হজরত ইউসুফ (আ.) ও জুলেখার কথা

  • আপডেট: ০২:১৪:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ মার্চ ২০২০
  • ৮১

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ইউসুফ (আ.)-এর ইতিকথা

হজরত ইউসুফ (আ.) ছিলেন হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর ১১তম পুত্র। হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর জন্মভূমির নাম ‘কেনান’ যা বর্তমান ফিলিস্তিনের একটি অংশ। পরবর্তীতে এই অঞ্চল ‘হেবরন এবং খলিল’ নামেও পরিচিতি পায়। ফিলিস্তিন, লেবানন এবং সিরিয়াসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর কর্মপরিধির ব্যাপ্তি ছিল। তাঁর প্রথম স্ত্রী লাইয়া বিনতে লাইয়্যানের গর্ভে জন্ম নেন ১০ পুত্র। লাইয়ার মৃত্যুর পর তারই ছোটবোন রাহিলকে বিয়ে করেন হজরত ইয়াকুব (আ.)। তাদের ঘরে জন্ম নেন দুই পুত্র; হজরত ইউসুফ (আ.) এবং তার ছোটভাই বেনিয়ামিন। একাধিক হাদিস মতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন এবং তাঁকে অত্যন্ত সুদর্শন বলে বর্ণিত হয়েছে।

হজরত ইউসুফ (আ.) প্রথম জীবনে ক্রীতদাস, পরবর্তীতে জেলের আসামি এবং শেষ জীবনে মিসরের ক্ষমতাধর রাজকর্মচারী বা মন্ত্রী ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এর বাইরে তিনি ছিলেন আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী। স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদানের দুর্লভ ক্ষমতা বা দক্ষতা তাকে প্রসিদ্ধ করে তোলে। তিনি নবী হিসেবে তৎকালে মূর্তি উপাসকদের মাঝে এক আল্লাহর একাত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন।

 

পবিত্র কোরআনের ১২তম সূরা ইউসুফ

পবিত্র কোরআনের ১২তম সূরার নাম ‘সূরা ইউসুফ’। কোরআনে বর্ণিত বিভিন্ন সূরার আয়াত এবং ঘটনা বিভিন্ন স্থানে নাজিল হলেও সূরা ইউসুফের ১১১টি আয়াতের মধ্যে মাত্র চারটি ব্যতীত ১০৭টি আয়াত মক্কায় নাজিল হয়। এ সূরায় হজরত ইউসুফ (আ.)-এর বাল্যকাল থেকে ক্ষমতায় আরোহণ এবং তাকে কেন্দ্র করে মোহগ্রস্ত নারীদের বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে।

পবিত্র কোরআনে অন্য নবীদের কাহিনি বিভিন্ন সূরায় বর্ণিত হলেও ইউসুফ (আ.)-এর কাহিনি কেবল এই একটি মাত্র সূরায় বর্ণিত হয়েছে। নানাবিধ শিক্ষামূলক বর্ণনার কারণে সূরা ইউসুফকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে একাধিক সাহিত্য। তবে সাহিত্যে বর্ণিত সব ঘটনা বা চরিত্র কোরআন ও হাদিস সমর্থন করে না।

 

সৎ ভাইদের চক্রান্তে কূপে নিক্ষেপ

হজরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর ১২ পুত্রের মধ্যে হজরত ইউসুফ (আ.)-কে বেশি স্নেহ করতেন। মূলত সৌন্দর্যের কারণে শিশুকালে তিনি সবারই প্রিয়পাত্র ছিলেন, যা তাঁর সৎ ভাইয়েরা সহ্য করতে পারতেন না। এই ভাইয়েরা হজরত ইউসুফ (আ.)-কে শিশু অবস্থায় তাদের পিতার কাছ থেকে দূরে সরানোর ঘৃণ্য চক্রান্ত করেন। তারা বাবা ইয়াকুব (আ.)-এর কাছে ইউসুফ (আ.)-কে তাদের সঙ্গে বাইরে খেলতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চান। ইয়াকুব (আ.) কখনো পুত্র ইউসুফ (আ.)-কে চোখের আড়াল করতেন না। তাই তাকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলতে পারে উল্লেখ করে নিষেধ করেন, তবে উপর্যুপরি অনুরোধ এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তার কথা বলে সৎ ভাইয়েরা বাবাকে রাজি করান এবং ইউসুফ (আ.)-কে খেলতে নিয়ে যান। এরপর তাকে প্রথমে হত্যা করার পরিকল্পনা করলেও বড় ভাইয়ের পরামর্শে হত্যার বদলে কূপে ফেলে দেওয়া হয়। আর তার কাপড়ে রক্ত মাখিয়ে তা বাড়িতে বাবাকে দেখান এবং ইউসুফ (আ.)-কে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলেছে বলে উল্লেখ করেন। বাবা হজরত ইয়াকুব (আ.) এ ঘটনায় শোকে মুষড়ে পড়েন এবং পুত্রশোকে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যান। পবিত্র কোরআনের সূরা ইউসুফের ৮ থেকে ১৮ নম্বর আয়াতে এ ঘটনার বর্ণনা রয়েছে।

 

কূপ থেকে উদ্ধার এবং ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি

সূরা ইউসুফের ১৯ নম্বর আয়াতে রয়েছে কুয়া থেকে শিশু ইউসুফ (আ.)-কে উদ্ধারের কাহিনির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। তাফসির মতে, সিরিয়া থেকে মিসরগামী একটি কাফেলা ওই কূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে মালেক ইবনে দোবর নামক এক ব্যক্তি পানি সংগ্রহের জন্য কূপে বালতি নিক্ষেপ করেন। বালতি ও সংযুক্ত দড়ির সঙ্গে এ সময় সুদর্শন বালক ইউসুফ (আ.) উঠে আসেন। এতে মালেক উল্লসিত হয়ে ওঠেন। কারণ সে সময় দাস হিসেবে মানুষ ক্রয়-বিক্রির প্রচলন ছিল। মালেক অন্য কারও সঙ্গে দাস হিসেবে বিক্রয়লব্ধ টাকার ভাগ না দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইউসুফ (আ.)-কে উদ্ধারের কাহিনি গোপন করে তাঁকে কাফেলার সঙ্গে মিসরে নিয়ে যায়। অপর তাফসির মতে, ভাইদের মধ্যে ইয়াহুদা দুই দিন কূপে থাকা ইউসুফ (আ.)-কে খাবার দিয়েছিলেন। তৃতীয় দিন তাকে কূপে না পেয়ে খুঁজতে থাকেন এবং ওই কাফেলায় তার সন্ধান পান। কাফেলার লোকদের কাছে তারা ইউসুফ (আ.)-কে পলাতক দাস হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তাঁকে কাফেলার লোকেরা চুরি করেছে বলে অভিযোগ তোলেন। ফলে ভীতসন্ত্রস্ত কাফেলার লোকজন অর্থের বিনিময়ে ইউসুফ (আ.)-কে কিনে নেন এবং মিসরে চলে যান।

