পাপিয়ার ডেরায় যাতায়াতকারী ভিআইপিরা ভিডিও ফাঁসের আতঙ্কে

  • আপডেট: ০৯:৩৭:০৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ মার্চ ২০২০
  • ২৬

যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ডেরায় যাতায়াতকারী ভিআইপিরা ভিডিও ফাঁসের আশঙ্কায় রয়েছেন। ইতিমধ্যে একাধিক ভিআইপির নাম সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।

এর মধ্যে পাপিয়ার ঘনিষ্ঠ হিসেবে আরও ৩ প্রভাবশালীর নাম এসেছে যুগান্তরের হাতে। যাদের একজন জনৈক রাজনীতিবিদ মুরাদ, ব্যবসায়ী বজলুর রহমান ও স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী প্রেম।

এ ছাড়া শুধু ওয়েস্টিন নয়, রাজধানীর অভিজাত এলাকায় পাপিয়ার আরও অনেক অভিজাত ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে।

যাদের মধ্যে মহিলা যুবলীগের আরও কয়েকজনের আমলনামা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। শিগগির তাদের বিরুদ্ধেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হবে। ইতিমধ্যে সন্দেহভাজনদের নজরদারির মধ্যে আনা হয়েছে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে সমাজের যেসব ডাকসাইটে দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী পাপিয়াদের ডেরায় প্রটোকল ছাড়া হাজির হতেন, তারা এখন গোপন ভিডিও ফাঁসের আতঙ্কে আছেন।

অনেকের বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের তথ্যও জানে অন্ধকার জগতের এই পাপিয়ারা। দুর্নীতি সংক্রান্ত বড় বড় কাজের লেনদেনের সাক্ষীও এদের কয়েকজন।

তাদের ধারণা, পাপিয়ার সহযোগীরা যে কোনো সময় তাদের গোপন ভিডিও ক্লিপ ছেড়ে দিতে পারে। এমনটা হলে অনেকেরই অবস্থা হবে জামালপুরের আলোচিত ডিসি আহমেদুল কবিরের মতো।

এদিকে পাপিয়াকাণ্ডে আলোচনার তুঙ্গে থাকা গুলশানের পাঁচতারকা হোটেল ওয়েস্টিনের মদ বেচাকেনার যাবতীয় তথ্য তলব করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (নারকোটিক্স)।

একই সঙ্গে হোটেলে আগত অতিথিদের কাছে কীভাবে মদ সরবরাহ করা হয়, তাও জানাতে বলা হয়েছে ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষকে।

সূত্র জানায়, ওয়েস্টিন হোটেলে মোট ৭টি মদের বার লাইসেন্স রয়েছে। এগুলো হল : হোটেলের ২৩ তলায় প্রাগো বার, ৬ তলায় সুইমিং পুল বার এবং তৃতীয় তলায় আছে টেস্ট বার, লিভিং রুম বার, লবি বার, ডেইলি ট্রিটস বার, ব্যাংকোয়েট বার ও গেস্টরুম বার।

এসব বারে মজুদকৃত বিদেশি মদ-বিয়ার আমদানির কাগজপত্র চেয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। একই সঙ্গে হোটেলে মজুদকৃত মদ ও মদজাতীয় পানীয় কাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে, তারও তালিকা দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গুলশান সার্কেলের ইন্সপেক্টর শামসুল কবির যুগান্তরকে বলেন, ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে বলেছে তারা শুধু পারমিটধারী ও বিদেশি নাগরিকদের কাছেই মদ বিক্রি করে। তবে আমরা বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করে দেখব। কারণ, আইন অনুযায়ী অনুমোদিত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও কাছে মদ বিক্রির সুযোগ নেই।

সূত্র জানায়, ওয়েস্টিন হোটেলে ফ্রি স্টাইলে মদ বিক্রির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। হোটেলের সব কটি বারে আমদানি নিষিদ্ধ বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ-বিয়ারের মজুদ রয়েছে। চাইলে যে কেউ হোটেলের ২৩ তলার বারে গিয়ে মদ পান করতে পারেন।

লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে প্রতিদিন সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত গান-বাজনারও আয়োজন করা হয়। গভীর রাতে রাশিয়ান তরুণীদের নাচ ও গানের পর্ব শুরু হয়। এ সময় মিউজিকের তালে তালে চলে মদপান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়েস্টিন হোটেলের সাবেক এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, চোরাই বাজার থেকে ডিউটি ফ্রি মদ সংগ্রহ করে ওয়েস্টিন হোটেলে তা বিক্রি করা হয় উচ্চমূল্যে। বাইরের বারে যেখানে এক পেগ প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের হুইস্কির দাম চারশ’ টাকা, ওয়েস্টিনে তা বিক্রি করা হয় ১২শ’ টাকা।

এভাবে অতি মুনাফায় পকেট ভারি করছে ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া হোটেল কক্ষে মদ পরিবেশনের ক্ষেত্রেও নিয়মকানুনের কোনো বালাই নেই। যে কেউ রুম বুকিং দিলেই তার কাছে মদ সরবরাহ করা হয়।

অথচ আইন অনুযায়ী বিদেশি নাগরিক অথবা পারমিটধারী ছাড়া আর কারও কাছেই মদ পরিবেশনের নিয়ম নেই। হোটেলের মালিক নূর আলী প্রভাবশালী হওয়ায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বা অন্য কোনো সংস্থা কখনোই এ বিষয়ে কৈফিয়ত চায় না।

বরং উল্টো ওয়েস্টিন থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সব অনিয়ম জায়েজ করে থাকে। ওয়েস্টিন হোটেলে রুম বুকিংয়ের ক্ষেত্রেও নানা ধরনের অনিয়ম করা হয়।

একজনের নামে রুম বুকিং দিয়ে অন্যজনকে সেখানে থাকতে দেয়া হয়। হোটেলে আয়োজিত ডিজে পার্টিতে আসা অতিথির কাছে বিশেষ মূল্যে স্বল্প সময়ের জন্যও রুম দেয়া হয়।

এমনকি একই রুম এক রাতের জন্য একাধিক জনের কাছে ভাড়া দেয় ওয়েস্টিন। এভাবে পাঁচতারকা হোটেলে কয়েক ঘণ্টার জন্য রুম নিয়ে অনেকেই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিরাপদ পথ খুঁজে পায়।

সূত্র জানায়, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে ওয়েস্টিন হোটেলে দুটি বিশেষ পার্টির আয়োজন করা হয়। এর একটি ২৩ তলায়। অপরটির আয়োজন হয় হোটেলের ৬ তলায় সুইমিং পুলঘেঁষা বারে। এ দুই পার্টির আয়োজক ছিলেন জনৈক জুডো এবং ডিজে প্রিন্স।

এর মধ্যে ৬ তলার পুল সাইড বারের ভেন্যুটি শেষ মুহূর্তে পাপিয়াকে দেয়ার জন্য ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ জুডোর বুকিং বাতিলের চেষ্টা করে। ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ এ জন্য বুকিংয়ের দ্বিগুণ অর্থ ফেরতের প্রস্তাব দেয়। পরে জানা যায়, মাত্র ২০ জন আমন্ত্রিত অতিথি নিয়ে বিশেষ পার্টির আয়োজন করার কথা ছিল পাপিয়ার।

সূত্র জানায়, পাপিয়ার সঙ্গে গ্রেফতার শেখ তাইয়েবা ওরফে নূর হাই সোসাইটিতে একাধিক নামে পরিচিত। কোথাও তিনি শুধু নূর, আবার কোথাও তিনি নিশি নামেই বেশি পরিচিত।

