মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্:
সহজেই মিলবে ঋণ, সঞ্চয় করলে অধিক মুনাফা, আবার সদস্যদের সন্তানসহ অসহায় ও দরিদ্র শিশুদের বিনামূল্যে পড়ালেখা করানো হবে। এমন প্রলোভন দেখিয়ে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কয়েক শতাধিক মানুষের জমানো (সঞ্চয়) লাখ লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে এফ.সি. ফাউন্ডেশন নামের একটি ভুঁইফোড় এনজিও। এতে ক্ষুদ্র পুঁজি হারিয়ে এখন দিশেহারা ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা।
ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহ আগে উপজেলার বড়কুল পশ্চিম, বড়কুল পূর্ব, গন্ধর্ব্যপুর উত্তর, গন্ধর্ব্যপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন, হাজীগঞ্জ পৌরসভাসহ কয়েকটি ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রামে এফ.সি. ফাউন্ডেশনের কয়েকজন ফিল্ড অফিসার মানুষকে সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক কিস্তিতে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকার ঋণ দেয়ার কথা বলে তাদেরকে সদস্য (গ্রাহক) হিসাবে ভর্তি করায়।
এছাড়াও জমাকৃত টাকার অধিক মুনাফা প্রদান এবং সদস্যদের সন্তানসহ অসহায় ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের বিনামূল্যে পড়ালেখা করানো হবে বলে মানুষকে প্রলোভন দেখায়। এরপর সদস্যদের কাছ থেকে সঞ্চয়ের নামে এবং ঋণের জামানত হিসাবে টাকা নেওয়া শুরু করে। এর মধ্যে মানুষের আস্থা ও বিশ^াস অর্জনে তারা ভর্তিকৃত সদস্যদের পরিবারের শিশুদের বিনামূল্যে পড়ালেখা করানোর জন্য শিশুদের মাঝে শিশু ও প্রাথমিক শিক্ষার কিছু বই বিতরণ করে এবং ঋণের জামানত হিসাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে ব্লান্ক ব্যাংক চেক নেয়।
এভাবে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে কয়েক শতাধিক মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা সংগ্রহ করে নেয় ‘এফ.সি. ফাউন্ডেশন’ নামের এই এনজিও। ঋণের জামানত নেওয়া গ্রাহকদের সোমবার (১০ এপ্রিল) দুপুরে ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এদিন গ্রাহকরা হাজীগঞ্জ পৌরসভাধীন খাটরা বিলওয়াই এলাকায় গিয়ে দেখেন অফিসে কেউ নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকাল ও সন্ধ্যা পার হলেও কারো দেখা মেলেনি। কর্মকর্তার মোবাইল নম্বরটিও ছিল বন্ধ।
এতে মানুষের বুঝতে আর বাকি নেই এফ.সি ফাউন্ডেশন একটি ভুঁইফোড় এনজিও। ঋণ, সঞ্চয়ের অধিক মুনাফা ও বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়ার নামে তারা মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এদিকে সোমবার বিকালে ও মঙ্গলবার দুপুরে ‘এফ.সি. ফাউন্ডেশনের অফিস পরিদর্শন করে দেখা গেছে, তাদের অফিসে চেয়ার, টেবিল, কিছু শিশু ও প্রাথমিক শিক্ষার বই ও সমিতির সদস্য ফরম এবং পাশবই ছাড়া আর কিছুই নেই।
এ সময় ভাড়াকৃত অফিসের মালিক পক্ষ আব্দুর রহমানসহ সমিতির কয়েকজন গ্রাহক ও স্থানীয়রা উপস্থিত ছিলেন। তাদের ‘সঞ্চয় ও ঋণ’ নামক পাশ বইটিতে লেখা ছিল, ‘এফ.সি. ফাউন্ডেশন’ (দাতা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত। প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা হিসাবে ‘পূর্বাচল নিউ মডেল টাউন, সেক্টর-৭, রোড- ১০৭, ঢাকা- ১২১৩’ উল্লেখ ছিল। তবে পাশ বইটিতে এনজিওর সরকারি কোন নিবন্ধন নম্বর উল্লেখ নেই।
সরেজমিনে গেলে ভুক্তভোগী গন্ধর্ব্যপুর উত্তর ইউনিয়নের তারালিয়া গ্রামের আব্দুল কাদেরের পরিবারের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার কথা বলে ৬০ হাজার টাকা, ওয়াসিমের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা, ২ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার কথা বলে শাহআলমের কাছ থেকে ২০ হাজার ৫’শ টাকা, ১ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার কথা বলে ১০নং গন্ধর্ব্যপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের পাচৈ গ্রামের আলমগীরের কাছ থেকে ১০ হাজার ৫’শ ৫০ টাকা, ২ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার কথা বলে বড়কুল পূর্ব ইউনিয়ের বড়কুল গ্রামের শিব বাড়ির বিজয়ের কাছ থেকে ২০ হাজার নেয় বলে জানান।
এভাবে অসংখ্য গ্রাহকের কাছ থেকে তারা কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এক প্রশ্নের জবাবে ভুক্তভোগীরা বলেন, আমরা অনেকে তাদের (এফ.সি. ফাউন্ডেশন) অফিসে এসেছি এবং তাদের (ফ্লিড অফিসার ও ম্যানেজার) সাথে কথা বলেছি। তারা আমাদের জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাধিক গ্রাহককে তারা কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন। আমরা এই বিশ^াসে সঞ্চয় ও ঋণের জামানত হিসাবে তাদের কাছে টাকা জমা দিয়েছি।
এদিকে সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে এফ.সি. ফাউন্ডেশনের অফিসে কাউকে না পাওয়ায় এবং ব্রাঞ্চ ম্যানেজার (শাখা ব্যবস্থাপক) সাব্বির রহমানের মুঠোফোন নম্বরটি (০১৩২৬-৮৫৪৪৮৬) বন্ধ পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট কারো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
বাড়ির মালিক মো. আব্দুর রহমান জানান, গত ৪ এপ্রিল এফ.সি. ফাউন্ডেশনের নামক একটি এনজিওর ব্রাঞ্চ ম্যানেজারসহ ৭ জন অফিসার আমার কাছে আসেন। তারা আমার নির্মাণাধীন ভবনের একটি ফ্ল্যাট দেখে পছন্দ করে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর তাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আসলে ভাড়াটিয়া হিসাবে জামানতের অগ্রিম টাকা প্রদান ও কাগজপত্র করার কথা বলেন। ওই সময় পর্যন্ত তারা ফ্ল্যাটটিতে অফিস করবেন।
তিনি বলেন, এই বিশ^াসে আমি তাদেরকে অফিস করতে দেই। এভাবে এক সপ্তাহ পার হয়। তাদের কর্মকর্তা এ সপ্তাহে আসবেন বলে আমাকে জানায়। এরপর দেখি রোববার (১০ এপ্রিল) ঋণের জন্য তাদের অফিসে অনেক লোকজন এসে হাজির হন। কিন্তু তাদের কোন খবর নেই। এমনকি ম্যানেজারের মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়। তখন আর বুঝতে বাকি নেই। আমিসহ এসব মানুষের সাথে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
এ বিষয়ে হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ জোবাইর সৈয়দ জানান, অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাশেদুল ইসলাম জানান, বিষয়টি এইমাত্র আপনার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এ সময় তিনি বলেন, অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।