• ঢাকা
  • সোমবার, ২২শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৯ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২৭ এপ্রিল, ২০২০
সর্বশেষ আপডেট : ২৭ এপ্রিল, ২০২০

নারায়নগঞ্জের চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের ছয় বছর আজ

অনলাইন ডেস্ক
[sharethis-inline-buttons]

অনলাইন ডেস্ক:

দেশের আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ছয় বছর পূর্ণ হলো আজ। নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল পুরো দেশ।

দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আদালতের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়েছিল র‌্যাবে কর্মরত সেনা কর্মকর্তাকে। তিন বছর আগে উচ্চ আদালত ওই মামলার রায় প্রদান করলেও এখনও তা কার্যকর না হওয়ায় অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন নিহতদের স্বজনরা।

পাশাপাশি সম্প্রতি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১০ আসামিসহ ১৩ সাজাপ্রাপ্ত আসামি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করায় নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে নিহতদের স্বজনদের।

বিভিন্ন সময়ে সাহায্য-সহযোগিতার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে নানাভাবে আশ্বাস দেয়া হলেও বাস্তবে তা না হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছে নিহতের পরিবারগুলো।

সরকারের কাছে তাদের একটাই দাবি– উচ্চ আদালতের রায় যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়। একই সঙ্গে এই রায় কার্যকরের ব্যাপারে ধীরগতিতে সরকারের অনীহার অভিযোগ তুলে আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মামলাটির বাদীপক্ষের আইনজীবীরা।

যেভাবে অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডটি ঘটে

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকা থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন।

তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল ও পরে ১ মে অপহৃত এই সাতজনের লাশ একে একে ভেসে উঠে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর শান্তিরচর এলাকায়।

আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডটি একসময় এ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে শিরোনাম হয়ে ওঠে। আর এই সমালোচনার ঝড় তোলার প্রধান কারণ হয়ে ওঠে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সেই সময় এ জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা (লে. কর্নেল তারেক সাঈদ, লে. কমান্ডার এমএম রানা ও মেজর আরিফ) ও হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেনের জড়িত থাকার ব্যাপারটি। এ ঘটনায় সারা দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

তদন্তের দ্বার খুলেছিল যুগান্তর

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, জেলার সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের ঘটনায় র‌্যাবের সম্পৃক্ততার কথা প্রথম দিকে কেউই বলার সাহস করেননি।

যদিও অপহরণের মাত্র ২ ঘণ্টার মধ্যে স্থানীয় এমপি শামীম ওসমান গণমাধ্যমে দাবি করেছিলেন– দুয়েকজন দুর্নীতিপরায়ণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে।

কিন্তু র‌্যাবের সম্পৃক্ততা তখনও ছিল বায়বীয়। কিন্তু তদন্তের দ্বার উন্মোচন করে দৈনিক যুগান্তর। এই নৃশংস ঘটনার সঙ্গে র‌্যাবের সম্পৃক্ততার প্রথম সচিত্র ও তথ্যবহুল সংবাদ পরিবেশন করে দৈনিক যুগান্তর।

৮ মে সাত লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডোবানোর জন্য ব্যবহৃত ইট নিয়ে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হয় র‌্যাব এই সাত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এই রিপোর্টের সূত্র ধরেই শুরু হয় অনুসন্ধান। হাইকোর্ট র‌্যাব ১১-এর তিন শীর্ষ কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এমএম রানাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন।

মামলা ও আদালতের রায়

অপহরণের ঘটনার একদিন পর কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় ছয়জনকে আসামি করে ফতুল্লা থানায় মামলা করেন। এ ছাড়া আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পালও একই থানায় পৃথক আরেকটি মামলা করেন।

পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এ হত্যাকাণ্ডে সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ৩৫ জনকে আসামি করে চার্জ গঠন করে। পুলিশের চার্জশিট গ্রহণ করার পর ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন ৩৮ কর্মদিবসে ১০৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে বহুল প্রতীক্ষিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে প্রধান আসামি নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করেন আদালত। পরে আসামিপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করে।

২০১৭ সালের ২২ আগস্ট উচ্চ আদালতের রায়ে নূর হোসেন, র‌্যাবের তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এমএম রানাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করেন। পরে আসামিপক্ষ আবারও এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করে।

নিহতদের স্বজনরা যে অবস্থায় আছেন

হত্যাকাণ্ডের পর এই দীর্ঘ ছয় বছরে চরম হতাশার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছেন নিহত সাত পরিবারের স্বজনরা। নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের সাড়ে ৫ বছরের কন্যা রোজা, দিনের অধিকাংশ সময় খুঁজে বেড়ায় তার বাবাকে।

জন্মের আগেই বাবাকে হারানো এই অবুঝ শিশুটি অপেক্ষায় আছে তার বাবাকে দেখবে বলে। চাচা মো. সাজুকেই বাবা বলে ডাকে।

বাসার সামনে ছোট্ট একটা ওয়েল্ডিং কারখানার আয়ের ওপর চলে তার ভাই, মা ও নিজের সংসার। কারখানায় কোনো কর্মচারী নেই। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে নিজেই কাজ করেন।