রাজধানীর অভিজাত ক্লাব ও মদের বারে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। শেখ তাইয়েবার সাবেক এক বয়ফ্রেন্ড যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত রাত ৮টার পর তিনি ক্লাবে আসতেন। তার গ্রামের বাড়ি গাজীপুরে হলেও বনানী এলাকায় রয়েছে নিজস্ব ফ্ল্যাট। একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিকের ছেলে জনৈক আশিফের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুব মহিলা লীগের এক নেত্রী যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে পাপিয়ার অবাধ যাতায়াত ছিল। এমনও হয়েছে- একজন সচিবের দফতরে ওয়েটিং রুমভর্তি দর্শনার্থী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সাক্ষাৎ পাননি। স্যার গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আছেন বলে তার পিএস অনেককে ফিরিয়ে দিয়েছেন। অথচ রুমের ভেতরে সচিব স্যার পাপিয়ার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খোশগল্পে মত্ত।

একাধিক প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে থাকলেও পাপিয়ার ফোন এলে তাৎক্ষণিক ফোন ধরেন। জনৈক সচিবের কাছে জান্নাতুল মাওয়া নামের এক তরুণীকে পাঠাতেন পাপিয়া। সচিব তার মোবাইল ফোনে ওই তরুণীর মোবাইল নম্বর সেভ করেন ‘মাওয়া ফেরিঘাট নামে’। যাতে স্ত্রী বা পরিবারের সদস্যরা তার লাম্পট্যের বিষয়টি কখনও টের না পান।

সূত্র জানায়, পাপিয়া দরিদ্র ঘরের অনেক তরুণীকে চাকরির প্রলোভন দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এরপর চড়া মেকআপ আর পাশ্চাত্য পোশাকে তাদের অনেককে মডেল বানানো হতো। পেশাদার ফ্যাশন ফটোগ্রাফার দিয়ে ছবি তোলায় গ্রামের তরুণী রাতারাতি শোবিজের মডেলে পরিণত হন। এসব কথিত মডেলের ছবি ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ভাইবার, হোয়্যাটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারে পাঠাতেন পাপিয়া। পছন্দ হলে বুক করার জন্য পাপিয়াকে অনুরোধ করতে হতো।

সূত্র বলছে, এভাবে গ্রাম থেকে আসা অনেক তরুণী পাপিয়ার অপরাধ জগতে মিশে নিজেদের ভাগ্যের চাকা রাতারাতি ঘুরিয়েছেন। আবার অনেকেই চাকরির খোঁজে পাপিয়ার কাছে ধরা দেয়ার পর এই নরকে পা রাখতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ পাপের জগৎ থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলেও পারেননি।

কারণ, তাদের কারও কারও একান্ত মুহূর্তের ভিডিও গোপনে ধারণ করে রাখেন পাপিয়া। এসব ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে অনেক তরুণীকে ব্ল্যাকমেইল করেন তিনি।

ওয়েস্টিন হোটেলে ডিজে পার্টির এক আয়োজক যুগান্তরকে বলেন, পাপিয়ার উত্থান শুরু হয় ২০১২/১৩ সালের দিকে। তখন তিনি বিভিন্ন পার্টিতে এসে ক্লায়েন্ট (খদ্দের) সংগ্রহ করতেন। তাছাড়া সুন্দরী পার্টিগার্লদেরও নম্বর নিয়ে যেতেন তিনি। একবার র‌্যাডিশন হোটেলে দলবলসহ পাপিয়ার জোরপূর্বক প্রবেশের ঘটনায় বড় ধরনের হাঙ্গামা হয়।

পাপিয়ার সঙ্গে জনৈক যুবলীগ নেত্রী মনি হইহল্লা করেন। একপর্যায়ে তার লোকজন কয়েক রাউন্ড পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করে (জিডি) পার্টির আয়োজকরা। অজ্ঞাত কারণে পরে অবশ্য এ ঘটনা আর বেশিদূর এগোয়নি।

