশা করছেন, শক্তির এই উৎপাদন ৫০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব। নিজের উদ্ভাবনের বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘এটা সত্যিই রোমাঞ্চকর ও আশাব্যঞ্জক, যা ন্যানো-টেকনোলজির ওপর গবেষণায় আমাদের আরো উৎসাহ জোগাবে।’ গবেষকদলটি এই আবিষ্কারের পাশাপাশি আরো উদ্ভাবন করেছেন নাইট ভিশন গগলস, মহাকাশে উড়তে সক্ষম সোলার প্রপেলার, বিনা রক্তপাতে ডায়াবেটিসের সুগার মাপার পদ্ধতি, লেজার রশ্মির সাহায্যে ক্যান্সারের জীবাণু শনাক্তকরণ, ন্যানো-টেকনোলজির মাধ্যমে সার্জারি ইত্যাদি। এসব আবিষ্কারের সময় শিক্ষককে সারাক্ষণ সহযোগিতা করেছে ছাত্ররা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুনীল যাদব, থমাস গেইল, আর্চার, আসিফ আহমেদ, পপি আক্তার, ফিলিপ এঙ্রে প্রমুখ। উদ্ভাবনের পাশাপাশি ড. জামাল লিখছেনও দুই হাতে। তাঁর গবেষণাধর্মী লেখাগুলো প্রকাশিত হচ্ছে পৃথিবীর বিখ্যাত স্বীকৃত বিজ্ঞান জার্নালে। পাশাপাশি পেয়েছেন স্বীকৃতি। বিশেষ করে আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালগুলোতে। ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের ‘ডেইলি রেকর্ড’ পত্রিকা তাঁকে দিয়েছে ২০১১ সালে অন্যতম সেরা উদ্ভাবকের পুরস্কার। বাল্টিমোরের আমেরিকান ভিশনারি আর্ট মিউজিয়ামে দেওয়া হয়েছে সংবর্ধনা। ঢাকা থেকে জাপান, তারপর আমেরিকা ড. জামাল উদ্দিন এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের বিজ্ঞানী। তবে এই এত কাজের কাজির শুরুটা হয়েছিল ঢাকায়ই। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

ড. জামাল উদ্দিন বলেন, আমার ইচ্ছে বাংলাদেশে ন্যানো টেকনোলজি বিষয়ে একটা গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য আমি নিজ দেশে এখন থেকে প্রতি বছরই কয়েকবার আসার চেষ্টা করবো। বিদেশে আমি অনেক বড় হয়ে লাভ কি? যদি নিজের দেশের সেবা করতে না পারি। দেশের গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কথা শুনবো। তাদের সাথে নিয়ে দেশের সেবাই এগিয়ে যাবো।

Tag :
সর্বাধিক পঠিত

হাজীগঞ্জে কিটনাশক পানে স্কুলছাত্রীর আ ত্ম হ ত্যা!

বিশ্ব-বিখ্যাত ন্যানো সায়েন্টিস্ট ড. জামাল উদ্দিনের সাথে এক দিন

আপডেট: ০২:৩২:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ মার্চ ২০২০

নিজস্ব প্রতিনিধি:
বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানি, যুক্তরাস্ট্রের মেরিল্যান্ডের কোপেন স্ট্যাট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ন্যানো সায়েন্টিস্ট ড. জামাল উদ্দিন শনিবার চাঁদপুরের তিনটি কলেজ পরিদর্শন ও ন্যানো প্রযুক্তি বিষয়ক মোটিভেশনালের উপর বক্তব্য রাখেন। তিনি সকাল ১০টায় চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ, দুপর ১২টায় চাঁদপুর সরকারি কলেজ ও ১.৩০ চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ পরিদর্শন ও শিক্ষার্থীদের সাথে ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে মতবিনিময় করেন। প্রফেসর ড. জামাল উদ্দিন ন্যানো প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান বিশ্বে আয়রন ন্যানো-টেকনোলজি, কপার ন্যানো-টেকনোলজি, সিলভার ন্যানো-টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষত সিলভার ন্যানো-টেকনোলজি কৃষি ক্ষেত্রে প্রয়োগের মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি এবং ননটক্সিক এগ্রিকালচার প্রোডাক্ট পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।’’ সোলার প্যানেলে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সভাতে তিনি অবহিত করেন। আলোচনা সভার পর প্রধান আলোচক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন প্রফেসর ড. জামাল উদ্দিন।

হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন বিশ্ব-বিখ্যাত ন্যানো সায়েন্টিস্ট ড. জামাল উদ্দিন।

হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে অনুষ্ঠিত মোটিভেশনালে সভাপতিত্ব করেন কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাসুদ আহমেদ। বক্তব্য রাখেন উপাধ্যক্ষ মো. আনোয়ার হোসেন, কলেজের সহকারি অধ্যাপক সেলিম প্রমূখ।

বক্তব্য শেষে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানি প্রফেসর ন্যানো সায়েন্টিস্ট ড. জামাল উদ্দিন।

বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানি ড. জামাল উদ্দিনের জন্মেছেন ঢাকায়, ১৯৬৭ সালের ১ জানুয়ারি। পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার রাজারগাঁও ইউনিয়নের মেনাপুর গ্রামে। বাবা মরহুম আবদুল জলিল, মা বেগম ফজিলেতুন্নেছা। তাঁদের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে জামাল দ্বিতীয়। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। সাংসারিক কারণে লেখাপড়াটা খুব বেশিদূর নিয়ে যেতে পারেননি। সব সময় চাইতেন ছেলেমেয়েরা সবাই উচ্চশিক্ষিত হোক। সব সময় খেয়াল রাখতেন কোনোভাবেই যেন তাদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন না ঘটে। জামাল উদ্দিন পড়াশোনা করেছেন তেজগাঁও পলিটেকনিক হাই স্কুলে। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৮২ সালে পাস করেছেন এসএসসি। একই কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে এইচএসসি। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে। মেধার স্বাক্ষর রেখে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। কিছুদিন কলেজে শিক্ষকতা করেন। এটাই তাঁর প্রথম চাকরি। এরই মধ্যে লাভ করেন জাপান সরকারের মনবুসু স্কলারশিপ। ১৯৯৪ সালে পিএইচডি করতে চলে যান ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ড. তাকিসি ও ন্যুর অধীনে পিএইচডি শেষ করে পেয়ে যান মিশিগান অঙ্গরাজ্যে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ।

চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজে বিশ্ব-বিখ্যাত ন্যানো সায়েন্টিস্ট ড. জামাল উদ্দিনের সাথে শিক্ষার্থীরা।

২০০২ সালে জাপান থেকে চলে যান আমেরিকায়। ম্যারিল্যান্ডের কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শুরু করেন গবেষণা। বিষয় আলোক রসায়ন। সেটি ছিল ন্যানো-পার্টিকলসের (অতি ক্ষুদ্র সূক্ষ্ম কণা) কাজ। কোয়ান্টাম ডটস দিয়ে তৈরি করতে হতো সোলার সেল। সে বছরই খণ্ডকালীন শিক্ষকতা শুরু করেন বাল্টিমোর কমিউনিটি কলেজ ও টাউসেন ইউনিভার্সিটিতে।

২০০৫ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। দুই বছর পর হন সহকারী অধ্যাপক। এখন তিনি স্থায়ী সহযোগী অধ্যাপক।

শিক্ষা, গবেষণা ও জনসংযোগে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ইউনিভার্সিটি সিসটেম অব ম্যারিল্যান্ড (ইউএসএম) প্রতিবছর ‘উইলসন এইচ এলকিনস প্রফেসরশিপ’ দেয়। গত বছর বিরল এই সম্মাননাটি লাভ করেছেন ড. জামাল উদ্দিন। সঙ্গে পেয়েছেন ৬৫ হাজার মার্কিন ডলার (৫১ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ টাকা)। এই টাকা ব্যয় করতে হয় ছাত্র ও সহযোগীদের নিয়ে গবেষণার কাজে।

ড. জামাল সে কাজও শুরু করে দিয়েছেন জোরেশোরে। যুক্তরাষ্ট্রের কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটির সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাথমেটিকস (এসটিইএম) সেন্টারে ছাত্রদের নিয়ে চালাচ্ছেন গবেষণা। ২০০৫ সালে যোগ দেন কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। ২০০৭ সালে গড়ে তোলেন ন্যানো-টেকনোলজি সেন্টার। তাঁরই পরিচালনায় চলে রিসার্চ সেন্টারটি। পাশাপাশি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করেন নতুন একটি কোর্সথন্যানো-টেকনোলজি অ্যান্ড সোসাইটি। কোর্সটির মাধ্যমে ছাত্ররা ন্যানো-টেকনোলজি নিয়ে কেবল গবেষণাই নয়, অভিজ্ঞতা-বিনিময়েরও সুযোগ পাচ্ছে। সেসব আলোচনায় পদার্থ, রসায়ন ও জীববিদ্যার মাধ্যমে ন্যানো-সায়েন্স, ন্যানো-মেডিসিন ও ন্যানো-টেকনোলজির নতুন কিছু আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা জোগান ড. জামাল।

চাঁদপুর সরকারি কলেজে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন বিশ্ব-বিখ্যাত ন্যানো সায়েন্টিস্ট ড. জামাল উদ্দিন।

ড. জামাল উদ্দিন ও তাঁর গবেষকদলের জন্য ২০১০ সালের অক্টোবর মাসটি ছিল একেবারেই অন্য রকম। নতুন এক ইতিহাস গড়ে তাঁরা জানান দেন বিশ্বকে। এই গবেষণাকর্মই তাঁদের নিয়ে আসে জনসমক্ষে। নতুন সে গবেষণায় তাঁরা বহুগুণে বাড়িয়ে দেন সোলার এনার্জি সেলের ক্ষমতা। প্রকল্পটিতে সব ধরনের সহযোগিতা করেছে ম্যারিল্যান্ড টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে ব্যয় করেছে ৮৯ হাজার মার্কিন ডলার।