জাহাঙ্গীরের বিধবা স্ত্রী নূপুর শিশুসন্তানটিকে দাদির কাছে রেখে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত নিম্ন বেতনের চাকরি করেন সিদ্ধিরগঞ্জে সিটি কর্পোরেশনের কার্যালয়ে।

সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হলেও পরে কেউ খোঁজ না নেয়ায় অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় দিন কাটছে অধিকাংশ পরিবারের স্বজনদের জীবন।

নানা বঞ্ছনার মধ্যেও তারা অপেক্ষার প্রহর গুনছেন রায় কার্যকরের সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটির। রোববার এ ব্যাপারে এই প্রতিবেদকের কথা হয় নিহতদের পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে। যুগান্তরের কাছে তারা তাদের বর্তমান জীবনযাত্রার চিত্র ও নানা অভিযোগ তুলে ধরেন।

জাহাঙ্গীরের ভাই সাজু বলেন, সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ভাইকে হারিয়ে আমরা চরম অর্থকষ্টে দিনযাপন করছি। ভাইয়ের এতিম মেয়েটিকে মানুষের মতো মানুষ করাই আমার একমাত্র চিন্তা। সরকার যদি মেয়েটির একটা দায়িত্ব নিত তা হলে আমি নিশ্চিন্ত হতাম। আমার মতো স্বজন হারানোর ব্যথায় কাতর অন্য পরিবারগুলোও।

জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূপুর বলেন, এ সরকারের আমলেই সাত খুনের মামলা আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি। যারা আমার স্বামীসহ সাতজনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের উপযুক্ত বিচার চাই।

নজরুলের বন্ধু নিহত স্বপনের ভাই রিপন বলেন, সরকারের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে যা ভেবেছিলাম বাস্তবে আমরা হতাশ হয়েছি। কারও কাছ থেকেই কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি।

তিনি বলেন, এই রায় নিয়ে আমরা অনিশ্চয়তা এবং অন্ধকারের মধ্যে আছি। আদৌ কি এই রায় কার্যকর হবে? নাকি এভাবেই আমরা অন্ধকারের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকব?

তিনি বলেন, ভাইকে হত্যার পর ভাইয়ের এবং আমার নিজের ব্যবসাবাণিজ্য সব জোর করে দখল করে নিয়েছে নূর হোসেন বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। নিজে এখন ছোটখাটো কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। এর মধ্যেও দেয়া হচ্ছে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি। সবসময় একটা ভয়ের মধ্যে থাকি, কোন দিন যেন আমাদেরও মেরে ফেলে।

স্বপনের খুনের খবর শুনে অন্ধ হয়ে যান তার বৃদ্ধ বাবা। চোখে কিছু দেখেন না। কাঁদতে কাঁদতে এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, মৃত্যুর আগে ছেলের খুনিদের বিচার দেখে যেতে পারলে আত্মায় শান্তি নিয়ে মরতে পারতাম। ছেলের আত্মাও শান্তি পেত। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই।

নিহত তাজুল ইসলামের বাবা আবুল খায়ের বলেন, সাত খুন মামলার রায়টি শেষ হয়েছে। এ রায় এখন সুপ্রিমকোর্টে গেছে। আমরা তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে আছি খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর কবে হবে।

সরকারদলীয় কিছু লোক ও সরকারের কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা যারা সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেবে, আর সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাতজন নিরীহ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে ইট বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছে।

এ নির্মম নির্যাতনের বিচার কি এ দেশে হবে না? প্রধানমন্ত্রীর সেই মনমানসিকতা আছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছি। এ মামলায় যে কয়জন আসামি এখনও পলাতক রয়েছে, তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানান তিনি।

উচ্চ আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও রায় কার্যকরের ব্যাপারটি বিলম্ব হওয়ায় সংশয় প্রকাশ করেন মামলার বাদী নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করবেন।

তিনি তার কথা রেখেছেন। তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আদালত যে রায় দিয়েছেন, তাতে আমরা সন্তুষ্ট আছি। কিন্তু রায়টি কার্যকর কবে হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ের মধ্যে আছি। এই রায় দ্রুত কার্যকরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানান তিনি।

মামলার রায় কার্যকরের ব্যাপারে ধীরগতির কথা উল্লেখ করে অসন্তোষ প্রকাশ করেন বাদীপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াৎ হোসেন খান। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে রায়ের পর প্রধান বিচারপতি আশ্বাস দিয়েছিলেন বিষয়টি তিনি দেখবেন।

কিন্তু প্রায় দুই বছর হতে চলল মামলাটি ধীরগতিতে চলে গেছে। সরকারের মধ্যেও একটা অনীহা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমি সুপ্রিমকোর্টেও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দ্রুত রায় কার্যকর করে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য তিনি বিচার বিভাগ ও সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।

Sharing is caring!

[sharethis-inline-buttons]

আরও পড়ুন

  • সারা দেশ এর আরও খবর
error: Content is protected !!