Tag :
সর্বাধিক পঠিত

অধ্যক্ষ চিন্ময় দাস ইস্যুতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি যা বললো

পাপিয়ার ডেরায় যাতায়াতকারী ভিআইপিরা ভিডিও ফাঁসের আতঙ্কে

আপডেট: ০৯:৩৭:০৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ মার্চ ২০২০

যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ডেরায় যাতায়াতকারী ভিআইপিরা ভিডিও ফাঁসের আশঙ্কায় রয়েছেন। ইতিমধ্যে একাধিক ভিআইপির নাম সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।

এর মধ্যে পাপিয়ার ঘনিষ্ঠ হিসেবে আরও ৩ প্রভাবশালীর নাম এসেছে যুগান্তরের হাতে। যাদের একজন জনৈক রাজনীতিবিদ মুরাদ, ব্যবসায়ী বজলুর রহমান ও স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী প্রেম।

এ ছাড়া শুধু ওয়েস্টিন নয়, রাজধানীর অভিজাত এলাকায় পাপিয়ার আরও অনেক অভিজাত ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে।

যাদের মধ্যে মহিলা যুবলীগের আরও কয়েকজনের আমলনামা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। শিগগির তাদের বিরুদ্ধেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হবে। ইতিমধ্যে সন্দেহভাজনদের নজরদারির মধ্যে আনা হয়েছে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে সমাজের যেসব ডাকসাইটে দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী পাপিয়াদের ডেরায় প্রটোকল ছাড়া হাজির হতেন, তারা এখন গোপন ভিডিও ফাঁসের আতঙ্কে আছেন।

অনেকের বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের তথ্যও জানে অন্ধকার জগতের এই পাপিয়ারা। দুর্নীতি সংক্রান্ত বড় বড় কাজের লেনদেনের সাক্ষীও এদের কয়েকজন।

তাদের ধারণা, পাপিয়ার সহযোগীরা যে কোনো সময় তাদের গোপন ভিডিও ক্লিপ ছেড়ে দিতে পারে। এমনটা হলে অনেকেরই অবস্থা হবে জামালপুরের আলোচিত ডিসি আহমেদুল কবিরের মতো।

এদিকে পাপিয়াকাণ্ডে আলোচনার তুঙ্গে থাকা গুলশানের পাঁচতারকা হোটেল ওয়েস্টিনের মদ বেচাকেনার যাবতীয় তথ্য তলব করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (নারকোটিক্স)।

একই সঙ্গে হোটেলে আগত অতিথিদের কাছে কীভাবে মদ সরবরাহ করা হয়, তাও জানাতে বলা হয়েছে ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষকে।

সূত্র জানায়, ওয়েস্টিন হোটেলে মোট ৭টি মদের বার লাইসেন্স রয়েছে। এগুলো হল : হোটেলের ২৩ তলায় প্রাগো বার, ৬ তলায় সুইমিং পুল বার এবং তৃতীয় তলায় আছে টেস্ট বার, লিভিং রুম বার, লবি বার, ডেইলি ট্রিটস বার, ব্যাংকোয়েট বার ও গেস্টরুম বার।

এসব বারে মজুদকৃত বিদেশি মদ-বিয়ার আমদানির কাগজপত্র চেয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। একই সঙ্গে হোটেলে মজুদকৃত মদ ও মদজাতীয় পানীয় কাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে, তারও তালিকা দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গুলশান সার্কেলের ইন্সপেক্টর শামসুল কবির যুগান্তরকে বলেন, ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে বলেছে তারা শুধু পারমিটধারী ও বিদেশি নাগরিকদের কাছেই মদ বিক্রি করে। তবে আমরা বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করে দেখব। কারণ, আইন অনুযায়ী অনুমোদিত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও কাছে মদ বিক্রির সুযোগ নেই।