মিসরের দাস-দাসী বিক্রির হাটে সুদর্শন ইউসুফ (আ.)-এর আগমনে সাড়া ফেলে দেয় এবং তার মূল্য ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবশেষে ইউসুফ (আ.)-এর ওজনের সমপরিমাণ সোনা, মৃগনাভী এবং রেশমি বস্ত্রের বিনিময়ে তাকে কিনে নেন ‘অজিজে মিসর’ অর্থাৎ মিসরের অর্থ ও খাদ্যমন্ত্রীতুল্য রাজসভার একজন সদস্য। কোনো কোনো বর্ণনায় তাকে মিসরের তৎকালীন আমালেকা জাতীয় সম্রাট বায়য়াদ ইবনে ওয়াসাদের অর্থমন্ত্রী ‘কিতফি’ কিংবা ‘ইতফি’ বলে উল্লেখ করা হয়।

 

জুলেখার ঘরে ইউসুফ (আ.)

পবিত্র কোরআনে হজরত ইউসুফ (আ.)-কে নিয়ে সর্বাধিক আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর ঘটনার নেপথ্যে থাকা প্রধান দুই চরিত্রের নাম সরাসরি উল্লিখিত হয়নি। সূরা ইউসুফে হজরত ইউসুফ (আ.)-কে ক্রয়কারীকে ‘আজিজ’ বা মন্ত্রী হিসেবে এবং তার স্ত্রীকে ‘আজিজের স্ত্রী’ বা ‘তার স্ত্রী’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। তবে তাফসির এবং ঐতিহাসিক বর্ণনা মতে, এই আজিজের স্ত্রীই হলেন ইতিহাস-খ্যাত ‘জুলেখা’। আবার অনেকের মতে, তাঁর প্রকৃত নাম রঙ্গিল আর উপাধি হলো জুলেখা। সূরা ইউসুফের ২১ নং আয়াত মতে, মিসরের যে ব্যক্তি হজরত ইউসুফ (আ.)-কে ক্রয় করেছিল, সে তার স্ত্রীকে ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি বিশেষ যতœবান হওয়ার নির্দেশ দেন এবং এই ইউসুফ (আ.) তাদের বিশেষ উপকারে আসবেন বলে প্রত্যাশা করেন। এভাবেই ইউসুফ (আ.) এবং জুলেখার পরিচয় হয় এবং জুলেখার ঘরেই কৈশোর পেরিয়ে যুবক হয়ে ওঠেন ইউসুফ (আ.)। জুলেখা ক্রমেই যুবক ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। মূর্তি উপাসক জুলেখা তার ঘরে থাকা মূর্তির সামনে অন্যায় আবদার করতে ভয় পেতেন বলে কাপড় দিয়ে মূর্তির চোখ ঢেকে দিয়ে ইউসুফ (আ.)-কে নানাভাবে প্রলুব্ধ করতে সচেষ্ট ছিলেন। অন্যদিকে আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাসী ইউসুফ (আ.) আল্লাহ প্রদত্ত ইমানের শক্তিতে সব ধোঁকা ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে ছিলেন এবং সব সময় জুলেখাকে এ পথ ছাড়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু ইউসুফ (আ.)-এর প্রেমে পাগল জুলেখা ছিলেন একরোখা।

সূরা ইউসুফের ২৩ নং আয়াত অনুসারে একদা জুলেখা ইউসুফ (আ.)-কে ঘরে পেয়ে দরজা বন্ধ করে দেন এবং তার প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু ইউসুফ (আ.) মহান আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান, ধৈর্য, ইমান এবং ভীতির কারণে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাফসির ও আরবি সাহিত্যমতে, এ সময় হজরত ইউসুফ (আ.) আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচতে ঘরের ছাদের দিকে দৃষ্টি দিলে অলৌকিকভাবে আরবি লেখা দেখতে পান। এ ছাড়াও ঘরে মূর্তির দিকে তাকিয়ে তিনি ‘আজিজ’-এর  প্রতিচ্ছবি দেখতে পান এবং ঘরের দরজায় আজিজের উপস্থিতি অনুভব করেন। এরপর হজরত ইউসুফ (আ.) নিজেকে পবিত্র রাখার জন্য বন্ধ দরজার দিকে দৌড়ে যান।

এ সময় জুলেখা পেছন থেকে ইউসুফ (আ.)-কে জাপটে ধরলে তার পরিধেয় জামা পেছন থেকে ছিঁড়ে যায়। অলৌকিকভাবে এ সময় ঘরের বন্ধ দরজা (কারও মতে বাইরে থেকে বন্ধ দরজা) খুলে যায় এবং ইউসুফ (আ.) ও জুলেখা দরজার বাইরে জুলেখার স্বামী আজিজকে দেখতে পান। ঠিক তখনই চতুর জুলেখা তার ভোল পাল্টে ফেলেন এবং সূরা ইউসুফের ২৫ নং আয়াত অনুসারে এ সময় ইউসুফ (আ.)-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো বা অন্য কোনো কঠিন শাস্তির দাবি করেন। ২৬ নং আয়াতে বর্ণিত, এ সময় ইউসুফ (আ.) প্রকৃত সত্য তুলে ধরেন এবং জুলেখার পরিবারের একজন সঠিক সাক্ষ্য প্রদান করেন। পবিত্র কোরআনে এই সাক্ষ্য প্রদানকারীর বিস্তারিত পরিচয় নেই। তবে তাফসির এবং প্রচলিত বর্ণনা অনুসারে এই সাক্ষী ছিল একটি নিতান্ত কন্যাশিশু, যার মুখে তখনো স্পষ্ট করে কথা ফোটেনি।

অপর বর্ণনায় এবং সাহিত্যে এই শিশু জুলেখার আত্মীয় এক বোনের কন্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহর বিশেষ কুদরতে এই সাক্ষী যা বলেছিল তা উল্লিখিত আছে সূরা ইউসুফের ২৬ এবং ২৭ নং আয়াতে। বর্ণনা মতে সাক্ষীর যুক্তি ছিল ইউসুফ (আ.)-এর জামা যদি পেছন থেকে ছেঁড়া থাকে তবে জুলেখা দোষী এবং যদি সামনে থেকে ছেঁড়া থাকে তবে জুলেখা যা বলছে তা সত্য অর্থাৎ ইউসুফ (আ.) দোষী।

