মা-ইলিশ ও জাটকা নিধন বন্ধ হওয়ায় উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ
নিজস্ব প্রতিনিধি॥
অতীতে ‘ইলিশের বাড়ি’ ছিল পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ার মোহনা চাঁদপুরে। এজন্য চাঁদপুরকে ইলিশের বাড়ীতে নাম করাণ করা হয়। ইলিশ চাঁদপুর জেলার অন্যতম ব্র্যান্ড। এখন ভোলা-বরগুনার নদী-সাগর মোহনা থেকে শুরু করে বৃহত্তর সিলেটের বিস্তীর্ণ হাওরে পর্যন্ত মিলছে ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ ইলিশ। প্রতিবছর চাঁদপুরে হচ্ছে ইলিশ উৎসব্ তবে বরগুনায়ও হচ্ছে ইলিশ উৎসব। উপকূলভাগের পুকুরে ‘মাছের রাজা’ ইলিশের চাষ প্রায় সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। সাগরের নোনা পানি থেকে স্বাদু পানিতেও এসে ডেরা গাড়ছে ইলিশ। ইলিশের জীবনসূত্র আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। হাতিয়া, ঢালচর, মনপুরা, মৌলভীর চর ও কালির চর দ্বীপে সমন্বিতভাবে প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় এখন ইলিশের রাজ্য।
চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার এবং চরভৈরবী থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার চরআলেকজেন্ডার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার অভয়াশ্রম এলাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। ১ মার্চ থেকে ২ মাস এ অভয়াশ্রম ইলিশ মাছসহ সবধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ। এ জন্য গঠন করা হয়েছে টাস্ক ফোর্স।
ইলিশের পোনা জাটকা এই দুই মাস বেড়ে উঠার জন্য এবং ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে দুই মাসের অভয়াশ্রম অভিযান সফল করার জন্য চাঁদপুর জেলা টাস্কফোর্স বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আসাদুল বাকি বলেন, জেলার মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ, চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলায় তালিকাভুক্ত ৫১ হাজার ১৯০জন জেলে রয়েছে। এসব জেলেদেরকে জাটকা নিধন থেকে বিরত থাকার জন্য সচেতন করা হবে। নদী উপকূলীয় এলাকায় সচেতনতামূলক সভা, লিফলেট বিতরণ, মাইকিং ও মৎস্য আড়ৎগুলোর সামনে ব্যানার সাঁটানো হবে।
তিনি আরো বলেন, জেলা কার্যালয় থেকে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদেরকে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সকলের সহযোগিতা থাকলে জাতীয় সম্পদ ইলিশ রক্ষা অভিযান সফলভাবে বাস্তবায়ন হবে।
একাধিক প্রতিষ্ঠানের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সমুদ্র্র থেকে ডিম পাড়তে মিঠা পানির নদীতে ঢুকে বহু ইলিশই আর কখনো সাগরে ফিরে যাচ্ছে না। মোহনায় পাতা মাছধরা জালের ভয়েই ইলিশের ঝাঁক মিষ্টি পানিতে রয়ে যাচ্ছে বলে তারা ধারণা করছেন। আসলে সাগরে না-ফেরাটা এই ইলিশগুলোর এক ধরনের বেঁচে থাকার চেষ্টা বা ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ বলেই মনে করছেন গবেষকরা। ইলিশ সাগরের মাছ হলেও ডিম পাড়তে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা নদীতে ঢোকে—আবহমান কাল থেকে ইলিশ-প্রিয় বাঙালি সেটাই জেনে এসেছে।
বর্তমানে বিশ্বের ৮০ শতাংশ ইলিশ বাংলাদেশে ধরা হয়। দুই বছর আগেও এই পরিমাণ ছিল মোটে ৬০ শতাংশ। চলতি বছর উৎপাদনে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে বাংলাদেশ। ১০ বছর আগে ২০০৮-৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমান বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টন। শুধু মৌসুম জুড়েই নয়, রূপালি ইলিশের প্রাচুর্য সারা বছরই রসনাবিলাসীদের পাতে থাকবে আগামীতে। সেই লক্ষ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১১ দেশে ইলিশ উৎপাদন হলেও স্বাদে-গন্ধে রসনাতৃপ্ত ইলিশের প্রাচুর্য কেবল বাংলাদেশেই মেলে। এবার ইলিশের মৌসুমে যুক্ত হলো শীতকাল। গত ১ মার্চ নিষেধাজ্ঞা আরোপের পূর্বাবধি বাজার ছিল ইলিশে সয়লাব।
জাটকা সংরক্ষণে টাস্কফোর্স ও মৎস্যবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবছর জানুয়ারিতে শুধু বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার নদনদীতে ২০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ পাওয়া গেছে।
ইলিশ বিশেষজ্ঞ চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা এবং জাটকা নিধন বন্ধে নেওয়া পদক্ষেপ কার্যকর হওয়ায় ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী শীত মৌসুমসহ সব সময়ে এভাবে ইলিশ পাওয়া যাবে।
চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদীর অভয়াশ্রম এলাকায় ইলিশের পোনা জাটকা সংরক্ষণের জন্য ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দুই মাস ইলিশসহ সকল ধরণের মাছ আহরণ নিষিদ্ধ করেছে সরকার।