সূত্র জানায়, ওয়েস্টিন হোটেলে ফ্রি স্টাইলে মদ বিক্রির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। হোটেলের সব কটি বারে আমদানি নিষিদ্ধ বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ-বিয়ারের মজুদ রয়েছে। চাইলে যে কেউ হোটেলের ২৩ তলার বারে গিয়ে মদ পান করতে পারেন।

লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে প্রতিদিন সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত গান-বাজনারও আয়োজন করা হয়। গভীর রাতে রাশিয়ান তরুণীদের নাচ ও গানের পর্ব শুরু হয়। এ সময় মিউজিকের তালে তালে চলে মদপান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়েস্টিন হোটেলের সাবেক এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, চোরাই বাজার থেকে ডিউটি ফ্রি মদ সংগ্রহ করে ওয়েস্টিন হোটেলে তা বিক্রি করা হয় উচ্চমূল্যে। বাইরের বারে যেখানে এক পেগ প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের হুইস্কির দাম চারশ’ টাকা, ওয়েস্টিনে তা বিক্রি করা হয় ১২শ’ টাকা।

এভাবে অতি মুনাফায় পকেট ভারি করছে ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া হোটেল কক্ষে মদ পরিবেশনের ক্ষেত্রেও নিয়মকানুনের কোনো বালাই নেই। যে কেউ রুম বুকিং দিলেই তার কাছে মদ সরবরাহ করা হয়।

অথচ আইন অনুযায়ী বিদেশি নাগরিক অথবা পারমিটধারী ছাড়া আর কারও কাছেই মদ পরিবেশনের নিয়ম নেই। হোটেলের মালিক নূর আলী প্রভাবশালী হওয়ায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বা অন্য কোনো সংস্থা কখনোই এ বিষয়ে কৈফিয়ত চায় না।

বরং উল্টো ওয়েস্টিন থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সব অনিয়ম জায়েজ করে থাকে। ওয়েস্টিন হোটেলে রুম বুকিংয়ের ক্ষেত্রেও নানা ধরনের অনিয়ম করা হয়।

একজনের নামে রুম বুকিং দিয়ে অন্যজনকে সেখানে থাকতে দেয়া হয়। হোটেলে আয়োজিত ডিজে পার্টিতে আসা অতিথির কাছে বিশেষ মূল্যে স্বল্প সময়ের জন্যও রুম দেয়া হয়।

এমনকি একই রুম এক রাতের জন্য একাধিক জনের কাছে ভাড়া দেয় ওয়েস্টিন। এভাবে পাঁচতারকা হোটেলে কয়েক ঘণ্টার জন্য রুম নিয়ে অনেকেই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিরাপদ পথ খুঁজে পায়।

সূত্র জানায়, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে ওয়েস্টিন হোটেলে দুটি বিশেষ পার্টির আয়োজন করা হয়। এর একটি ২৩ তলায়। অপরটির আয়োজন হয় হোটেলের ৬ তলায় সুইমিং পুলঘেঁষা বারে। এ দুই পার্টির আয়োজক ছিলেন জনৈক জুডো এবং ডিজে প্রিন্স।

এর মধ্যে ৬ তলার পুল সাইড বারের ভেন্যুটি শেষ মুহূর্তে পাপিয়াকে দেয়ার জন্য ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ জুডোর বুকিং বাতিলের চেষ্টা করে। ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ এ জন্য বুকিংয়ের দ্বিগুণ অর্থ ফেরতের প্রস্তাব দেয়। পরে জানা যায়, মাত্র ২০ জন আমন্ত্রিত অতিথি নিয়ে বিশেষ পার্টির আয়োজন করার কথা ছিল পাপিয়ার।

সূত্র জানায়, পাপিয়ার সঙ্গে গ্রেফতার শেখ তাইয়েবা ওরফে নূর হাই সোসাইটিতে একাধিক নামে পরিচিত। কোথাও তিনি শুধু নূর, আবার কোথাও তিনি নিশি নামেই বেশি পরিচিত।