স্বামী আজিজ যখন হজরত ইউসুফ (আ.)-এর জামা পেছন থেকে ছেঁড়া দেখতে পান তখন সব সত্য প্রকাশিত হয়। মান-সম্মানের কথা বিবেচনা করে আজিজ এ ঘটনা যাতে বাইরের কেউ না জানে তার নির্দেশ দেন এবং স্ত্রী জুলেখাকে শাস্তির ভয় দেখান।

 

ইউসুফ (আ.)-এর সৌন্দর্যে অভিভূত নারীদের অবস্থা

মহান আল্লাহ ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি সদয় হন এবং তাঁকে ঘটনাক্রমে কিছুদিন কারাগারে রাখার ব্যবস্থা করেন।

সূরা ইউসুফের ৩০ নং আয়াত অনুসারে এ ঘটনার পর শহরজুড়ে জুলেখার কুকীর্তি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আর আরব সাহিত্য মতে, রাজপ্রাসাদে যারা আজিজ বিরোধী ছিল, তারা এ ঘটনায় বহুমাত্রিক রং ছড়িয়ে প্রচার করতে থাকে। সূরা ইউসুফের পরবর্তী আয়াতগুলোতে এ ঘটনার পরিসমাপ্তি টানা হয়। এতে বলা হয়, আজিজের স্ত্রী (জুলেখা) যখন এই ষড়যন্ত্র বা অপবাদের ব্যাপক প্রচার সম্পর্কে অবগত হন, তখন শহরের গণ্যমান্য মহিলাদের তিনি এক ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানান।

এই ভোজে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে প্রত্যেকের জন্য ফল এবং তা কাটার জন্য একটি করে ধারালো ছুরি দেওয়া হয়। শহরের নারীরা যখন ছুরি দিয়ে ফল কাটায় ব্যস্ত, ঠিক তখন জুলেখা তাঁর পূর্ব পরিকল্পনা মতো পাশের কক্ষে থাকা ইউসুফ (আ.)-কে মহিলাদের সামনে আসতে হুকুম করেন। অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী হজরত ইউসুফ (আ.) যখন সামনে উপস্থিত হন, তখন তাঁর সৌন্দর্যের মোহে নারীরা তাঁর দিকে তাকিয়ে ফলের বদলে ধারালো ছুরি দিয়ে নিজ নিজ আঙ্গুল কেটে ফেলেন। এই সুযোগে জুলেখা সবার উদ্দেশে বলেন যে, এই সেই সুপুরুষ ইউসুফ (আ.), যার জন্য মহিলারা তার নিন্দা করছেন। সূরা ইউসুফের ৩১ নং আয়াত মতে, মহিলাদের মন্তব্য ছিল- ‘এ তো মানুষ নন, এ তো এক মহান ফেরেশতা’। এ সময় জুলেখা আবারও তাঁর কূটচাল প্রয়োগ করেন এবং একদিকে ইউসুফ (আ.)-কে পবিত্র বলে সাক্ষ্য দেন আর অন্যদিকে ভবিষ্যতে ইউসুফ (আ.) তাঁর কথার অবাধ্য হলে অপমানিত হওয়ার এবং কারাগারে নিক্ষেপ করার হুমকি দেন। কিছু মহিলাও এতে সায় দেন ও ইন্ধন জোগান। সূরা ইউসুফের ৩৩ নং আয়াত অনুসারে এ সময় হজরত ইউসুফ (আ.) মহান আল্লাহর কাছে কুচক্রী মহিলাদের কাছ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং অপবিত্র ভোগ-বিলাসের পরিবর্তে কারাবাসই উত্তম বলে ফরিয়াদ জানান। তিনি উপলব্ধি করেন যে, কারাগারই হতে পারে তাঁর জন্য নিরাপদ আশ্রয়, অন্যথায় কুচক্রী জুলেখা ও অন্য নারীর প্রলোভন ও ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচা দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠবে। মহান আল্লাহ ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি সদয় হন এবং তাঁকে ঘটনাক্রমে কিছুদিন কারাগারে রাখার ব্যবস্থা করেন।

 

শিল্প-সাহিত্যে ইউসুফ (আ.) ও জুলেখা

এ সিরিয়ালে জুলেখার চরিত্রে অভিনয়কারী কাতায়ন রিয়াহি পরবর্তীতে ইসলামী পোশাকের প্রতি আগ্রহী হন এবং অভিনয় ছেড়ে দেন। আর পরিচালক ফারাজুল্লাহ সালাহ ২০১৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ফুসফুস ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। পারস্য অঞ্চল তথা বৃহত্তর ইরানে ইউসুফ (আ.) ও জুলেখার প্রেম নিয়ে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় গীতি কবিতা।