২০১০ সালের ২৬ অক্টোবর ড. জামালের নেতৃত্বে কপিনের গবেষকদল ম্যারিল্যান্ড ফোর্ট ডেট্রিক আর্মি রিসার্চ ল্যাবে উপস্থাপন করেন উদ্ভাবন। কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের পাশাপাশি সেদিন উপস্থিত ছিলেন অনেক ন্যানোটেক বিজ্ঞানী, গবেষক ও পরিদর্শকও। এই আবিষ্কারের আগে সোলার সেলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য এনার্জির মাত্রা ছিল ৪২,৩ শতাংশ। তৈরি করেছিল স্পায়ার সেমিকন্ডাক্টর নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারও আগে ৪১.৬ শতাংশ সোলার এনার্জি তৈরি করেছিল বোয়িং স্পেকট্রোল্যাব। সেই এনার্জিকে বাড়িয়ে ৪৩.৪ শতাংশ মাত্রায় নিয়ে যায় ড. জামাল ও তাঁর দল। তখন পর্যন্ত এটিই বিশ্বে সোলার এনার্জির উৎপাদনের সর্বোচ্চ মাত্রা। তবে সেই অর্জন ধরে রাখা যায়নি। পরের বছরই সোলার জাংশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান এনার্জির মাত্রা ০.১ মাত্রা বাড়াতে সক্ষম হয়। থেমে থাকেননি জামাল উদ্দিনও। ছাত্রদের নিয়ে শুরু করেন সোলার এনার্জি সেলের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আরো গবেষণা। ফলাফলও পান কিছুদিনের মধ্যে। গত বছর সোলার এনার্জির শক্তি বাড়িয়ে নিয়ে যান ৪৪.৭ শংতাশে, যা তাঁদেরই আগের আবিষ্কার থেকে ১.৩ শতাংশ বেশি। এটাই এখন পর্যন্ত বিশ্বে সোলার সেলের শক্তি উৎপাদনের সর্বোচ্চ মাত্রা। তবে প্রধান গবেষক আশা করছেন, শক্তির এই উৎপাদন ৫০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব। নিজের উদ্ভাবনের বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘এটা সত্যিই রোমাঞ্চকর ও আশাব্যঞ্জক, যা ন্যানো-টেকনোলজির ওপর গবেষণায় আমাদের আরো উৎসাহ জোগাবে।’ গবেষকদলটি এই আবিষ্কারের পাশাপাশি আরো উদ্ভাবন করেছেন নাইট ভিশন গগলস, মহাকাশে উড়তে সক্ষম সোলার প্রপেলার, বিনা রক্তপাতে ডায়াবেটিসের সুগার মাপার পদ্ধতি, লেজার রশ্মির সাহায্যে ক্যান্সারের জীবাণু শনাক্তকরণ, ন্যানো-টেকনোলজির মাধ্যমে সার্জারি ইত্যাদি। এসব আবিষ্কারের সময় শিক্ষককে সারাক্ষণ সহযোগিতা করেছে ছাত্ররা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুনীল যাদব, থমাস গেইল, আর্চার, আসিফ আহমেদ, পপি আক্তার, ফিলিপ এঙ্রে প্রমুখ। উদ্ভাবনের পাশাপাশি ড. জামাল লিখছেনও দুই হাতে। তাঁর গবেষণাধর্মী লেখাগুলো প্রকাশিত হচ্ছে পৃথিবীর বিখ্যাত স্বীকৃত বিজ্ঞান জার্নালে। পাশাপাশি পেয়েছেন স্বীকৃতি। বিশেষ করে আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালগুলোতে। ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের ‘ডেইলি রেকর্ড’ পত্রিকা তাঁকে দিয়েছে ২০১১ সালে অন্যতম সেরা উদ্ভাবকের পুরস্কার। বাল্টিমোরের আমেরিকান ভিশনারি আর্ট মিউজিয়ামে দেওয়া হয়েছে সংবর্ধনা। ঢাকা থেকে জাপান, তারপর আমেরিকা ড. জামাল উদ্দিন এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের বিজ্ঞানী। তবে এই এত কাজের কাজির শুরুটা হয়েছিল ঢাকায়ই। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

ড. জামাল উদ্দিন বলেন, আমার ইচ্ছে বাংলাদেশে ন্যানো টেকনোলজি বিষয়ে একটা গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য আমি নিজ দেশে এখন থেকে প্রতি বছরই কয়েকবার আসার চেষ্টা করবো। বিদেশে আমি অনেক বড় হয়ে লাভ কি? যদি নিজের দেশের সেবা করতে না পারি। দেশের গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কথা শুনবো। তাদের সাথে নিয়ে দেশের সেবাই এগিয়ে যাবো।