রাজধানীর অভিজাত ক্লাব ও মদের বারে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। শেখ তাইয়েবার সাবেক এক বয়ফ্রেন্ড যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত রাত ৮টার পর তিনি ক্লাবে আসতেন। তার গ্রামের বাড়ি গাজীপুরে হলেও বনানী এলাকায় রয়েছে নিজস্ব ফ্ল্যাট। একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিকের ছেলে জনৈক আশিফের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুব মহিলা লীগের এক নেত্রী যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে পাপিয়ার অবাধ যাতায়াত ছিল। এমনও হয়েছে- একজন সচিবের দফতরে ওয়েটিং রুমভর্তি দর্শনার্থী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সাক্ষাৎ পাননি। স্যার গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আছেন বলে তার পিএস অনেককে ফিরিয়ে দিয়েছেন। অথচ রুমের ভেতরে সচিব স্যার পাপিয়ার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খোশগল্পে মত্ত।

একাধিক প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে থাকলেও পাপিয়ার ফোন এলে তাৎক্ষণিক ফোন ধরেন। জনৈক সচিবের কাছে জান্নাতুল মাওয়া নামের এক তরুণীকে পাঠাতেন পাপিয়া। সচিব তার মোবাইল ফোনে ওই তরুণীর মোবাইল নম্বর সেভ করেন ‘মাওয়া ফেরিঘাট নামে’। যাতে স্ত্রী বা পরিবারের সদস্যরা তার লাম্পট্যের বিষয়টি কখনও টের না পান।

সূত্র জানায়, পাপিয়া দরিদ্র ঘরের অনেক তরুণীকে চাকরির প্রলোভন দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এরপর চড়া মেকআপ আর পাশ্চাত্য পোশাকে তাদের অনেককে মডেল বানানো হতো। পেশাদার ফ্যাশন ফটোগ্রাফার দিয়ে ছবি তোলায় গ্রামের তরুণী রাতারাতি শোবিজের মডেলে পরিণত হন। এসব কথিত মডেলের ছবি ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ভাইবার, হোয়্যাটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারে পাঠাতেন পাপিয়া। পছন্দ হলে বুক করার জন্য পাপিয়াকে অনুরোধ করতে হতো।

সূত্র বলছে, এভাবে গ্রাম থেকে আসা অনেক তরুণী পাপিয়ার অপরাধ জগতে মিশে নিজেদের ভাগ্যের চাকা রাতারাতি ঘুরিয়েছেন। আবার অনেকেই চাকরির খোঁজে পাপিয়ার কাছে ধরা দেয়ার পর এই নরকে পা রাখতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ পাপের জগৎ থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলেও পারেননি।

কারণ, তাদের কারও কারও একান্ত মুহূর্তের ভিডিও গোপনে ধারণ করে রাখেন পাপিয়া। এসব ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে অনেক তরুণীকে ব্ল্যাকমেইল করেন তিনি।

ওয়েস্টিন হোটেলে ডিজে পার্টির এক আয়োজক যুগান্তরকে বলেন, পাপিয়ার উত্থান শুরু হয় ২০১২/১৩ সালের দিকে। তখন তিনি বিভিন্ন পার্টিতে এসে ক্লায়েন্ট (খদ্দের) সংগ্রহ করতেন। তাছাড়া সুন্দরী পার্টিগার্লদেরও নম্বর নিয়ে যেতেন তিনি। একবার র‌্যাডিশন হোটেলে দলবলসহ পাপিয়ার জোরপূর্বক প্রবেশের ঘটনায় বড় ধরনের হাঙ্গামা হয়।

পাপিয়ার সঙ্গে জনৈক যুবলীগ নেত্রী মনি হইহল্লা করেন। একপর্যায়ে তার লোকজন কয়েক রাউন্ড পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করে (জিডি) পার্টির আয়োজকরা। অজ্ঞাত কারণে পরে অবশ্য এ ঘটনা আর বেশিদূর এগোয়নি।