ইউসুফ (আ.) এবং জুলেখার জীবনালেখ্য নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এবং সাহিত্য ও বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যমে রচিত হয়েছে নানাবিধ উপকরণ। ইসলাম ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত হজরত ইউসুফ (আ.)কে ইহুদিদের হিব্রু বাইবেল এবং খ্রিষ্টানদের বাইবেলে জোশেফ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আর জুলেখা কোনো কোনো সাহিত্যকর্ম বা পর্দায় ‘রাইলা’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিককালে ইরানি পরিচালক ফারাজুল্লাহ সালাহ সূর ‘উসুফ-এ-গয়গম্বর’ বা ‘জোসেফ, দ্য প্রোফেট’ নামের একটি টিভি সিরিয়াল নির্মাণ করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এই টিভি সিরিয়াল ডাবিং করা হয়। ২০০৮ সালে নির্মিত এই টিভি সিরিয়াল ২০১৬ সালের শেষ ভাগে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল বাংলায় ডাবিং করে প্রচার শুরু করে। যা বর্তমানে পুনঃপ্রচার হচ্ছে। মূল টিভি সিরিয়াল ছিল ৪৬ পর্বের। তিন হাজার অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে বাছাইকৃত ২০০ জনকে নিয়ে নির্মিত এই সিরিয়ালের জন্য গবেষণা করতে সময় লেগেছে চার বছর। পাঁচ হাজার পৃষ্ঠার পা-ুলিপি। এক হাজার পোশাক এবং ১০ ট্রাক অন্যান্য সামগ্রীর প্রয়োজন হয়, শুটিংয়ের জন্য নির্মিত হয়েছিল তিনটি কৃত্রিম শহর। এ সিরিয়ালে জুলেখার চরিত্রে অভিনয়কারী কাতায়ন রিয়াহি পরবর্তীতে ইসলামী পোশাকের প্রতি আগ্রহী হন এবং অভিনয় ছেড়ে দেন। আর পরিচালক ফারাজুল্লাহ সালাহ ২০১৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ফুসফুস ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। পারস্য অঞ্চল তথা বৃহত্তর ইরানে ইউসুফ (আ.) ও জুলেখার প্রেম নিয়ে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় গীতি কবিতা। প্রাথমিকভাবে ফারসি ভাষায় রচিত এই গীতি কবিতা মহাকবি ফেরদৌসী (আবুল কাশেম ফেরদৌসী তুসি) রচনা করেছেন বলে ধারণা করা হলেও সম্প্রতি এই তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে আরেক পারস্য কবি জামি (নূর উদ্দিন আবদুর রহমান জামি) তাঁর বিখ্যাত সাতটি কাব্যের সংকলনে পাঁচ নং কাব্যে রচনা করেছেন ইউসুফ (আ.) এবং জুলেখার প্রেমকাহিনি। ১৩-১৪ শতকের কবি শাহ মোহাম্মদ সগীর গৌড়ের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহর রাজত্বকালে ইউসুফ-জুলেখা কাব্য রচনা করেন। অন্যদিকে সাদেক আলী মুন্সেফ (পূর্বে হিন্দু ছিলেন। নাম : গৌর কিশোর সেন) প্রাচীন সিলেটী নাগরী ভাষায় তথা আঞ্চলিক ভাষায় ‘মহব্বতনামা’ শিরোনামে একটি পুথি রচনা করেন, যা বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। ৬০-৭০-এর দশকে বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল আলীমের ‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না’ শীর্ষক গানের একটি জায়গায় বলা হয়েছেÑ ‘প্রেম কইরাছে ইউসুফ নবী; যার প্রেমেতে জুলেখা বিবি গো, ও সে প্রেমের দায়ে জেল খাটিল (২); তবুও সে প্রেম ছাড়ল না দরদি, প্রেমের মরা জলে ডোবে না, তুমি সুজন দেইখা কইরো পিরিত মইলে (মরলে) যেন ভুলে না দরদি; প্রেমের মরা জলে ডোবে না’।

পুনশ্চ : পবিত্র কোরআনের ৩৮ নং সূরা সোয়াদ-এর ৪১, ৪২ এবং ৪৩ নং আয়াতে হজরত আইয়ুব (আ.)-এর যন্ত্রণাময় রোগ থেকে মুক্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। তাফসিরকারীদের একটি অংশ হজরত আইয়ুবের শরীরে চর্মরোগ বা পচন ধরেছিল বলে বর্ণনা করেন। এ সময় সবাই ঘৃণাভরে তাকে ত্যাগ করলেও তাঁর প্রেমময় স্ত্রী রহিমা তাঁকে দীর্ঘ ১৮ বছর সেবা করেন বলে বর্ণিত আছে। সূরা সোয়াদের ৪২ নং আয়াত অনুসারে দীর্ঘ রোগভোগ করে আইয়ুব (আ.) আল্লাহর প্রতি ইমান অটুট রাখেন ও ধৈর্য রাখেন বিধায় মহান আল্লাহ তাঁকে দুই পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে বলেন। বর্ণনা মতে তিনি তা করার পর মাটি থেকে ঠান্ডা পানি বের হয়। এই পানিতে গোসল করার মাধ্যমে হজরত আইয়ুব (আ.) রোগমুক্ত হন এবং রহিমা বিবিসহ পরিবারের অন্যদের মাঝে ফিরে আসেন। আবদুল আলীমের গানের কথায়- ‘প্রেম কইরাছে আইয়ুব নবী; যার প্রেমে রহিমা বিবি গো; তারে আঠারো সাল কিড়ায় (পোকায়)- খাইল (২); তবুও রহিমা ছাড়ল না দরদি; প্রেমের মরা জলে ডোবে না।’

 

পরবর্তী জীবনে ইউসুফ (আ.) ও জুলেখা

সূরা ইউসুফের পরবর্তী অংশে কারাগার থেকে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর মুক্তি, রাজার স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে রাজ দরবারে আকর্ষণীয় পদ লাভ, মিসরের দুর্ভিক্ষ, সৎ ভাইদের উচিত শিক্ষাদান, আপন ছোটভাই বেনিয়ামিনকে কাছে রাখা, পিতা ইয়াকুব (আ.)-এর চোখের দৃষ্টি ফিরে পাওয়া এবং সবশেষে পিতা-মাতাকে রাজদরবারে বসিয়ে সম্মান প্রদানের বর্ণনা রয়েছে। তবে আজিজের স্ত্রী বা জুলেখা সম্পর্কে পরবর্তীতে আর কোনো বর্ণনা পবিত্র কোরআনে দেওয়া হয়নি, হাদিসেও এ সংক্রান্ত বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

হাদিস বা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন সাহিত্যে ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে জুলেখার পুনর্মিলনের বর্ণনা পাওয়া যায়। একটি সাহিত্যধারা মতে, সময়ের বিবর্তনে মিসরের আজিজ (জুলেখার স্বামী) মৃত্যুবরণ করার পর তাদের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে তাদের কোলজুড়ে দুই পুত্র আফরাইম ইবনে ইউসুফ এবং মায়শা ইবনে ইউসুফের জন্মের বর্ণনাও পাওয়া যায়। কারও কারও মতে, জুলেখার স্বামীর মৃত্যুর পর হজরত ইউসুফ (আ.) মিসরের নতুন আজিজ নিযুক্ত হন এবং তাঁর সঙ্গে জুলেখার বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়। সূরা ইউসুফের ৫৪ থেকে ৫৬ নং আয়াত মোতাবেক মিসরের রাজা ইউসুফ (আ.)-কে সম্মান এবং বিশ্বাসী পাত্র হিসেবে গণ্য করেন এবং তাঁকে বিশ্বস্ত সহচর নিযুক্ত করেন।

সূরা ইউসুফের ৫৮ নং আয়াতে মিসরে দুর্ভিক্ষের সময় ইউসুফ (আ.) প্রজাদের মাঝে খাদ্য বণ্টন করতেন মর্মে ইঙ্গিত রয়েছে এবং তাঁর সৎ ভাইদের মাঝেও তিনি খাদ্য বিতরণ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরার শেষভাগে ১০১ নং আয়াতে হজরত ইউসুফ (আ.) এই মর্মে শুকরিয়া আদায় করেছেন- ‘হে আমার প্রতিপালক, তুমিই আমাকে রাজ্য দান করেছ এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছ’।

Tag :
সর্বাধিক পঠিত

‘ম্যানেজ করে’ এক সাথে দুই স্বামীর সংসার করছিলেন জান্নাতুল!

হজরত ইউসুফ (আ.) ও জুলেখার কথা

আপডেট: ০২:১৪:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ মার্চ ২০২০

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

ইউসুফ (আ.)-এর ইতিকথা

হজরত ইউসুফ (আ.) ছিলেন হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর ১১তম পুত্র। হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর জন্মভূমির নাম ‘কেনান’ যা বর্তমান ফিলিস্তিনের একটি অংশ। পরবর্তীতে এই অঞ্চল ‘হেবরন এবং খলিল’ নামেও পরিচিতি পায়। ফিলিস্তিন, লেবানন এবং সিরিয়াসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর কর্মপরিধির ব্যাপ্তি ছিল। তাঁর প্রথম স্ত্রী লাইয়া বিনতে লাইয়্যানের গর্ভে জন্ম নেন ১০ পুত্র। লাইয়ার মৃত্যুর পর তারই ছোটবোন রাহিলকে বিয়ে করেন হজরত ইয়াকুব (আ.)। তাদের ঘরে জন্ম নেন দুই পুত্র; হজরত ইউসুফ (আ.) এবং তার ছোটভাই বেনিয়ামিন। একাধিক হাদিস মতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন এবং তাঁকে অত্যন্ত সুদর্শন বলে বর্ণিত হয়েছে।

হজরত ইউসুফ (আ.) প্রথম জীবনে ক্রীতদাস, পরবর্তীতে জেলের আসামি এবং শেষ জীবনে মিসরের ক্ষমতাধর রাজকর্মচারী বা মন্ত্রী ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এর বাইরে তিনি ছিলেন আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী। স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদানের দুর্লভ ক্ষমতা বা দক্ষতা তাকে প্রসিদ্ধ করে তোলে। তিনি নবী হিসেবে তৎকালে মূর্তি উপাসকদের মাঝে এক আল্লাহর একাত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন।

 

পবিত্র কোরআনের ১২তম সূরা ইউসুফ

পবিত্র কোরআনের ১২তম সূরার নাম ‘সূরা ইউসুফ’। কোরআনে বর্ণিত বিভিন্ন সূরার আয়াত এবং ঘটনা বিভিন্ন স্থানে নাজিল হলেও সূরা ইউসুফের ১১১টি আয়াতের মধ্যে মাত্র চারটি ব্যতীত ১০৭টি আয়াত মক্কায় নাজিল হয়। এ সূরায় হজরত ইউসুফ (আ.)-এর বাল্যকাল থেকে ক্ষমতায় আরোহণ এবং তাকে কেন্দ্র করে মোহগ্রস্ত নারীদের বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে।

পবিত্র কোরআনে অন্য নবীদের কাহিনি বিভিন্ন সূরায় বর্ণিত হলেও ইউসুফ (আ.)-এর কাহিনি কেবল এই একটি মাত্র সূরায় বর্ণিত হয়েছে। নানাবিধ শিক্ষামূলক বর্ণনার কারণে সূরা ইউসুফকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে একাধিক সাহিত্য। তবে সাহিত্যে বর্ণিত সব ঘটনা বা চরিত্র কোরআন ও হাদিস সমর্থন করে না।

 

সৎ ভাইদের চক্রান্তে কূপে নিক্ষেপ

হজরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর ১২ পুত্রের মধ্যে হজরত ইউসুফ (আ.)-কে বেশি স্নেহ করতেন। মূলত সৌন্দর্যের কারণে শিশুকালে তিনি সবারই প্রিয়পাত্র ছিলেন, যা তাঁর সৎ ভাইয়েরা সহ্য করতে পারতেন না। এই ভাইয়েরা হজরত ইউসুফ (আ.)-কে শিশু অবস্থায় তাদের পিতার কাছ থেকে দূরে সরানোর ঘৃণ্য চক্রান্ত করেন। তারা বাবা ইয়াকুব (আ.)-এর কাছে ইউসুফ (আ.)-কে তাদের সঙ্গে বাইরে খেলতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চান। ইয়াকুব (আ.) কখনো পুত্র ইউসুফ (আ.)-কে চোখের আড়াল করতেন না। তাই তাকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলতে পারে উল্লেখ করে নিষেধ করেন, তবে উপর্যুপরি অনুরোধ এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তার কথা বলে সৎ ভাইয়েরা বাবাকে রাজি করান এবং ইউসুফ (আ.)-কে খেলতে নিয়ে যান। এরপর তাকে প্রথমে হত্যা করার পরিকল্পনা করলেও বড় ভাইয়ের পরামর্শে হত্যার বদলে কূপে ফেলে দেওয়া হয়। আর তার কাপড়ে রক্ত মাখিয়ে তা বাড়িতে বাবাকে দেখান এবং ইউসুফ (আ.)-কে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলেছে বলে উল্লেখ করেন। বাবা হজরত ইয়াকুব (আ.) এ ঘটনায় শোকে মুষড়ে পড়েন এবং পুত্রশোকে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যান। পবিত্র কোরআনের সূরা ইউসুফের ৮ থেকে ১৮ নম্বর আয়াতে এ ঘটনার বর্ণনা রয়েছে।

 

কূপ থেকে উদ্ধার এবং ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি

সূরা ইউসুফের ১৯ নম্বর আয়াতে রয়েছে কুয়া থেকে শিশু ইউসুফ (আ.)-কে উদ্ধারের কাহিনির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। তাফসির মতে, সিরিয়া থেকে মিসরগামী একটি কাফেলা ওই কূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে মালেক ইবনে দোবর নামক এক ব্যক্তি পানি সংগ্রহের জন্য কূপে বালতি নিক্ষেপ করেন। বালতি ও সংযুক্ত দড়ির সঙ্গে এ সময় সুদর্শন বালক ইউসুফ (আ.) উঠে আসেন। এতে মালেক উল্লসিত হয়ে ওঠেন। কারণ সে সময় দাস হিসেবে মানুষ ক্রয়-বিক্রির প্রচলন ছিল। মালেক অন্য কারও সঙ্গে দাস হিসেবে বিক্রয়লব্ধ টাকার ভাগ না দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইউসুফ (আ.)-কে উদ্ধারের কাহিনি গোপন করে তাঁকে কাফেলার সঙ্গে মিসরে নিয়ে যায়। অপর তাফসির মতে, ভাইদের মধ্যে ইয়াহুদা দুই দিন কূপে থাকা ইউসুফ (আ.)-কে খাবার দিয়েছিলেন। তৃতীয় দিন তাকে কূপে না পেয়ে খুঁজতে থাকেন এবং ওই কাফেলায় তার সন্ধান পান। কাফেলার লোকদের কাছে তারা ইউসুফ (আ.)-কে পলাতক দাস হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তাঁকে কাফেলার লোকেরা চুরি করেছে বলে অভিযোগ তোলেন। ফলে ভীতসন্ত্রস্ত কাফেলার লোকজন অর্থের বিনিময়ে ইউসুফ (আ.)-কে কিনে নেন এবং মিসরে চলে যান।

মিসরের দাস-দাসী বিক্রির হাটে সুদর্শন ইউসুফ (আ.)-এর আগমনে সাড়া ফেলে দেয় এবং তার মূল্য ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবশেষে ইউসুফ (আ.)-এর ওজনের সমপরিমাণ সোনা, মৃগনাভী এবং রেশমি বস্ত্রের বিনিময়ে তাকে কিনে নেন ‘অজিজে মিসর’ অর্থাৎ মিসরের অর্থ ও খাদ্যমন্ত্রীতুল্য রাজসভার একজন সদস্য। কোনো কোনো বর্ণনায় তাকে মিসরের তৎকালীন আমালেকা জাতীয় সম্রাট বায়য়াদ ইবনে ওয়াসাদের অর্থমন্ত্রী ‘কিতফি’ কিংবা ‘ইতফি’ বলে উল্লেখ করা হয়।

 

জুলেখার ঘরে ইউসুফ (আ.)

পবিত্র কোরআনে হজরত ইউসুফ (আ.)-কে নিয়ে সর্বাধিক আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর ঘটনার নেপথ্যে থাকা প্রধান দুই চরিত্রের নাম সরাসরি উল্লিখিত হয়নি। সূরা ইউসুফে হজরত ইউসুফ (আ.)-কে ক্রয়কারীকে ‘আজিজ’ বা মন্ত্রী হিসেবে এবং তার স্ত্রীকে ‘আজিজের স্ত্রী’ বা ‘তার স্ত্রী’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। তবে তাফসির এবং ঐতিহাসিক বর্ণনা মতে, এই আজিজের স্ত্রীই হলেন ইতিহাস-খ্যাত ‘জুলেখা’। আবার অনেকের মতে, তাঁর প্রকৃত নাম রঙ্গিল আর উপাধি হলো জুলেখা। সূরা ইউসুফের ২১ নং আয়াত মতে, মিসরের যে ব্যক্তি হজরত ইউসুফ (আ.)-কে ক্রয় করেছিল, সে তার স্ত্রীকে ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি বিশেষ যতœবান হওয়ার নির্দেশ দেন এবং এই ইউসুফ (আ.) তাদের বিশেষ উপকারে আসবেন বলে প্রত্যাশা করেন। এভাবেই ইউসুফ (আ.) এবং জুলেখার পরিচয় হয় এবং জুলেখার ঘরেই কৈশোর পেরিয়ে যুবক হয়ে ওঠেন ইউসুফ (আ.)। জুলেখা ক্রমেই যুবক ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। মূর্তি উপাসক জুলেখা তার ঘরে থাকা মূর্তির সামনে অন্যায় আবদার করতে ভয় পেতেন বলে কাপড় দিয়ে মূর্তির চোখ ঢেকে দিয়ে ইউসুফ (আ.)-কে নানাভাবে প্রলুব্ধ করতে সচেষ্ট ছিলেন। অন্যদিকে আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাসী ইউসুফ (আ.) আল্লাহ প্রদত্ত ইমানের শক্তিতে সব ধোঁকা ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে ছিলেন এবং সব সময় জুলেখাকে এ পথ ছাড়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু ইউসুফ (আ.)-এর প্রেমে পাগল জুলেখা ছিলেন একরোখা।

সূরা ইউসুফের ২৩ নং আয়াত অনুসারে একদা জুলেখা ইউসুফ (আ.)-কে ঘরে পেয়ে দরজা বন্ধ করে দেন এবং তার প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু ইউসুফ (আ.) মহান আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান, ধৈর্য, ইমান এবং ভীতির কারণে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাফসির ও আরবি সাহিত্যমতে, এ সময় হজরত ইউসুফ (আ.) আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচতে ঘরের ছাদের দিকে দৃষ্টি দিলে অলৌকিকভাবে আরবি লেখা দেখতে পান। এ ছাড়াও ঘরে মূর্তির দিকে তাকিয়ে তিনি ‘আজিজ’-এর  প্রতিচ্ছবি দেখতে পান এবং ঘরের দরজায় আজিজের উপস্থিতি অনুভব করেন। এরপর হজরত ইউসুফ (আ.) নিজেকে পবিত্র রাখার জন্য বন্ধ দরজার দিকে দৌড়ে যান।

এ সময় জুলেখা পেছন থেকে ইউসুফ (আ.)-কে জাপটে ধরলে তার পরিধেয় জামা পেছন থেকে ছিঁড়ে যায়। অলৌকিকভাবে এ সময় ঘরের বন্ধ দরজা (কারও মতে বাইরে থেকে বন্ধ দরজা) খুলে যায় এবং ইউসুফ (আ.) ও জুলেখা দরজার বাইরে জুলেখার স্বামী আজিজকে দেখতে পান। ঠিক তখনই চতুর জুলেখা তার ভোল পাল্টে ফেলেন এবং সূরা ইউসুফের ২৫ নং আয়াত অনুসারে এ সময় ইউসুফ (আ.)-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো বা অন্য কোনো কঠিন শাস্তির দাবি করেন। ২৬ নং আয়াতে বর্ণিত, এ সময় ইউসুফ (আ.) প্রকৃত সত্য তুলে ধরেন এবং জুলেখার পরিবারের একজন সঠিক সাক্ষ্য প্রদান করেন। পবিত্র কোরআনে এই সাক্ষ্য প্রদানকারীর বিস্তারিত পরিচয় নেই। তবে তাফসির এবং প্রচলিত বর্ণনা অনুসারে এই সাক্ষী ছিল একটি নিতান্ত কন্যাশিশু, যার মুখে তখনো স্পষ্ট করে কথা ফোটেনি।

অপর বর্ণনায় এবং সাহিত্যে এই শিশু জুলেখার আত্মীয় এক বোনের কন্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহর বিশেষ কুদরতে এই সাক্ষী যা বলেছিল তা উল্লিখিত আছে সূরা ইউসুফের ২৬ এবং ২৭ নং আয়াতে। বর্ণনা মতে সাক্ষীর যুক্তি ছিল ইউসুফ (আ.)-এর জামা যদি পেছন থেকে ছেঁড়া থাকে তবে জুলেখা দোষী এবং যদি সামনে থেকে ছেঁড়া থাকে তবে জুলেখা যা বলছে তা সত্য অর্থাৎ ইউসুফ (আ.) দোষী।

স্বামী আজিজ যখন হজরত ইউসুফ (আ.)-এর জামা পেছন থেকে ছেঁড়া দেখতে পান তখন সব সত্য প্রকাশিত হয়। মান-সম্মানের কথা বিবেচনা করে আজিজ এ ঘটনা যাতে বাইরের কেউ না জানে তার নির্দেশ দেন এবং স্ত্রী জুলেখাকে শাস্তির ভয় দেখান।

 

ইউসুফ (আ.)-এর সৌন্দর্যে অভিভূত নারীদের অবস্থা

মহান আল্লাহ ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি সদয় হন এবং তাঁকে ঘটনাক্রমে কিছুদিন কারাগারে রাখার ব্যবস্থা করেন।

সূরা ইউসুফের ৩০ নং আয়াত অনুসারে এ ঘটনার পর শহরজুড়ে জুলেখার কুকীর্তি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আর আরব সাহিত্য মতে, রাজপ্রাসাদে যারা আজিজ বিরোধী ছিল, তারা এ ঘটনায় বহুমাত্রিক রং ছড়িয়ে প্রচার করতে থাকে। সূরা ইউসুফের পরবর্তী আয়াতগুলোতে এ ঘটনার পরিসমাপ্তি টানা হয়। এতে বলা হয়, আজিজের স্ত্রী (জুলেখা) যখন এই ষড়যন্ত্র বা অপবাদের ব্যাপক প্রচার সম্পর্কে অবগত হন, তখন শহরের গণ্যমান্য মহিলাদের তিনি এক ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানান।

এই ভোজে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে প্রত্যেকের জন্য ফল এবং তা কাটার জন্য একটি করে ধারালো ছুরি দেওয়া হয়। শহরের নারীরা যখন ছুরি দিয়ে ফল কাটায় ব্যস্ত, ঠিক তখন জুলেখা তাঁর পূর্ব পরিকল্পনা মতো পাশের কক্ষে থাকা ইউসুফ (আ.)-কে মহিলাদের সামনে আসতে হুকুম করেন। অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী হজরত ইউসুফ (আ.) যখন সামনে উপস্থিত হন, তখন তাঁর সৌন্দর্যের মোহে নারীরা তাঁর দিকে তাকিয়ে ফলের বদলে ধারালো ছুরি দিয়ে নিজ নিজ আঙ্গুল কেটে ফেলেন। এই সুযোগে জুলেখা সবার উদ্দেশে বলেন যে, এই সেই সুপুরুষ ইউসুফ (আ.), যার জন্য মহিলারা তার নিন্দা করছেন। সূরা ইউসুফের ৩১ নং আয়াত মতে, মহিলাদের মন্তব্য ছিল- ‘এ তো মানুষ নন, এ তো এক মহান ফেরেশতা’। এ সময় জুলেখা আবারও তাঁর কূটচাল প্রয়োগ করেন এবং একদিকে ইউসুফ (আ.)-কে পবিত্র বলে সাক্ষ্য দেন আর অন্যদিকে ভবিষ্যতে ইউসুফ (আ.) তাঁর কথার অবাধ্য হলে অপমানিত হওয়ার এবং কারাগারে নিক্ষেপ করার হুমকি দেন। কিছু মহিলাও এতে সায় দেন ও ইন্ধন জোগান। সূরা ইউসুফের ৩৩ নং আয়াত অনুসারে এ সময় হজরত ইউসুফ (আ.) মহান আল্লাহর কাছে কুচক্রী মহিলাদের কাছ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং অপবিত্র ভোগ-বিলাসের পরিবর্তে কারাবাসই উত্তম বলে ফরিয়াদ জানান। তিনি উপলব্ধি করেন যে, কারাগারই হতে পারে তাঁর জন্য নিরাপদ আশ্রয়, অন্যথায় কুচক্রী জুলেখা ও অন্য নারীর প্রলোভন ও ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচা দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠবে। মহান আল্লাহ ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি সদয় হন এবং তাঁকে ঘটনাক্রমে কিছুদিন কারাগারে রাখার ব্যবস্থা করেন।

 

শিল্প-সাহিত্যে ইউসুফ (আ.) ও জুলেখা

এ সিরিয়ালে জুলেখার চরিত্রে অভিনয়কারী কাতায়ন রিয়াহি পরবর্তীতে ইসলামী পোশাকের প্রতি আগ্রহী হন এবং অভিনয় ছেড়ে দেন। আর পরিচালক ফারাজুল্লাহ সালাহ ২০১৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ফুসফুস ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। পারস্য অঞ্চল তথা বৃহত্তর ইরানে ইউসুফ (আ.) ও জুলেখার প্রেম নিয়ে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় গীতি কবিতা।

ইউসুফ (আ.) এবং জুলেখার জীবনালেখ্য নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এবং সাহিত্য ও বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যমে রচিত হয়েছে নানাবিধ উপকরণ। ইসলাম ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত হজরত ইউসুফ (আ.)কে ইহুদিদের হিব্রু বাইবেল এবং খ্রিষ্টানদের বাইবেলে জোশেফ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আর জুলেখা কোনো কোনো সাহিত্যকর্ম বা পর্দায় ‘রাইলা’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিককালে ইরানি পরিচালক ফারাজুল্লাহ সালাহ সূর ‘উসুফ-এ-গয়গম্বর’ বা ‘জোসেফ, দ্য প্রোফেট’ নামের একটি টিভি সিরিয়াল নির্মাণ করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এই টিভি সিরিয়াল ডাবিং করা হয়। ২০০৮ সালে নির্মিত এই টিভি সিরিয়াল ২০১৬ সালের শেষ ভাগে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল বাংলায় ডাবিং করে প্রচার শুরু করে। যা বর্তমানে পুনঃপ্রচার হচ্ছে। মূল টিভি সিরিয়াল ছিল ৪৬ পর্বের। তিন হাজার অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে বাছাইকৃত ২০০ জনকে নিয়ে নির্মিত এই সিরিয়ালের জন্য গবেষণা করতে সময় লেগেছে চার বছর। পাঁচ হাজার পৃষ্ঠার পা-ুলিপি। এক হাজার পোশাক এবং ১০ ট্রাক অন্যান্য সামগ্রীর প্রয়োজন হয়, শুটিংয়ের জন্য নির্মিত হয়েছিল তিনটি কৃত্রিম শহর। এ সিরিয়ালে জুলেখার চরিত্রে অভিনয়কারী কাতায়ন রিয়াহি পরবর্তীতে ইসলামী পোশাকের প্রতি আগ্রহী হন এবং অভিনয় ছেড়ে দেন। আর পরিচালক ফারাজুল্লাহ সালাহ ২০১৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ফুসফুস ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। পারস্য অঞ্চল তথা বৃহত্তর ইরানে ইউসুফ (আ.) ও জুলেখার প্রেম নিয়ে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় গীতি কবিতা। প্রাথমিকভাবে ফারসি ভাষায় রচিত এই গীতি কবিতা মহাকবি ফেরদৌসী (আবুল কাশেম ফেরদৌসী তুসি) রচনা করেছেন বলে ধারণা করা হলেও সম্প্রতি এই তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে আরেক পারস্য কবি জামি (নূর উদ্দিন আবদুর রহমান জামি) তাঁর বিখ্যাত সাতটি কাব্যের সংকলনে পাঁচ নং কাব্যে রচনা করেছেন ইউসুফ (আ.) এবং জুলেখার প্রেমকাহিনি। ১৩-১৪ শতকের কবি শাহ মোহাম্মদ সগীর গৌড়ের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহর রাজত্বকালে ইউসুফ-জুলেখা কাব্য রচনা করেন। অন্যদিকে সাদেক আলী মুন্সেফ (পূর্বে হিন্দু ছিলেন। নাম : গৌর কিশোর সেন) প্রাচীন সিলেটী নাগরী ভাষায় তথা আঞ্চলিক ভাষায় ‘মহব্বতনামা’ শিরোনামে একটি পুথি রচনা করেন, যা বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। ৬০-৭০-এর দশকে বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল আলীমের ‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না’ শীর্ষক গানের একটি জায়গায় বলা হয়েছেÑ ‘প্রেম কইরাছে ইউসুফ নবী; যার প্রেমেতে জুলেখা বিবি গো, ও সে প্রেমের দায়ে জেল খাটিল (২); তবুও সে প্রেম ছাড়ল না দরদি, প্রেমের মরা জলে ডোবে না, তুমি সুজন দেইখা কইরো পিরিত মইলে (মরলে) যেন ভুলে না দরদি; প্রেমের মরা জলে ডোবে না’।

পুনশ্চ : পবিত্র কোরআনের ৩৮ নং সূরা সোয়াদ-এর ৪১, ৪২ এবং ৪৩ নং আয়াতে হজরত আইয়ুব (আ.)-এর যন্ত্রণাময় রোগ থেকে মুক্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। তাফসিরকারীদের একটি অংশ হজরত আইয়ুবের শরীরে চর্মরোগ বা পচন ধরেছিল বলে বর্ণনা করেন। এ সময় সবাই ঘৃণাভরে তাকে ত্যাগ করলেও তাঁর প্রেমময় স্ত্রী রহিমা তাঁকে দীর্ঘ ১৮ বছর সেবা করেন বলে বর্ণিত আছে। সূরা সোয়াদের ৪২ নং আয়াত অনুসারে দীর্ঘ রোগভোগ করে আইয়ুব (আ.) আল্লাহর প্রতি ইমান অটুট রাখেন ও ধৈর্য রাখেন বিধায় মহান আল্লাহ তাঁকে দুই পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে বলেন। বর্ণনা মতে তিনি তা করার পর মাটি থেকে ঠান্ডা পানি বের হয়। এই পানিতে গোসল করার মাধ্যমে হজরত আইয়ুব (আ.) রোগমুক্ত হন এবং রহিমা বিবিসহ পরিবারের অন্যদের মাঝে ফিরে আসেন। আবদুল আলীমের গানের কথায়- ‘প্রেম কইরাছে আইয়ুব নবী; যার প্রেমে রহিমা বিবি গো; তারে আঠারো সাল কিড়ায় (পোকায়)- খাইল (২); তবুও রহিমা ছাড়ল না দরদি; প্রেমের মরা জলে ডোবে না।’

 

পরবর্তী জীবনে ইউসুফ (আ.) ও জুলেখা

সূরা ইউসুফের পরবর্তী অংশে কারাগার থেকে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর মুক্তি, রাজার স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে রাজ দরবারে আকর্ষণীয় পদ লাভ, মিসরের দুর্ভিক্ষ, সৎ ভাইদের উচিত শিক্ষাদান, আপন ছোটভাই বেনিয়ামিনকে কাছে রাখা, পিতা ইয়াকুব (আ.)-এর চোখের দৃষ্টি ফিরে পাওয়া এবং সবশেষে পিতা-মাতাকে রাজদরবারে বসিয়ে সম্মান প্রদানের বর্ণনা রয়েছে। তবে আজিজের স্ত্রী বা জুলেখা সম্পর্কে পরবর্তীতে আর কোনো বর্ণনা পবিত্র কোরআনে দেওয়া হয়নি, হাদিসেও এ সংক্রান্ত বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

হাদিস বা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন সাহিত্যে ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে জুলেখার পুনর্মিলনের বর্ণনা পাওয়া যায়। একটি সাহিত্যধারা মতে, সময়ের বিবর্তনে মিসরের আজিজ (জুলেখার স্বামী) মৃত্যুবরণ করার পর তাদের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে তাদের কোলজুড়ে দুই পুত্র আফরাইম ইবনে ইউসুফ এবং মায়শা ইবনে ইউসুফের জন্মের বর্ণনাও পাওয়া যায়। কারও কারও মতে, জুলেখার স্বামীর মৃত্যুর পর হজরত ইউসুফ (আ.) মিসরের নতুন আজিজ নিযুক্ত হন এবং তাঁর সঙ্গে জুলেখার বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়। সূরা ইউসুফের ৫৪ থেকে ৫৬ নং আয়াত মোতাবেক মিসরের রাজা ইউসুফ (আ.)-কে সম্মান এবং বিশ্বাসী পাত্র হিসেবে গণ্য করেন এবং তাঁকে বিশ্বস্ত সহচর নিযুক্ত করেন।

সূরা ইউসুফের ৫৮ নং আয়াতে মিসরে দুর্ভিক্ষের সময় ইউসুফ (আ.) প্রজাদের মাঝে খাদ্য বণ্টন করতেন মর্মে ইঙ্গিত রয়েছে এবং তাঁর সৎ ভাইদের মাঝেও তিনি খাদ্য বিতরণ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরার শেষভাগে ১০১ নং আয়াতে হজরত ইউসুফ (আ.) এই মর্মে শুকরিয়া আদায় করেছেন- ‘হে আমার প্রতিপালক, তুমিই আমাকে রাজ্য দান করেছ এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছ’।